রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫১ পূর্বাহ্ন

আব্বাসীয় যুগে বিজ্ঞানে মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫
  • ১৫ Time View

ডেস্ক নিউজ : আব্বাসীয় খিলাফতের প্রারম্ভিক যুগ থেকেই খলিফারা অনুবাদ ও অন্যান্য জাতির জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি আহরণে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরা বিদেশি ভাষার গ্রন্থগুলোকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেন এবং এই আন্দোলনের বিকাশে প্রত্যেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই অনুবাদ আন্দোলন শুধু জ্ঞানের আদান-প্রদান নয়, বরং আরবি ভাষা ও ইসলামী সভ্যতার বিকাশে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটায়।

খলিফা মানসুরের যুগ (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.)

আব্বাসীয় খলিফা মানসুর এই অনুবাদ আন্দোলনের প্রবর্তকদের অন্যতম ছিলেন।

তাঁর শাসনামলে বহু গ্রন্থ বিদেশি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ করা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘কালিলা ওয়া দিমনা’, যা মূলত সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি ভারতীয় নীতিকথা-সংগ্রহ। প্রথমে এটি ফারসি ভাষায় অনূদিত হয় এবং পরে ইবনে আল-মুকাফা ফারসি থেকে এর আরবি অনুবাদ করেন। এর মাধ্যমে ভারতীয় চিন্তা ও সংস্কৃতির প্রভাব ফারসি সংস্কৃতির হাত ধরে আরবি জগতে প্রবেশ করতে শুরু করে।

জ্যোতির্বিদ্যা ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা

খলিফা মানসুর শুধু সাহিত্য বা দর্শনের অনুবাদেই আগ্রহী ছিলেন না; তিনি বিজ্ঞান, বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতিও সমান মনোযোগ দিয়েছিলেন। বলা হয়, তিনিই প্রথম খলিফা, যিনি রাজসভায় জ্যোতিষীদের স্থান দেন এবং তাদের সহায়তায় নাক্ষত্রিক ছক (জ্যোতির্বিদ্যার টেবিল) প্রণয়ন করেন। এই আগ্রহের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন নওবখত আল-ফারসি, যিনি ছিলেন তৎকালীন এক বিশিষ্ট জ্যোতিষী ও আল-মানসুরের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা। আব্বাসীয় যুগের খলিফারা শুধু শাসক হিসেবেই নন, জ্ঞান ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়।

তাঁদের প্রচেষ্টায় গ্রিক, ফারসি ও ভারতীয় সভ্যতার জ্ঞানভাণ্ডার আরবি ভাষায় স্থানান্তরিত হয়, যা ইসলামী সভ্যতার এক সোনালি যুগের সূচনা করে। খলিফা মানসুর পারস্যের জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের সীমাবদ্ধতায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল জ্ঞানের পরিধি আরো বিস্তৃত করা, তাই তাঁর রাজত্বকালে নক্ষত্রবিদ্যা, গ্রহের গতি এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা শাখা নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতীয় গ্রন্থ ‘সিন্ধিন্দ’, গ্রিক পণ্ডিত টলেমির বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ্যা গ্রন্থ ‘আলমাজেস্ট’, অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার বই, ইউক্লিডের জ্যামিতিবিষয়ক গ্রন্থ এবং পাটিগণিত সম্পর্কিত বই। এই অনুবাদগুলোর মাধ্যমে গ্রিক দর্শন, গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের ভিত্তি আরবি জগতে প্রবেশ করে এবং পরে ইসলামী চিন্তাধারার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রেও অনুবাদের কার্যক্রম সক্রিয় ছিল। আল-মানসুরের আমলে আবু ইয়াহিয়া আল-বাত্রিক বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস ও গ্যালেন-এর বহু গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন, যা ইসলামী চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশে মৌলিক ভূমিকা রাখে।
খলিফা হারুনুর রশিদের যুগ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.)

আল-মানসুরের উত্তরসূরি খলিফা হারুনুর রশিদ-এর যুগে অনুবাদ আন্দোলন সর্বোচ্চ বিকাশ লাভ করে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত বাইতুল হিকমা ‘জ্ঞানভুবন’ বা ‘জ্ঞানের ভাণ্ডার’, যা ছিল একাধারে গ্রন্থাগার, গবেষণাগার ও অনুবাদকেন্দ্র। সেখানে বহু দক্ষ অনুবাদক নিয়োগ করা হয় এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য (রোমানদের দেশ) থেকে বিপুল পরিমাণ বই আমদানি করা হয়। এই বিশাল উদ্যোগের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিখ্যাত চিকিৎসক ও অনুবাদক ইউহান্না ইবনে মাসওয়াইহ। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা ও ফার্মাকোলজি নিয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। পাশাপাশি জিবরিল ইবনে বুখতিশু, যিনি আল-রশিদের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন, তিনিও চিকিৎসা ও যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কিত বেশ কিছু গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন; তাঁর বিখ্যাত কাজগুলোর একটি হলো ‘তর্কের শিল্পের ভূমিকা’।

বারমাকিদ পরিবারের ভূমিকা

অনুবাদ আন্দোলনের প্রসারে বারমাকিদ পরিবারের অবদান ছিল অনন্য। তাঁরা গ্রিক, ফারসি ও ভারতীয় ভাষার বহু গ্রন্থের আরবি অনুবাদে উদার পৃষ্ঠপোষকতা দেন এবং দক্ষ অনুবাদকদের আর্থিক পুরস্কার প্রদান করেন। শুধু তা-ই নয়, তারা আগে অনূদিত কিছু বই নতুনভাবে পুনঃ অনুবাদ করার উদ্যোগও নেন, যাতে অনুবাদগুলো আরো নির্ভুল ও প্রাঞ্জল হয়।

খলিফা মামুনের যুগে অনুবাদ আন্দোলনের বিকাশ ও এর প্রভাব

আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে খলিফা আল-মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)-এর যুগকে অনুবাদ ও বৈজ্ঞানিক জাগরণের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তাঁর সময়ে অনুবাদ আন্দোলন এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। কারণ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত ‘বাইতুল হিকমা’ বা জ্ঞানের ঘর, যা ছিল অনুবাদকেন্দ্র, গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার সব একত্রে।

মানমন্দির ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান

খলিফা মামুনের যুগেই নির্মিত হয় একটি বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ্যা মানমন্দির, যা তাঁর নামে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ ইয়াহিয়া ইবনে আবি মানসুরকে। অল্পদিনের মধ্যেই এই মানমন্দিরটি এক বৃহৎ জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতবিদ্যা বিদ্যালয়ে রূপ নেয়, যেখানে বিদ্বানরা ব্যাবহারিক গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাচীন গ্রিক জ্ঞানভিত্তিকে অতিক্রম করে আরো উন্নত গবেষণা পরিচালিত হয়। এখানে বিজ্ঞানীরা গোলকের গতিবিধি (planetary motion) সম্পর্কিত নতুন ও নির্ভুল টেবিল তৈরি করেন এবং পৃথিবীর গোলাকার পরিধি পরিমাপেও অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে তাঁরা পৃথিবীর দুই ডিগ্রি পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা সে সময়ের জন্য এক বিপ্লবাত্মক বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব ছিল।

অনুবাদ আন্দোলনের প্রভাব : চিন্তা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রাথমিক আব্বাসীয় যুগে অনুবাদ আন্দোলন শুধু জ্ঞানের প্রসার ঘটায়নি, এটি আরবি মনন ও সংস্কৃতিকে গভীরভাবে রূপান্তরিত করে। দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চা নতুন প্রাণ লাভ করে। প্রথমবারের মতো বৈজ্ঞানিক গবেষণাপদ্ধতি যুক্ত হয় মানবসভ্যতার জ্ঞানের ধারায়। এর ফলেই জন্ম নেয় এক নতুন বৈজ্ঞানিক রেনেসাঁ, যার প্রভাব ইসলামী বিশ্ব ছাড়িয়ে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

১. গণিত ও বীজগণিত : এই যুগে আল-খোয়ারিজমি ছিলেন গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোলের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি খলিফা মামুনের মানমন্দিরে কাজ করা শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন। তাঁর গবেষণায় ‘বীজগণিত’ নামে নতুন এক শাখার জন্ম হয়, যা পরে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর নাম থেকেই ‘Algorithm’ শব্দটির উৎপত্তি।

২. রসায়নবিজ্ঞান (কেমিস্ট্রি) : জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়নবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত। তিনি পরীক্ষানির্ভর গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। ধাতু, অমৃত (elixir) ও রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পর্কিত বহু তত্ত্ব তিনি প্রবর্তন করেন, যা আধুনিক রসায়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।

৩. চিকিৎসা ও শারীরস্থান : চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিকাশেও এই যুগে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। ইউহান্না ইবনে মাসওয়াইহ, যিনি চিকিৎসক ও শারীরস্থানবিদ ছিলেন, গবেষণায় প্রথমবারের মতো বানর ব্যবচ্ছেদ (dissection) প্রয়োগ করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা শারীরস্থান বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং তাঁকে আরব চিকিৎসা গবেষণার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

৪. ছন্দ ও সংগীতবিদ্যা : অনূদিত গ্রিক ও ফারসি সংগীতবিষয়ক গ্রন্থের মাধ্যমে আল-খলিল ইবনে আহমদ আল-ফারাহিদি ছন্দবিদ্যার বিজ্ঞান (prosody) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছন্দ ও মাত্রার নিয়ম নির্ধারণ করে আরবি কবিতা ও গানের ধারায় বিপ্লব ঘটান। তাঁর লেখা ‘ছন্দের বিজ্ঞান’ বিষয়ে গ্রন্থটি এতই প্রভাবশালী ছিল যে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ইসহাক আল-মাওসিলি তা তাঁর সংগীততত্ত্বে আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেন। এভাবেই আব্বাসীয় খলিফা মামুনের যুগে অনুবাদ ও গবেষণার এই বিপুল আন্দোলন শুধু আরবি সাহিত্য ও চিন্তাধারাকে সমৃদ্ধ করেনি, বরং বিশ্বের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক স্থায়ী দাগ রেখে গেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাইতুল হিকমা ও মানমন্দির ইসলামী সভ্যতার বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রার প্রতীক হয়ে ওঠে, যেখানে প্রাচীন জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক অনুসন্ধানের সেতুবন্ধ গড়ে ওঠে।

কিউএনবি/অনিমা/১৯ অক্টোবর ২০২৫,/সকাল ৭:৫৮

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit