শনিবার, ১০ জুন ২০২৩, ০২:৫১ পূর্বাহ্ন

রুপা মোজাম্মেল এর জীবনের খন্ডচিত্র : “সারপ্রাইজ”

রুপা মোজাম্মেল, কানাডা।
  • Update Time : সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ১৩৭৯ Time View

“সারপ্রাইজ”
—————

আমার হাসবেন্ড, তিনি সারপ্রাইজ দিতে খুব পছন্দ করে। জীবনে এত সারপ্রাইজ দিয়েছে যে, সারপ্রাইজ খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি। এখন তো এমন এক্সপার্ট হয়ে গেছি যে তার মাথায় সারপ্রাইজ দেয়ার চিন্তা এলেই ধরে ফেলতে পারি। আর চুপে চুপে গোয়েন্দা গিরি করে বের করে ফেলি কিসের উপর সারপ্রাইজ প্ল্যান হচ্ছে। তার পর চুপ করে থাকি, আর সারপ্রাইজের দিন অভিনয় করে আমিও সারপ্রাইজ হই। এটাই এখন নেশা হয়ে গেছে।

গিফট পেতে কার না ভাল লাগে, আমিও বেতিক্রমী কিছু না। কিন্তু এত বেশি বেশি পেয়েছি যে সেই লোভে আমার জিব্বা এখন দুই হাত লম্বা প্রায়। বিশেষ বিশেষ দিন গুলোতে এখন বাচ্চারাও এক গাদা করে গিফট দেয়। কোনো ওকেশন ছাড়াও দেয়, কিছু পছন্দ হলেই আমার জন্য নিয়ে আসে। আমাকে সবাই মিলে স্পয়েল্ড করে ফেলেছে (বন্ধুরা বলে)। এক্সপেক্টেশন এমন হয়েছে যে, মনে হয় সবারই আমাকে গিফ্ট দেয়া উচিত, আর সেটা আমাকে পেতেই হবে! ওরা শপিং করে এলেই বলতে থাকি “আমার জন্য কি এনেছো!” তাতে ওরা নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।

আমাদের এক বিবাহ বার্ষিকীতে আমার উনি আমাকে উইশ করতেই ভুলে গেলো, গিফ্ট দেয়া তো দূরের কথা! ঘড়ির কাঁটার দিকে শুধু তাকিয়ে রইলাম, রাত ১২ টা ১ মি. ২ মি.হয়ে গেলো, এভাবে সময় যেতে যেতে ১টা বাজলো, ২টা বাজলো, তবুও কোনোই খবর নেই। রাগে অভিমানে আমিও উইশ না করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভাবলাম সকালে হয়তো উইশ করবে! ওমা, সকালে নাস্তা খেলাম, চা খেলাম একই সাথে, সামনে দিয়ে অযথাই ঘুর ঘুর করছি, তবুও কোনো খবর নেই! মনে মনে বলছি বিয়ের অনেক বছর হয়ে গেলে হয়তো মানুষ এমনি ভুলা মন হয়ে যায়। কান্না পেলো খুব, তা চেপে রেখে মিন মিন করে আমিই উইশ করলাম তাকে।
— বিবাহ বার্ষিকীতে তোমাকে শুভেচ্ছ
— ওহ্ একদম ভুলে গিয়েছি! তোমাকেও অনেক শুভেচ্ছা।
রাগে, দুঃখে, অভিমানে বুক ফেটে যাচ্ছিলো এমন একটা উত্তর পেয়ে।
সকাল সকাল বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে আর আমাকে বললো –
— আজকে আমার এক বন্ধুর ছেলের জন্মদিন, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। সন্ধ্যায় রেডি থেকো সবাই মিলে সেখানে যাবো।
মন খারাপ নিয়ে আমি আস্তে করে বললাম
— আচ্ছা।
বের হয়ে যাবার পর আমি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। খুব কান্না করলাম, নিজেকে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল, নিজে নিজেই বির বির করছিলাম “আমার এখন আর কোনো মূল্যই নেই”, আমাকে উইশ করতেও ভুলে যায়!

বিকেলে মন খারাপ নিয়ে বাচ্চা কাচ্চা সহ রেডি হলাম দাওয়াতে যাবো বলে। লাগছিল জীবনের সব রঙ আমার শেষ হয়ে গেছে! তাই ভেবে একটা সাদা কালো থ্রী পিস পড়লাম।

দাওয়াত টা ছিল একটা রেস্টুরেন্ট এ। ৪৫ মিনিট ড্রাইভ করার পর আমরা পৌঁছলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি জন্মদিনের কোনো ডেকোরেশন নেই। কোনো মেহমানও আসেনি। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমরাই কি প্রথম গেস্ট নাকি! কাউকে দেখছিনা যে!
— হ্যা, আমরা যেহেতু দুর থেকে এসেছি তাই একটু আগে আগেই এসেছি।
— একটু বেশি আগেই চলে এসেছি। এখনো কিছু সাজানো ও হয় নি।
— না হোক, তুমি আসো আমার সাথে, তোমাকে সুন্দর একটা জায়গা দেখাই।

আমাকে নিয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট এর একদম মাঝখানের একটা টেবিলে। সুন্দর করে গোলাপ ফুল দিয়ে টেবিলটা সাজানো আর তাতে লিখা “রিজার্ভড”! এতো গুলো টেবিলের মাঝে শুধু একটা টেবিল সাজানো দেখে বুঝে ফেললাম, এটা আর কিছু না, আজকের বিশেষ দিনের সারপ্রাইজ! দাওয়াত টাওয়াত সব ভুয়া। আমাকে বসিয়েই সে একটু আসছি বলে বাইরে চলে গেলো।

আমি তো এখন ভীষন খুশি! এতো সুন্দর আয়োজন করে ডিনারে নিয়ে এসেছে, এটাই অনেক বড় পাওয়া! গিফট না পেলেও চলবে।
সে ফিরে আসার পর বললাম
— তুমি এত ফাজিল কেনো! সব সময় ফাইজলামি করো!
— ফাইজলামি না তো, ইতরামি করি (এটা তার কমন ডায়লগ)।

খাবার অর্ডার করা হলো, সবাই খুব আনন্দের সাথে ডিনার শেষ করলাম। সকাল থেকে মনের ভেতরে যা দুঃখ, কষ্ট, অভিমান জমা হয়েছিল তার সবটুকুই দুর হয়ে একদম আহ্লাদে গদো গদো হয়ে আছি।

বাসায় আসার জন্য বের হবো ঠিক সেই সময় রেস্টুরেন্টের স্টাফরা একটা কেক হাতে নিয়ে জোরে জোরে উইশ করতে করতে আমাদের টেবিলে এসে কেক টা রাখলো! আমি তো হা হয়ে রইলাম, আবারো সারপ্রাইজ! আমার খুশি কে দেখে! গদো গদো আবারো। ইচ্ছে হচ্ছিল ন্যাকার মত তাকে জড়িয়ে ধরি। শাশুড়ি সাথে ছিল বলে লজ্জায় করতে পারিনি।

সে এবার কেকটা কাটতে বললো।

— দুজনে মিলেই কাটি! আমি বললাম
— না তুমি একাই কাটো
আমারএকটু মন খারাপ হল। একাই কাটলাম, ছোট্ট একটা টুকরা তাকে খাইয়ে দিলাম।

— এখন কেকটা কেটে একদম টুকরো টুকরো করে ফেল। সে বললো একটু বিরক্ত হলাম। এভাবে কেক নষ্ট করার কোনো মানে হয়! সবাই এতো খেয়েছি, কেক কে খাবে এখন! বিরক্তি নিয়ে ছুরি দিয়ে যখনই মাঝামাঝি কাটতে লাগলাম, তখনই কেক এর ভিতরে কেমন যেনো একটা শক্ত জিনিষ অনুভব করলাম। কেক থেকে ক্রিম সরাতেই দেখতে পেলাম একটা ছোট জুয়েলারি বক্স! আমার চোখ জল জল করে উঠলো! আবারো সারপ্রাইজ! কেকের ভেতরে গিফট!অবাক হয়ে খুশিতে হাতে নিয়ে খুলতেই দেখি একটা ডায়মন্ড রিং! আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে দেখছিল আর তালি দিচ্ছিল। খুশিতে প্রায় দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা আমার!

এভাবে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে চিন্তাও করতে পারিনি! আমাকে নিজের হাতে আংটি টা পরিয়ে দিয়ে উইশ করলো
— Happy anniversary!
কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললো “ভালোবাসি কিন্তু”!
আমিতো গলে একদম আলু ভত্তা।

কেকটা সব স্টাফদের মাঝে বিলিয়ে দিলাম। কৃতজ্ঞ হলাম আল্লাহর কাছে, এমন একটা জীবন সঙ্গী আমাকে উপহার দেয়ার জন্য! আমার জীবনের সবচেয়ে অন্যতম সারপ্রাইজ ছিল এটা! হাজার হাজার খুশি ভরা ডালা নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

এর পর থেকে প্রতি বছরই তাকে মনে করিয়ে দেই “আবার কবে পাবো এমন সারপ্রাইজ!” দুঃখের কথা, আজো পর্যন্ত কোনো উত্তর পেলাম না।

পরে জানতে পারলাম, সকালে নাস্তা খাওয়ার পর যখন বাইরে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল, তখন সে আংটি টা কিনে কেক অর্ডার করতে গিয়েছিল। পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ডায়মন্ড রিং কেকের ভেতর নিজের হতে বসিয়ে কেকটা বানাতে শেষ করেছে। তারপর গাড়ির পেছনে এমন করে লুকিয়ে রেখেছিল, আমি যাতে না দেখতে পাই।

 

 

লেখিকাঃ রুপা মোজাম্মেল লেখাপড়া শেষ করে কানাডা প্রবাসিনী হয়েছেন। পুরো পরিবার নিয়ে কানাডায় থাকেন, সেখানেই তাঁর কর্ম জীবন। লেখালেখি করেন নিয়মিত। জীবনের খন্ডচিত্র আঁকতে পারদর্শিনী রুপা মোজাম্মেল। আজকের পোস্টটি তাঁর কাছ থেকে সরাসরি সংগৃহিত।

 

 

 

কিউএনবি/বিপুল/ ০৫.০৯.২০২২/ রাত ১১.০২

সম্পর্কিত সকল খবর পড়ুন..

আর্কাইভস

June 2023
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
© All rights reserved © 2022
IT & Technical Supported By:BiswaJit
themesba-lates1749691102