মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৩০ পূর্বাহ্ন

স্বপ্নের নগরীতে ইতিহাসের কান্না

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৫
  • ৩১ Time View

ডেস্ক নিউজ : সুপ্রাচীন কাল থেকে দজলা নদীর তীরে বাগদাদ নামের বসতি গড়ে ওঠে। ‘বাগ’ এক প্রাচীন দেবতার নাম আর ফারসি ‘দাদ’ শব্দের অর্থ দান। বাগদাদ অর্থ বাগ দেবতার দান বা উপহার। আবার কেউ বলেন, বাদশাহ নওশেরাওয়া এখানের বাগানে বসে ‘দাদে ইনসাফ’ তথা ন্যায়বিচার করতেন।

তাই এর নাম হয়েছে বাগদাদ। তবে নগরী হিসেবে বাগদাদের উত্থান এবং গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হয় মুসলিম শাসন আমলে। আব্বাসীয় শাসকরা ইসলামী খেলাফতের জন্য একটি নতুন রাজধানী নির্মাণের চিন্তা করছিলেন। তখন তারা দজলা ও ফোরাত নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এই স্থানটি বেছে নেন।

খলিফা আবু জাফর আল মনসুর ৩০ জুলাই ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে এই নগরীর গোড়াপত্তন করেন এবং এর নাম দেন মদিনাতুল ইসলাম বা ইসলামের শহর। রাষ্ট্রীয় নথিতে এই নামেই বাগদাদকে উল্লেখ করা হতো। যদিও তার বহুল প্রচলিত ও ঐতিহাসিক নাম বাগদাদ। বাগদাদ নগরী নির্মাণের জন্য এই স্থানটি বেছে নেওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো এটা ছিল একাধিক নৌ ও স্থল বাণিজ্য পথের মিলনস্থল এবং এর আবহাওয়াও অত্যন্ত চমৎকার।

খলিফা মানসুর বাগদাদ নগরীকে বৃত্তাকার শহর হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি স্বপ্নের শহর নির্মাণে হাজার হাজার প্রকৌশলী, কারিগর ও স্থাপত্যশিল্পী নিয়োগ দেন। এর নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন এক লাখের বেশি শ্রমিক। শহরের চারদিকে কয়েক স্তরের উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা হয়। বহির্ভাগের দেয়ালটি ছিল সর্বোচ্চ ৮০ ফুট উঁচু।

শহরের প্রবেশপথ ছিল চারটি। তা হলো দক্ষিণ-পশ্চিমের কুফা ফটক, দক্ষিণ-পূর্বের বসরা ফটক, উত্তর-পশ্চিমে শাম ফটক আর উত্তর-পূর্বের খোরাসান ফটক। প্রতিটি প্রবেশদ্বার থেকে একটি সরাসরি সড়ক সোজা গিয়ে থেমেছে শহরের মধ্যভাগে। এসব সড়কের দুদিকে নির্মাণ করা হয়েছিল চোখ-ধাঁধানো অনেক ফুলের বাগান এবং ছোট ছোট বিপণি। ৭৬৬ সালের মধ্যে বাগদাদের নির্মাণকাজ শেষ হয়।
বাগদাদ নগরীকে একসময় ‘উরুসুল বিলাদ’ (নগরগুলোর নববধূ) বলা হতো। ইসলামী খেলাফতের রাজধানী, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র, শিল্প-সাহিত্যের তীর্থ হিসেবে বাগদাদকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। নবম শতাব্দীর বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী আল জাহিজ বাগদাদ সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বের অনেক সুন্দর ও পরিপাটি শহর দেখেছেন, কিন্তু বাগদাদের চেয়ে উন্নত এবং নিখুঁত চোখ-ধাঁধানো বৃত্তাকার শহর কোথাও দেখেননি। আব্বাসীয় খলিফারা এখানে বসে পুরো পৃথিবীর ওপর শাসনের ছড়ি ঘোরাতেন। আব্বাসীয় খলিফাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়। একদিন খলিফা হারুনুর রশিদ সভাসদদের সঙ্গে খোলা মাঠে হাঁটছিলেন। ইরাকে তখন অনাবৃষ্টি চলছিল। তিনি আকাশে এক টুকরা মেঘ দেখে খুশি হলেন। কিন্তু মেঘ বর্ষিত না হয়েই সামনে চলে গেল। তখন তিনি মেঘকে সম্বোধন করে বলেন, আচ্ছা! তোমার ইচ্ছা। তুমি যেখানেই বর্ষিত হও, রাজস্ব আমার ভাণ্ডারেই আসবে।

বাগদাদ ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রাজশক্তির রাজধানী। যা বহু বর্ণ, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষকে তার শাসনাধীন করেছিল। ফলে বাগদাদও হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা, বর্ণ ও জ্ঞানের মিলনস্থল। বিশেষত জ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যচর্চার উর্বর ভূমি ছিল বাগদাদ। এখান থেকে সারা বিশ্বে পড়ে ইসলামী জ্ঞানের আলো। পাশাপাশি ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি পুষ্ট হলো বিশ্বসভ্যতার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কৃষ্টি দ্বারা। জ্ঞানীদের জ্ঞানপিপাসা মেটাতে নির্মিত হলো বায়তুল হিকমার মতো বিশ্ববিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্র এবং অসংখ্য বিদ্যাপীঠ, বিদ্যালয় ও পাঠাগার। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ এনেছিল ঐতিহাসিক নগরী বাগদাদ। 

বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও বাগদাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চারদিক একাধিক বাণিজ্য পথ বাগদাদে এসে মিলিত হয়েছিল। এর মধ্যে প্রধান বাণিজ্য পথ ছিল খোরাসানের বাণিজ্য পথ। চীন থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে বাগদাদে মিলিত হয়েছিল। যাকে প্রাচীন সিল্ক রোড বলা হয়। দজলা ও ফোরাত দিয়ে আফ্রিকা-এশিয়ার বাণিজ্য বিনিময় হতো, বসরা ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর। যার সঙ্গে যুক্ত ছিল ভারত মহাসাগরের পথ ধরে বাণিজ্যকারী অঞ্চলগুলো।

যে আব্বাসীয় খলিফাদের হাতে গড়ে উঠেছিল সুরম্য শহর বাগদাদ সেই খলিফাদেরও বিরাগভাজন হয়েছিল একসময় শহরটি। ৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে খলিফা হারুনুর রশিদ রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে খেলাফতের রাজধানী সরিয়ে নেন সিরিয়া রাকা শহরে। পরে রাজধানী আসে বাগদাদের ১২৫ কিলোমিটার দূরের সামারাতে। রাজধানীর মর্যাদা হারানোর পর বাগদাদ তার জৌলুসও হারাতে থাকে। তবু ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় নিজের গুরুত্ব ধরে রেখেছিল শহরটি।

বাগদাদের ইতিহাসে প্রথম দুর্ভাগ্যের বছর ছিল ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ। এ বছর মোঙ্গল সর্দার হালাকু খান বাগদাদ দখল করে এবং সেখানে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ঐতিহাসিকরা লেখেন, হালাকু খান বাগদাদের ২০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১৫ লাখকে হত্যা করেছিল। বিদ্যালয় ও পাঠাগারগুলো ধ্বংস করেছিল এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো নিশ্চিহ্ন করেছিল। হালাকু খান যাওয়ার বাগদাদে আবারও প্রাণসঞ্চার হয়েছিল। ফিরেছিল জীবনের ছন্দ। ১৪০১ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লং বাগদাদ দখল করে এবং হালাকু খানের মতো গণহত্যা চালায়। এর এক শতাব্দী পর ইরানের সাফাবিদ শাসক শাহ ইসমাইল বাগদাদে আবারও ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি বাগদাদ দখল করার পর সুন্নি মুসলমান ও আলেমদের লক্ষ্যে পরিণত করেন।

১৫৩৪ সালে উসমানীয় শাসক সুলতান সুলাইমান বাগদাদ জয় করেন এবং বাগদাদের সুন্নি পরিচয় ফিরিয়ে আনেন। মাঝে সামান্য সময় ছাড়া ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বাগদাদ উসমানীয়দের শাসনাধীন ছিল। এরপর তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন হয় এবং তারা ১৯৩২ সাল পর্যন্ত শাসন করে। বিংশ শতাব্দীতে এসে বাগদাগ তিনটি ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হয় আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধ, নব্বইয়ের দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং ২০০৩ সালে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন। যে যুদ্ধের ক্ষত বুকে নিয়ে ধুঁকছে ইতিহাসের সুরম্য নগরী বাগদাদ। স্বপ্নের বাগদাদ নগরী যেন এক দুঃস্বপ্নের রাত। যার শরীরজুড়ে দখলদার বাহিনীর বুটের দাগ আর হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হয়ে আছে অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর সংঘাতের বুলেট।

তথ্যসূত্র : বিবিসি আরবি, আলজাজিরা, রোর মিডিয়া ও উইকিপিডিয়া

কিউএনবি/অনিমা/২৪ আগস্ট ২০২৫/সকাল ১১:৪০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

September 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit