রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩২ অপরাহ্ন

দাদা হাতটা শক্ত করে ধর

হুসনে আরা বেনু। ঢাকা।
  • Update Time : শনিবার, ২৫ জুন, ২০২২
  • ৪১৪ Time View

দাদা হাতটা শক্ত করে ধর
——————————

রিফাতের মেজাজ খুব বেশি খারাপ ; বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও গ্রুপের সদস্যরা গল্পের সাথে ব্যক্তিগত ছবি জুড়ে দেবেই দেবে !! যত্তোসব ফাজিলের দল………. নাক মুখ খিঁচিয়ে রিফাত বিড়বিড় করে ।

রিফাত ফেসবুকের সাহিত্য ভিত্তিক একটি গ্রুপের কর্ণধার । সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণেই সারাদিন হসপিটালে কর্মব্যস্ত সময় কাটানোর পরেও বিদেশ বিভুইয়ে বসে তার এই স্বপ্নের গ্রুপের সৃষ্টি। বন্ধু বান্ধবদের কাছে এক বিস্ময়, ছুরি কাঁচি নিয়ে কাটাকাটি করার পরও এতো রসবোধ আসে কি করে! যাই হোক, এমনিতেই যথেষ্ট প্যারার মধ্যে আছে সে এডমিন মডারেটরদের নিয়ে। কে কার চেয়ে বেশি কাজ করছে, গ্রুপে নুন্যতম সময়টুকু না দিয়েও কে বেশি প্রিভিলেজ পাচ্ছে…

এসব অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে অনলাইন ভিত্তিক অনেক সাহিত্য সংস্কৃতির প্লাটফর্মগুলোকে ধ্বংস হতে দেখেছে রিফাত। বড় আদর আর ভালোবাসায় গড়া তার এ স্বপ্ন যেন কিছুতেই ভেঙে না পড়ে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে রিফাত দক্ষ নাবিকের মতো। চমৎকার একটা টিমওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে সে তারপরও ঝামেলা লেগেই যায়। এসব ক্যাচাল মেটাবে নাকি পোস্ট এপ্রুভ করবে!

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গল্প কবিতা লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে গ্রুপে । প্রচুর পোস্ট আসছে প্রতিদিন।সব এপ্রুভ করার মতো যদিও না। সে ধরণের পোস্টে আবার মেম্বারদের কাছ থেকে কটু কথা শুনতে হয়” এইসব কী আজাইরা জিনিস পড়তে দিছেন! এডমিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ” তাই মোটামুটি সব পোস্টেই একটু চোখ বুলিয়ে নিতে হয়।

আরোও ঝামেলা আছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারো একটা আবৃত্তি বা গান পড়ে থাকার পরও যখন সেখানে কোনো লাইক বা কমেন্ট না পড়ে তখন এডমিন হিসাবে তাকে আবার কিছু নাম মেনশন করে ট্যাগ করে সেই ব্যক্তিকে উৎসাহিত করতে হয়, তেমনি ভালো কোনো পোস্টও যেন সকলের দৃষ্টিগোচর হয় সে ব্যবস্থাও করতে হয়। ওর স্ত্রী অবশ্য পছন্দ করে না বরং বাঁকা কথা শোনায় : এসব বাদ দিয়ে নিজের কাজকর্মে একটু সিরিয়াস হলে ডাক্তার হিসেবে আরো নামডাক ছড়িয়ে পড়তো । কি লাভ এতে বল! অহেতুক মানসিক ধকলই যায়। কে শোনে কার কথা, ঐ যে শুরুতেই বলেছিলাম ” সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা”।

সবসময় কি আর লাভ লোকসানের হিসেব কষলে চলে! তাছাড়া আমাদের সৃষ্ট এ ধরনের গ্রুপের কারণে বহু লুকিয়ে থাকা প্রতিভা বেরিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত,এটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবে না। অতএব একেবারে ফেলে দেয়ার মতো না কিন্তু কাজটা। তাই না!
সেও ছেড়ে দেয় না প্রিয়তমা স্ত্রীকে।

গল্প এপ্রুভ করার সময় এমনই ছবি সমেত একটা গল্পে চোখ আটকে যায় রিফাতের……………

পেন্সিল স্কেচে করা ছবিটা থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না রিফাত । যেখানে হাফপ্যান্ট আর ফতুয়া পরা প্রায় আট/নয় বছরের একটা ছেলের হাত ধরে বড় বড় চোখে দাঁড়িয়ে আছে বছর চারেকের ফ্রক পরা একটি মেয়ে । কপালের মাঝে তার কালো টিপ , উপরের ঠোঁটের ডানপাশে একটা তিল আর এক মাথা কোঁকড়া চুল । ভারি মায়াবী মুখখানি।

জোড়া ভ্রু কুঁচকালেও এবার একটু ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে। বিরক্তির বদলে ছবিটা রিফাতকে গল্প পড়ায় আগ্রহী করে তোলে………. রাত প্রায় আটটা । এ সময় গ্রামে সবাই খেয়েদেয়ে নিদ্রাহীন চোখে শুয়ে পড়ে । সময়টা যখন ভীষণ বিভীষিকাময় । কেউ জেগে থাকলেও হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় চুপচাপ গুমোট মেরে বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথাবার্তা চালায় নতুবা লো ভলিউমে ছোট্ট একটা রেডিওকে কেন্দ্র করে গোল হয়ে নিশ্চুপ বসে দেশের উত্তপ্ত খবর শোনার চেষ্টা করে ৷ প্রত্যেকের মাঝেই একটা ভয় । (বলা ভালো, তখন গ্রামে সবার বাড়িতে রেডিও ছিল না। দু একজন যাদের বাড়িতে রেডিও ছিল তাদের বাড়িতে তাই প্রতিবেশীদের চাপটাও বেশি পড়তো।) চারিদিকে মৃত্যুপুরীর মতো নিস্তব্ধতা । আজকাল গাছের পাতাগুলো যেন খুব সতর্ক হয়ে গেছে, টুংটাং শব্দ হবার শঙ্কায় টিনের চালে ঝরে পড়তেও ভুলে গেছে ! বাড়িতে পাকিস্তানী আর্মি এসেছে ।

একটা হাতল ছাড়া চেয়ারে বসে আছেন মেজর সাহেব। হাতে একটা ছড়ির মতো যা কিনা ক্লক ওয়াইজ আর এন্টি ক্লক ওয়াইজে ঘুরিয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে আসা পাকসেনাদের অন্য সদস্যরা ঘুরেফিরে কি যেন খুঁজছে । বাড়িতে বসবাসরত সব্বাই শক্ত হয়ে হয়ে জমে গেছে। নাহ শীতে না, ভয়ে। গম্ভীর স্বরে মেজর সাহেব বাড়ির কর্তাকে জিজ্ঞেস করেন: তুমহারা নাম কেয়া হ্যায় ?

মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে তার উত্তর: জে স্যার ,আব্দুর রহিম ।

: চার কালিমা আতা হ্যায়?

আব্দুর রহিম ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতেই মেজর বললেন ঃ ছুনাও ।

আব্দুর রহিম কালিমা তাইয়াবা নির্ভুল উচ্চারণে ঠিকই বললো কিন্তু কালিমা শাহাদাৎ এ এসে “লাশারিকালাহুর” পরে আর একটা শব্দও বের করতে পারছে না তার গলা থেকে। বারবার আটকে যাচ্ছে । রীতিমতো ঘামতে শুরু করে সে ; হাত পা কাঁপছে তার । আবার মুসলমানের প্রমাণ দেখতে চাইবে না তো তারা ? এসব ভেবে লুঙ্গি ভিজে যাবার উপক্রম হয় আব্দুর রহিমের ।

আব্দুর রহিম ছাপোষা ভীতু টাইপের মানুষ । বাজারে ছোট্ট একটা হাড়িপাতিলের দোকান আছে । স্ত্রী ,একছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট্ট সুখের নীড় । বিছানায় মেয়েটা আমপারা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছে আর ভাইটা ছোট্ট বোনটিকে কোলে নিয়ে বসে একমনে পাকসেনাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত আছে ।

একটু আগেই ছেলে তার নির্ভয়ে চার কালিমা শুনিয়ে দিল অথচ বাবা হয়ে সে আর এক কদমও এগাতে পারছে না। সেই “লাশারিকালাহুতেই” পড়ে আছে! খুব লজ্জা লাগছে। নিজেকে কেমন আহম্মক আহম্মক মনে হচ্ছে ছেলের সামনে । মেজর সাহেব পিঠ চাপড়িয়ে বাহবা দিয়ে ছেলেকে বলেন : ছাচ্চা মুসলমান আছে ; শের কা বাচ্চা হ্যায় । হামারা ভি দো লাড়কা লাড়কি আছে।
বলেই ঠোঁটের কোনে সূর্যের কিরণ আনার চেষ্টা করে ।

আব্দুর রহিম হাঁটুগেড়ে বসে করজোরে বলে : ভয়ে হাম সব ভুল যাতাহে স্যার ; মাফ কারদো ছাব ।

মেজরের চোখেমুখে পিত্তি জ্বালানি হাসি দেখা যায়। তার সামনে কাওকে নেড়িকুত্তার মতো বসে থাকতে দেখে হয়তো গর্ববোধ হচ্ছে । ঘরের চারপাশে একবার সন্তর্পণে চোখ বুলিয়ে নেয় সে । দেয়ালে দুটো ছবি ঝুলছে। একটা ছবিতে বাবা- মা তাদের দুই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে । আরেকটা দুই ভাইবোনের ছবি । ঘরের এক কোনে একটা চকি’র মতো ,পাশেই টেবিলে একটা কোরান শরীফ আর বাচ্চাদের কয়েকটা বই । ঘরের মাঝ বরাবর আড়াআড়ি একটা দড়িতে কিছু কাপড় ঝুলছে ; আর আছে বসার জন্য দুইটা মোড়া ।

উনি পানি খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে আব্দুর রহিম স্ত্রীকে আড়ালে ভেকে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে : বৌ, সাহেবরে শরবত দে ।

স্ত্রী জোলেখা দাঁত কিড়মিড়িয়ে জানায় ঃ চিনি নাই ।

বড় ঘোমটা টেনে কাঁপা কাঁপা হাতে জোলেখা গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই মেজরের হাতের স্পর্শ পায় । ঘৃণা আর ভয়ে কুঁকড়ে যায় সে । জোলেখা এই গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে একজন, মেজরের সেটা অজানা নয়। জোলেখা শুনেছে হানাদার বাহিনী গ্রামের বৌঝিদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালাচ্ছে ।মেজরকে তার আপাদমস্তক শকুনের দৃষ্টিতে গিলতে দেখে জোলেখার আত্মা প্রায় খাঁচাছাড়া।

হারামজাদা মিনসে তুই আমার হাত দরছোস? তর মাতায় ঠাডা পড়বো ! আপন মনে গর্জে ওঠে জোলেখা।
তৃপ্তির সাথে পানি খেয়ে মেজর সাহেব জোলেখার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ঃ ভাবি ছাহেবার হাতমে পানিভি শারবাত হো যাতা হ্যায় ।
ওর ঠোঁটে হায়নার হাসি দেখে জোলেখা রাগে গজগজ করে ঃ নিকুচি করি তোর শরবতের ।
ঐ পানিতে আমি থুথু দিছি।

তবে আল্লাহতায়ালার অশেষ কৃপায় পাক আর্মীরা কোন ক্ষতি না করেই নিঃশব্দে চলে যায় । ওরা চলে যাবার পর পরই দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছবি দুটো নিয়ে ভাইবোন দুহাতে মুখ ঢেকে হেসে গড়িয়ে পড়ে…. …. ছেলে সৌম্য জিজ্ঞেস করে ঃ তোমার মাতায় সিঁদুর কই মা ? তোমারে এক্কেরে জমিলা চাচীর মতোই লাগতাছে ।

: চুপ কর ,আমার সব শেষ অইয়া গেল রে। বলে অশ্রু ফেলে বিলাপ জুড়ে দেয় দুর্গারাণী ।

ধমক খেয়ে মেয়ে শিখা ছবিটা আমপারার মধ্যে লুকিয়ে ফেলে । বড় অদ্ভূত ভাবে বইটা দেখছিল শিখা । মাকে সে গীতা পড়তে শুনেছে। কিন্তু আলিফ, বা , তা এগুলা কেমন ভাষা ? পাশের বাড়ির মিনু আপাকে হুজুরের কাছে মাঝেমধ্যে পড়তে শুনেছে সে ।

গড়িয়ে পড়া চোখের পানি ঠোঁটের কাছে আসতেই দুর্গারানি আঁচল দিয়ে বারবার তা মুছে ফেলে । ধর্মীয় রীতিনীতি সে কঠোর ভাবে মেনে চলে । প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে লক্ষ্মীপূজা শেষ করে । ঘরের দেয়ালে পরম যত্নে রাধাকৃষ্ণের ছবি , সরস্বতীর ছবি টানানো । অথচ নিজহাতে তার ধর্ম , তার বিশ্বাস আজ সে জলাঞ্জলী দিয়েছে । এ যে ঘোরতর পাপ !!!ভগবানের কাছ থেকে সে কোনদিনও ক্ষমা পাবে না এ অন্যায়ের জন্য ।

স্বামীর মঙ্গলের জন্য প্রতিদিন যে শাখা সিঁদুর পরে আসছে এতোদিন ধরে ,সেগুলো ধুয়েমুছে শহরের স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলেছে । প্রতিবেশী বকর ভাই বলেছে , সংখ্যালঘুদের উপর নাকি বেশি অত্যাচার হচ্ছে । তাই তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এই ধর্মান্তরের অভিনয় । এক উঠোনের এপাশ ওপাশে থাকে তারা। উঠোনের ঠিক মাঝখানে একটা তুলসী গাছ । বকর ভাইয়ের স্ত্রী জমিলা বুর সাথে তরকারির বাটি আদানপ্রদানও করে,তুলসীপূজাও করে । কিছুদিন আগে জমিলা বু’র শ্বশুরের মৃত্যু হলে তিনদিন ধরে শোকে বিহ্বল পরিবারটিকে রেঁধে বেড়ে খাইয়েছে সে। নিজেদের পূজায়ও জমিলা’ বু নাড়ু বানাতে হাত লাগায়। সুখে দুঃখে বহু বছর ধরে মিলেমিশে আছে ওরা। এ যেন সম্প্রীতির এক জলন্ত উদাহরণ……..

অশিক্ষিত সহজ সরল দুর্গা তার স্বামী নিতাই ঘোষকে জিজ্ঞেস করে ঃ স্বাধীনতা কি গো ? যে আমাগের ধর্মান্তরের ভাব দরতে অইলো?

স্বামী ওকে বুঝায় ঃ যার যার ধর্ম পালনের জন্যিই তো স্বাধীনতার দরকার । বুক ফুলাইয়া চলনের জন্যি ; ভয়ে ঘরের মধ্যে ঘাপটি মাইরে না থাকনের জন্যিই তো স্বাধীনতা লাইগবে। সন্দের সময় বাজারে এট্টু গপশপ করনের জন্যিও তো স্বাধীনতা লাইগবে। ; বুজলিনা ? তার জন্যিই যুদ্ধ ……….

: আমগো যদি মুসলমান সাজতেই অইবো তো ৪৭ এর সময় পাডাইলো না ক্যান?চুপচুপ ; দুর্গারণীর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে কৃত্রিম ধমকের সুরে নিতাই ঘোষ বলে ঃ খুব পলিটিস বুচ্ছোস, না! মাইয়া লোকের এতো বুজা বালা না। এইডা হইলো রাষ্ট্রের প্যাঁচ বা নীতি। আমাগের মতো মুক্যুসুক্যু মাইনসের বোজনের কাম না। কথা আর বাড়ায় না ওরা।

সেই রাতে সৌম্যদের ছেড়ে দিলেও যাদের দয়ায় আজ ওরা প্রাণ ফিরে পেয়েছে সেই পরম মিত্র বকর চাচাদের সবাইকে মেরে ফেলে পাকসেনারা মধ্যরাতে। অপরাধ………… তার ছোট ভাই নাকি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে । একের পর এক বাড়িঘর জালিয়ে দেয় পাকবাহিনী ।

ছোট্ট শিখা বকর চাচাদের নিথর দেহগুলো দেখে মাকে বলে ঃ তাগো আল্লাহ খুব খারাপ ,না মা ? ম্যালা কষ্ট দেছে ওগো রে। আমাগের ভগবান খুব বালা !! ছোট্ট শিখার জানা নাই যে আমাদের সৃষ্টিকর্তা একজন।

নিতাই ঘোষ সিদ্ধান্ত নেয় নড়াইল থেকে চিত্রা নদী পার হয়ে যশোরের বেনাপোল দিয়ে কলকাতার রানারঘাট সৌম্যর দুঃসম্পর্কের মামা বাড়ি যাবে । এখানে আর এক দণ্ডও নয়। দুই ভাইবোন তাদের মাটির খেলনা ,বইপত্র দুটো ব্যাগে ভরে পিঠে নিয়ে নেয় । সংসারের সব ফেলে যা না হলেই নয় , দুর্গারানি তেমনই দুটো পুঁটলি বেঁধে নেয় । কোনো এক গহীন রাতের অন্ধকারে স্বামীর হাত ধরে চোখের জল মুছতে মুছতে তাদেরই মতো ঘর ছাড়া আরো অনেকের সাথে বড় একটা নৌকায় চেপে বসে । পেছনে ফেলে আসে অসংখ্য স্মৃতি ঘেরা দশ বছরের সংসার। অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী আর পাড়া প্রতিবেশি ।

নৌকার এক কোনে বসে শিখা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে : হাতটা শক্ত করে ধর দাদা ,আমি পইড়ে যাচ্ছি !!

নদী পার হতেই কোথা থেকে খবর পেয়ে পাক আর্মি আক্রমণ করে । চারিদিকে গোলাগুলি ; রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শুরু হয় বুকভাঙা আর্তনাদ । সবায় গন্তব্য ভুলে পাগলের মতো ছোটাছুটি শুরু করে । এবং সৌম্য একসময়ে আবিষ্কার করে বোনটি তার হাতের বাঁধন ছিড়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে !!

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে ; ওরা প্রায় যশোর চলে এসেছে । ওখানে মা ছেলেকে সহযাত্রীদের কারো কাছে রেখে নিতাই ঘোষ জীবনের মায়া ভুলে মেয়েকে খুঁজতে যায় ।

তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর পাওয়া গেল না শিখাকে । এক বুক হতাশা নিয়ে নিতাই ঘোষ ফিরে আসে । বাবা আদরের পরীকে খুঁজে না পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এক সময় স্বর্গে চলে যায় ।

৩০ লক্ষ প্রাণ আর প্রায় ৩ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা একসময় ঠিকই এলো কিন্তু কেড়ে নিল অনেক কিছু । অনেকেই পরিবারের পূর্ণতা পেল না । কিছু পেতে গেলে তো কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়….. ঠিক তবে তার মাশুল যে এতোটা যন্ত্রণাদায়ক ছোট্ট সৌম্য সেদিন শুভাকাঙ্ক্ষীদের বলা কথার মানে বুঝতে পারেনি। হারিয়ে গেল জীবন থেকে আনন্দ , সুখ। দিয়ে গেল আজন্মের মতো একটা ক্ষত যা থেকে অবিরত রক্ত ঝরছে আজও ।

প্রকৃতি তার নিজস্ব গতিতে চলে । শীতে পাতা ঝরে ; আবার এক সময় ফুলে ফুলে ছেঁয়ে যায় । কিন্তু সৌম্যদের ছোট্ট বাগানে নিয়ম মেনে আর বসন্ত আসে না ।

আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো অশীতিপর বৃদ্ধা মা এক বুক আশা নিয়ে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন ……….এই বুঝি কেউ এলো !!!

কেননা তিনি শিখার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত নন। ও হারিয়ে গেছে । আর সে জন্য নিজেকেই দায়ী করছেন আজ অবধি। এটাই তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তারপরও ক্ষীণ একটু লোভ হৃদয়গহনে বুঝি লুকিয়ে আছে আজও। মেয়েকে দেখার লোভ । সে আশাই হয়তো তাকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে ।

সৌম্যর নিজের সংসার হয়েছে ; তিন ছেলের বাবা এখন। সন্তানদের গভীর ভালোবাসার মাঝে সে এখনও তার ছোট্ট বোনটিকে হাতড়ে বেড়ায় । যুদ্ধ থেমে গেছে সেই কবে কিন্তু একজন ভাইয়ের তার আদরের বোনকে ফিরে পাবার যুদ্ধ এখনও চলছে ।

সেই ছোট্ট দুটো হাত কী পরম নির্ভরতা আর নিশ্চিন্তে দাদার হাত ধরেছিল । পারেনি সে বোনকে রক্ষা করতে । ঘুমের ওষুধ খেয়ে সৌম্য সেই ব্যর্থতার দায় এখনও ভুলতে চেষ্টা করে ।কোঁকড়া চুলের কোনো মেয়েকে দেখলেই পিছন থেকে শিখা ভেবে জড়িয়ে ধরে কত্ত যে তাদের ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টি কুড়িয়েছে !!

কোথায় আছে শিখা ?

সৌম্য ভাবে ,হয়তো ওদের কাছাকাছিই আছে কিন্তু বয়সের ভারে চিনতে পারছে না কেউ কাওকে। কিংবা যুদ্ধশিশুদের মতো কোনো বিদেশী দম্পত্তির ঘরে আদর যত্নে মানুষ হচ্ছে। নাকি হাত পা ভেঙ্গে ভিক্ষাবৃত্তিতে বসিয়েছে কেউ ? আচ্ছা, কোঁকড়াচুলো কি রিবণ্ডিং করে স্ট্রেইট করিয়েছে শিখা! হয়তো ওপাড়ে গিয়ে ভগবানের কাছে নালিশ করেছে সৌম্যর অপারগতার কারণে । চোখ ফেটে কান্না আসে সৌম্যর  ” বিদ্যা ” বলছি বোন , আমি ইচ্ছাকৃত কিচ্ছু করিনি । তোর মনে আছে, বকর চাচার মেয়ে মিনু’পা আমাদের শিখিয়েছিল বিদ্যা বলে কখনো মিথ্যা বলতে হয়না ।

তাহলে নাকি আল্লাহ জিহ্বা টেনে মাথার পেছনে নিয়ে পেরেক ঠুকে দেয় । আমি কি করে মিথ্যা বলি! যেখানেই থাকুক শিখা ভালো থাকুক । সৌম্য এখনও ভাবে , মেঘলা আকাশ থেকে একদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে । কোনো এক হলির দিনে ছোটবেলার মতো আমরা ভাইবোন আবার আবীর মাখবো গায়ে। সেই আশায় বাঁচি ।

 

পাদটীকাঃ সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা ।

এই গল্প লেখার সময়ে হঠাৎ দেখি আকাশে তারা ছুটে গেল । মা বলতেন ,এই সময়ে মানুষের ইচ্ছে পূরণ হয় । আকাশের বুকে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারারা আমার ইচ্ছের কথা জানে ।

গল্প পড়তে পড়তে লেখাগুলো বাকহারা রিফাতের চোখে ঝাপসা হতে থাকে । সে পোস্টে’র দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে বহুক্ষণ। এপ্রুভ করার কথা মাথায় নেই। বুঝতে পারে না কেন? নিখুঁত চিত্রকলার জন্য নাকি চোখে জল আনা গল্পটার জন্য? এতো বছর পরেও হারিয়ে যাওয়া বোনের প্রতি এতটা আবেগ ,অনুভূতি আসলেই কি থাকে ?
ঃ ঘুমুবে না!
কত রাত হলো খেয়াল আছে! পেছন ফিরে দেখে স্ত্রী এসে দাঁড়িয়ে আছে । নিষ্পলক সে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে দৃষ্টিতে ভালোবাসা না অবিশ্বাস ছিল তা কেবল রিফাতই জানে।

ছবির মেয়েটা হুবহু দেয়ালে বাঁধাই করা ওর ছোট মেয়েটির মতো দেখতে। আর তার স্ত্রী ডাক্তার জেসিকা আহমেদ শিখার ঠোঁটেও ঠিক একই জায়গায় একটা তিল আছে !! প্রথম দেখায় যে তিলের প্রেমে পড়েছিল রিফাত আহমেদ ।

 

লেখিকাঃ হুসনে আরা বেনু। ঢাকা।

 

 

কিউএনবি/বিপুল/২৫.০৬.২০২২/ সন্ধ্যা ৬.২৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit