কে এই রুমকী ?
——————
২৫ বছর পর রুমকী দেশে ফিরেছে। এক ঈদের দিনে নাহিদ আর রুমকী মিলিত হল। তারা তাদের প্রিয় চারণভূমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরতে গেল। কলাভবনের পূর্ব কোনায় আমতলা। গুরু দুয়ারা নানক শাহী সংলগ্ন আম গাছটির গোড়া এখন শান বাঁধা ,নাহিদ রুমকী দুজনেই বসেছে শান বাঁধানো আম গাছ তলায়।
——— কিছুটা শান্ত, কিছুটা প্রকৃতিস্থ, কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসল রুমকী। রক্ত জবার মত লাল চোখ দুটো থেকে এখনও নোনা জল ঝরছে। টিস্যু পেপার দিচ্ছে নাহিদ। কি এমন দুঃখ বাসা বেঁধে আছে রুমকীর অন্তরে ? নিউয়র্কের আলো ঝলমলে ব্যস্ত জীবনে রুমকীর কষ্টের কারণ গুলো শুনতে হবে। জানতে হবে নাহিদকে । রুমকীর ফর্সা হাতের আঙ্গুল গুলো বন্দি হয়ে আছে নাহিদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু সাহস করে কিছুই বলতে পারছেনা নাহিদ।
হটাৎ মুখ খুললো রুমকী। শুরু করল সাবলিল ভাবেই। নাহিদ শোন, আমি যা পঁচিশ বছর যাবৎ বুকে চাপা দিয়ে রেখেছি, আমি আজ সব খুলে বলব তোমাকে। শুরুটা এরশাদের পতন দিয়ে। তোমাদের গ্ৰুপটা এরশাদের দালাল হিসাবে চিহ্নিত হল, তোমার বড় ভাইরা সহ তোমরা ডাঃ মিলন হত্যার আসামী হলে । রাতারাতি তোমরা জাতির কাছে ঘৃণিত এবং ভিলেনে পরিণত হলে। আমি জানিনা, এর বাস্তবতা কি ছিল ? তোমরা আদতেই এরশাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলে কিনা ? কি হয়েছিল নাহিদ ? আসল ঘটনা কি তুমি বলবে কি? হ্যা বলব, সব কথাই বলব। আগে তুমি তোমার কথা শেষ কর, নাহিদ বলল।
ওকে, সেটাই ভাল। আমি আমার কথা বলে যাই। তুমি তোমার কথা বলিও। রুমকী আবার শুরু করল। রাষ্ট্র তোমাদের নামে হুলিয়া জারী করল। ঢাকা শহর সহ সারা দেশে শীর্ষ আসামীদের ছবি সহ পোস্টার লাগিয়ে দিল পুলিশ। ক্যাম্পাসে এসে শুনি একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে তোমাদের দলের প্রতিপক্ষরা খুঁজছে তোমাদেরকে। প্রতিপক্ষরা পেলে দেখা মাত্র গুলি করবে। পুলিশ কায়দামত পেলে হয় গ্রেফতার নতুবা শুটআউট। আমি তখন পাগলের মত খুঁজছি তোমাকে। মোবাইল ফোন ছিলনা তখন, আমার এক বান্ধবী বলল, তোমাকে নাকি সে টিকাটুলির এক গলিতে দেখেছে। ৯১ এর মাঝামাঝি। তুমি কি টিকাটুলিতে ছিলে নাহিদ? হ্যা ছিলাম। টিকাটুলি, মানিকনগর, ধলপুর সহ পুরান ঢাকার অনেক জায়গায় লুকিয়ে ছিলাম। নাহিদ অকপটে স্বীকার করল।
৯১ এর সেপ্টেম্বর মাসে জানতে পারলাম, তোমরা কয়েকজন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্ততঃ জীবনটাতো সেফ হল। রুমকী একটু দম নিল, আর কি যেন ভাবল একটু। আবার শুরু করল রুমকী। মাস্টার্স এ ভর্তি হলাম। লেখাপড়া ঠিক ঠাক মতোই হচ্ছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসে আসা কমিয়ে দিলাম। পরীক্ষা ছাড়া আসা আর হতোনা। কেন? জানতে চাইল নাহিদ । সেটাও তোমার কারণে। তোমার দলটা তখন ক্ষমতাসীন দল বনে গেছে। ক্যাম্পাসে যারা তোমার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখেনি, তখন তারাই আমাকে টিচ করত, নানান ধরণের অপদস্ত করত। সেটাও সমস্যা ছিলনা, মুখ বুজে সব সয়ে যেতাম। কিন্তু তোমার অনুপস্থিতি আমার মধ্যে হাহাকার তৈরী করত। কলাভবনে আসলে মনে হয়, এই বুঝি তুমি দোতলার করিডোর দিয়ে হেটে আসছ। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলে মনে হত সিঁড়ির মুখেই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। লাইব্রেরি গেটে গেলে মনে হয়, তুমি বোধ হয় আমার অপেক্ষাতে দাঁড়িয়ে আছ। হাকিম চত্বরের দিকে তাঁকিয়ে থাকি, এই বুঝি তুমি এক গাল সিগারেটের ধুঁয়া ছেড়ে হাসতে হাসতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছ। অলস দুপুরে টিএসসির বারান্দায় তোমাকে খুঁজি। তুমি কোথাও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ক্যাম্পাস আছে। মিটিং মিছিল সব আছে, শুধু তুমি নেই। এ জন্যে ক্যাম্পাস বলতে গেলে ছেড়েই দিলাম। নাহিদ মুখ আড়াল করে কাঁদছে। গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে।
ওকি নাহিদ তুমি কাঁদছ ? তুমি কাঁদবে কেন? কাঁদবতো আমি। রুমকী টিস্যু দিয়ে নাহিদের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে। এখন বৃষ্টি নেই। জোড়ায় জোড়ায় আম গাছের বাঁধানো শানে বসে গল্প করছে। অনেকেই মধ্যবয়সী এই জুটি নাহিদ রুমকীর দিকে তাকিয়ে আছে। এরা দুজন কাঁদছে কেন? নাহিদ রুমকীকে বলল, চা খাবে ? আজ এখানে কোথায় পাবে চা ? কথা শেষ হলে মধুতে চা খেয়ে বিদায় নিব। ঈদের দিনেও মধুর ক্যান্টিনতো খোলা থাকে, রুমকী বলল।
আবার শুরু করল রুমকী। ৯৩ এর দিকে ঠাস করে আমার বিয়ে হয়ে গেল। পুরান ঢাকার বড় ব্যবসায়ীর ছেলে রাশেদ। দেশে এসেছে বিয়ে করতে। প্রবাসীরা বিয়ের বাজারে তখন লোভনীয় পাত্র। তুমিতো জানো, আমার বাবা নেই। মাতৃকুলের সকলে মিলে আমার বিয়েটা দিল। রাশেদ নাকি আমেরিকায় এম এস করেছে। বিয়েটা হটাৎ করে হলেও আমি পাগলের মত তোমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম। তোমার বন্ধু বাবুলের কাছে যেয়েও ব্যর্থ হয়েছি আমি। তুমি যে কোন দেশে তাও বলতে পারেনা কেউ। আমি পারলাম না বিয়েটা ঠেকাতে নাহিদ। আমার হাতে কোন বিকল্প ছিলনা।
আমি সে জন্যে কোন অনুযোগ, অভিযোগ করিনা রুমকী। দোষতো আমারই রুমকী, আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাছাড়া চেষ্টা যে করিনি তাও নয়। কয়েকদিন তোমার বড় খালার বাসায় ব্যাংকক থেকে ফোন করেছিলাম। তুমি নাকি সেখানে থাকোনা আর। মেজো খালার বাসায় থাকো, নাহিদ বলল। রুমকী বলল, হ্যা কিছুদিন মেজো খালার বাসায় ছিলাম, কিন্তু বড় খালা চাইলে মেজো খালার বাসার ফোন নাম্বার দিতে পারত। একটা ধীর্ঘস্বাস ছেড়ে রুমকী বলল।
শোন বিয়ের পর রাশেদ চলে গেল আবার নিউইয়র্কে। যাওয়ার সময় আমার কাগজ পত্র নিয়ে গেল। দ্রুত আমাকে ইউএসএ নিয়ে যাবে। সেই দ্রুত দেড় বছরে গড়াল। রাশেদ আমাকে নিতে ৯৪ এ আসল। মজার ব্যাপার, এরই মধ্যে তুমিও দেশে ফিরেছ। ভুত দেখার মত একদিন তোমাকে দেখলাম নাজিমুদ্দিন রোডে। নীরব থেকে খেয়ে তুমি বের হচ্ছ। আমি রাশেদ সহ ওদের বাসা যাচ্ছি। আমি গাড়ীর জানালা নামিয়ে চিৎকার করছি, তুমি শোনোনি। রাশেদ ও ইচ্ছা করেই আর গাড়ী থামায়নি।রুমকী বিরামহীনভাবে বলে যাচ্ছে। নাহিদ ও ছন্দপতন ঘটাচ্ছেনা। তারপরে কি হল ? শুধু এই টুকু জানতে চাইল নাহিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জোহরের আজান দিচ্ছে। আমেরিকা প্রবাসিনী রুমকী অজান্তেই ওড়নাটা মাথায় দিল। আজান শেষে রুমকী আবারো শুরু করল, রাশেদ আমাকে নিয়ে গেল নিউইয়র্কে। খুব স্বাভাবিক আনন্দ বেদনার কাব্যের মতই আমার জীবন চলছে আমেরিকায়। তিন চার মাস পর রাশেদের কিছু কিছু পরিবর্তন আমার কাছে ধরা পড়তে শুরু করল। সে আমেরিকায় এম এস করেনি। বাংলাদেশ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্তই তার কোয়ালিফিকেশন। এর মাঝেই আমি কনসিভ করেছি। রাশেদের লেখাপড়ার বিষয়টি আমার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। যদিয় এই প্রতারণা মেনে নিতে পারছিলাম না। বাসার পাশেই কুইন্স কলেজ। ভর্তি হলাম সেখানে। নাহিদ এবার আমি একটু একান্তই আমার দাম্পত্য জীবনের করুন একটি চিত্র তুলে ধরব তোমার কাছে। তুমি শুন্ছতো আমার কথা ? হ্যা শুনছি নাহিদ সাড়া দিল।
সামান্য বিরতি দিয়ে রুমকী আবার শুরু করল। আমি যখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট, তখন আমি কনফার্ম হলাম, আমার হাজবেন্ড রাশেদের একাধিক বিশেষ সঙ্গী আছে। তারা যদি মেয়ে হত আমি মেনে নিতাম, অথবা দেশের অনেক অভাগীর মত মনে করতাম আমার একাধিক সতীন আছে। কিন্তু আমার স্বামীর অন্তর জুড়ে ভালোবাসার প্রস্রবণ বয় কোন মেয়ে মানুষের জন্যে নয়। তার অবাধ যৌন সঙ্গী কয়েকজন কিশোর। হোয়াট! বলে চিৎকার করে উঠল নাহিদ।
খুবই ঠান্ডা, সহজ স্বাভাবিক ভাবে রুমকী বলল, হ্যা নাহিদ, রাশেদ হল গে, সমকামী। একটা বিকৃত, পারভার্টেড সে। শিশু কিশোরদের সাথে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত সে।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ,কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/২৯.০৭.২০২২/সকাল ১১.২৫