ক্রিস হেমসওয়ার্থ আর একজন লুছমি -পর্ব দুই
বিকেলের বিষণ্ণ সময়ে অনেকক্ষণ শুয়েছিলাম, ঘুম ঘুম ভাব চোখের কোনে । কিন্তু ঘুম আসছিল না মোটেই। খাটে কাঁথার নিচে শুয়ে ছটফট করছিলাম।বিকেল গড়িয়ে গেছে সেই কখন।আসলে এ সময়ে ঘুম আসার কথাও না।
বার বার অর্কর কথা মনে হচ্ছে। আচ্ছা আমার সব কিছু জানার পরও কী অর্ক আমাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেবে, আমার বিশ্বাস করতে ভীষণ ভয় করছে। তার চেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়াই মনে হয় সবচেয়ে ভালো। পরে কস্ট পাবার চেয়ে আগে সরে যাওয়াই মনে হয় ভালো সিদ্ধান্ত।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম আমি। আমার পেছনে কখন যে বিন্তি এসে দাঁড়িয়েছে আমি বুঝতে পারিনি। বিন্তি আমাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল বলল,”দিদি মনি তোমার চা, একদম ধোঁয়া উঠা। তোমার ফ্রেশ লাগবে দেখো। তুমি অসময়ে শুয়েছিলে, তোমার কী শরীর খারাপ? মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ । কী ঠিক বলেছি তো!”
আমি কিছু বললাম না। বিন্তীর কথা শুনে অল্প হাসলাম। চায়ে চুমুক দিলাম ,আজকের চা অসাধারণ হয়েছে। কিন্তু চা দেখলেই আমার অন্য গল্প মনে হয়। মামনী মারা যাবার আগে আমাকে যে গল্প শুনিয়েছে তা,অসম্পূর্ণ গল্প। আমি জানি এ গল্পের শেষ কোন দিন ও আমার জানা হবে না। সারা জীবন এক অসমাপ্ত গল্পের বেদনা আমাকে পিড়িত করবে। এ কস্ট শুধু আমার একান্ত নিজস্ব। এর ভাগ কারো না। আমার দুঃখ আমার কষ্ট একান্তই ব্যাক্তিগত, এর সঙ্গে কারো মালিকানা নেই।
বিন্তি আর আমার সংসার এখন। মামনী নেই মাস ছয়েক হলো। আমাকে একদম একা করে চলে গেছে। সংসারের সব কাজ বিন্তিই করে। আমাকে সে ধকল সইতে হয় না। মামনী সব কিছু বিন্তিকে শিখিয়েছে। আমার আর্থিক কোন অভাব নেই মামনীর উত্তরাধিকার আমি একা। কিন্তু আমি এতো কিছুর মাঝেও ভীষণ একা।
***
অর্ক অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আছে ড্রইং রুমে। একা একা বসে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে অর্ক তা বুঝতে পারছে। বিন্তি চা দিয়ে গেলো অর্কর সামনে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। অথচ এ মুহুর্তে অর্কর চা খেতে ইচ্ছে করছে না। আজকেই প্রথম এলো অর্ক আমার বাসায়। আমি অর্কর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বললাম, “সরি অর্ক তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য। কী আশ্চর্য তোমার চা তো ঠান্ডা হয়ে একেবারে জল হয়ে গেলো তো।”
“হুম আজ চা খেতে ইচ্ছে করছে না জয়া। তুমি কী বের হবে, বিকেল হয়েছে অনেকক্ষণ। ” “আজকে কোথায়,যেতে ইচ্ছে করছে না। মামনীর কথা বার বার মনে হচ্ছে । সেই সাথে আমার এক ক্ষতের গল্প। তোমার জন্য নতুন করে চা দিতে বলি বিন্তিকে।” অর্ক ঠান্ডা চায়ে চুমক দিল। বলল,”ঠান্ডা চা তো বেশ ইন্টারেস্টিং । “
আমি হেসে উঠলাম অর্কর কথা শুনে। ঠান্ডা চায়ের মধ্যে কী এমন আছে যে ইন্টারেস্টিং। আসলে অর্ক আমাকে মুগ্ধ করার জন্য এ কথা বলছে আমি তা বুঝতে পারছি।
“জয়া তোমার গল্পটা কিন্তু শেষ করনি। যেহেতু বাইরে যাবে না। তোমার গল্প শোনা যাক তাহলে কী বল!”
আমি বললাম, “মামনী মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমাকে বলেছে সে ঘটনা। আসলে মামনী হয়তো বুঝতে পেরেছিল তার সময় শেষ। তার দায়বদ্ধতা এড়াতে হয়তো আমাকে বলেছে। না বললেও কিছু হতো না।”
আমি অর্কর কাছে গল্প টা শুরু করলাম।
” শোন অর্ক মামনীর তখন একেবারে কম বয়স। সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে।বাবা ছিলেন পাইলট। মামনী তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অনেক বছর হলো মামনীর কোন সন্তান হচ্ছে না। বাবা সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। আমাদের বাসায় তখন কাজ করে লুছমি পিসি। কিন্তু লুছমি পিসির মন পরে থাকতো চা বাগানের কোনে। কারণ তার ছোট্ট এক মেয়েকে সে রেখে এসেছিল কাজে। চা বাগানের কাছে ছোট্ট ঝুপরিতে তার মন পরে থাকতো। সে সব সময় মন খারাপ করে থাকতো।
আর মা ছিল নিঃসঙ্গ। মা বুঝতে পারে লুছমি পিসির কস্ট। সেই ছোট্ট মেয়েটিকে আনা হয় আর সেই মেয়েটিই হয়ে যায় পাইলট আর শিক্ষক দম্পতির আদুরে সন্তান। সেই মেয়েটিই জয়া।
অর্ক আশ্চর্য হয়ে বলে, “কী বলছ এসব জয়া। এ হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি না। তুমি এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছো। তোমার বানিয়ে গল্প বলার গল্প আমি জানি।”আমি বললাম, “শোন অর্ক আমি মোটেই বানিয়ে বলছি না। মামনী একটা শর্ত জুড়ে দিল লুছমি পিসিকে। “কী সেই শর্ত ,? “অর্ক অস্থির হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
“মামনী লুছমি পিসিকে বলেছিল এ বাসায়, লুসমি পিসি থাকবে যেহেতু আমি খুবই ছোট, আমাকে দেখভাল করতে হবে। মামনির চাকুরী আছে। কিন্তু সে কখনো তার সন্তান বলে দাবী করতে পারবে না। “তারপর , তারপর কী হলো?””কিন্তু আমি কখনো পিসিকে কাজের মেয়ের মতো জানতাম না।আমি জানতাম সে আমার পিসি। পিসিও এ পরিবারের হয়ে যায়। আমি চোখের সামনে আমার মাকে দেখেছি তাকে পিসি হিসেবে জেনেছি , তার সাথে ঘুমিয়েছি,তার কোলে বড় হয়েছি।কোনদিন জানতে পারিনি সে আমার মা। “
অর্ক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে আমার কথা। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার কাছে। আমি রবি দাস কন্যা। অথচ এক বড় হৃদয়বান পরিবারে বড় হয়েছি।অর্ক বলল,”তারপর বলো।থামলে কেন?”
“বাবা মারা যান তখন আমি বেশ ছোট। আর আমার বাবার পরিচয় আমি জানি না। কারণ আমি যুদ্ধশিশু। আর পিসির তেমন কিছু বলতে পারতো না কারণ তার এক জটিল রোগ হয়। বাবা মারা যান বিমান দুর্ঘটনাতে।”
“অর্ক আজকে আর বলতে ইচ্ছে করছে না। কাল ক্যাফেতে সেই ঘটনা বলব বাবার দুর্ঘটনার আর আমি এক খ্রিস্টান পরিবারে বড় হই। “
অর্ক কে খুব চিন্তিত মনে হলো। এর কারণ তো অনেক। আমি আমার পরিচয় জানি না। পিসিও তেমন করে বলতে পারেনি তার এক জটিল রোগের কারণে। আমি আর অর্ক দুই ধর্মের। (চলবে)
লেখিকাঃ শাহানা জেসমিন নিয়মিত লেখালেখি করেন। পেশাগত জীবনে তিনি একটি সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন সাহিত্যমূলক পেজ ও গ্ৰুপে তাঁর লেখা প্রকাশ পেয়ে থাকে। জীবনের গল্প সৃষ্টিতে অনুপম দক্ষতা শাহানা জেসমিন এর। জীবনের খন্ডচিত্রকে জোড়া লাগিয়ে তিনি আঁকতে পারেন জীবনবোধ সম্পন্ন গল্প, কাহিনী। ”ক্রিস হেমসওয়ার্থ আর একজন লুসমি” শিরোনামে তাঁর এই ধারাবাহিক গল্প কাহিনী এক যুদ্ধ শিশুকে নিয়ে।
কিউএনবি/বিপুল/১৮.০১.২০২৩/ সন্ধ্যা ৬.৩০