কবি ও কবিতা
——————
আমাদের স্কুলে তখন ক্যাম্পেইন হতো। রশি টানিয়ে কয়েকজন যুবক স্কুল মাঠে বই টানিয়ে রাখলো। আমাদের এক ক্লাস ছুটি দেয়া হলো যেন আমরা গিয়ে বই দেখতে বা পড়তে পারি।
সময় খুব কম। আমরা হুড়োহুড়ি করে গিয়ে বই হাতে নিলাম। কি মিষ্টি গন্ধওয়ালা বই। নাকে চেপে খানিকক্ষণ নতুন বইয়ের গন্ধ নিলাম। তারপর পড়া শুরু করলাম। মাত্র চল্লিশ মিনিট। হাওয়ায় উড়ে গেলো। তবে যারা উদ্যোক্তা, তারা জানিয়ে গেল – যারা আবৃত্তি করতে চায় বা কবিতা ভালোবাসে তারা নাম লেখাতে পারবে । পরে তাদের ডাকা হবে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে। পাবনায় আমরা যে জায়গাটিকে অন্নদা গোবিন্দ লাইব্রেরী হিসেবে জানি প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার সেখানে একজন কবি আসবেন। উনি কবিতা নিয়ে কথা বলবেন। আবৃত্তি করবেন। আমাদেরকে কবিতা পড়তে উৎসাহিত করবেন ।
একবার কি ভেবে দুরুদুরু বুকে ক্যাম্পেইনে নাম লেখালাম। বাসার ঠিকানা দিয়ে এলাম মতিন ভাইয়ের কাছে। উনি তখন পাবনার একমাত্র পত্রিকা পাবনার খবরের সম্পাদক।
ওমা, বিকেলেই দেখি তিনি দলবল নিয়ে হাজির। আম্মা কাউনের পায়েস করে তাদের খাওয়ালেন। তখন নাস্তার এতো হরেকপদ দেখানোর নিয়ম ছিল না। সেই পায়েস খেয়েই তারা মহা খুশি। পরদিন বুকের ঢাই কুড় কুড় শব্দকে রিক্সার ঝনঝনানি বলে চালিয়ে দিয়ে গেলাম লাইব্রেরীতে। ওমা ! গিয়ে দেখি চাঁদের হাট। আরো অনেক স্কুল কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছে।
সেদিন কবি হিসেবে এসেছিলেন ‘লুৎফর রহমান রিটন। উনি চমৎকার কিছু কথা বলে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। তারপর সবাইকে অনুরোধ করলেন একটি অন্তত কবিতা পড়ে শোনাতে। সাথে শর্ত জুড়ে দিলেন, যে কবিতা পড়ে শোনাবে না। তাকেও মঞ্চে এসে বলতে হবে ‘ কেন কবিতা পড়ছি না বা পড়তে পারছি না। এখন তো আমাদের পালা কবিতা পড়ি আর না পড়ি মঞ্চে আসতেই হবে। অনেকের হাঁটু কাঁপা শুরু হলো। আমি ভেবে নিলাম আমার হাঁটুর নিচ থেকে কোন কিছু নেই। আমি বাতাসে ভর দিয়ে হাঁটি । আজ বাতাসের বেগ কম তাই উঠে দাঁড়াতেও পারছি না।
জেলা স্কুলের ছাত্র আলফা প্রথমে একটা কবিতা পড়লো। কবি শুনলেও আমরা অনেকেই না শুনেও শোনার ভান করলাম। আমাদের শাপলা গিয়ে কবিতা পড়ে এলো। এখন আমি কোন দিকে যাই। পালাবার তো পথ নাই। মঞ্চে গিয়ে হড়বড় করে কি পড়েছিলাম মনে নেই। প্রায় দৌড়ে পালিয়ে এলাম।
উপহার দেয়ার জন্য অনেক কবিতার বই সাথে এনেছিলেন কবি। প্রায় সবাই বই পেলো। আমার হাতেও একটা বই দিলেন তিনি ( এখনকার মতো তার গোঁফ এতো মোটা ছিল না ) তবুও আমি ভয়ে অস্থির। আমার হাতে বইটি দেয়ার সময় চমৎকার দুটি লাইন আবৃত্তি করলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি লাইন দুটি আমার মাথায় আজীবনের মত গাঁথা হয়ে গেল ।
“আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই
আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।
দুঃখ তো আমার হাত – হাতের আঙুল – আঙুলের নখ
দুঃখের নিঁখুত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।”
আমি কোনমতে বললাম – আপনি তো কবি না, আপনি তো ছড়াকার। উনি হো হো করে হেসে দিলেন। বললেন – এই কবিতাও আমি লিখিনি এত সুন্দর লেখা এখনো লিখে উঠতে পারিনি। তোমাকে যে বইটি দেয়া হয়েছে এই কবিতা সেই বইয়ের।
আমি তাকিয়ে দেখি নীল প্রচ্ছদে পাতলা একটি কবিতার বই। নাম ‘যে জলে আগুন জ্বলে ‘ লেখক হেলাল হাফিজ।’
সেই থেকে পরিচয় আমার কবির সাথে, আর প্রেম তার কবিতার সাথে। কৈশোরের সময়টিতে সাধারণত মনের পালে হাওয়া লাগা শুরু হয়। আমরা তখন মাসে বা পনেরো দিনে একটা সিনেমা দেখে জেনে গেছি।
আমাদের সেইসব সময়ে প্রেম ছিল কবিতার সাথে, অদেখা কবির সাথে। আমাদের ভালোবাসা ছিল। ছিল মধুর অপেক্ষা। এখন সব নাগালের মাঝে, তাই এখন সব আছে।
শুধুমাত্র ভালোবাসাগুলো হয়ে যাচ্ছে ‘অধরা। ‘
কবি পরিচিতিঃ নিতু ইসলাম নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর আবেগঘন লেখা হাহাকার সৃষ্টি করে। পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পেশাগত জীবনে জীবনে গৃহিণী। নিতু ইসলাম বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা পাবনা জেলায়। রাঁধতে, বই পড়তে,ও লিখতে ভালোবাসেন। পাবনার আদি নিবাসেই তাঁর জীবন যাপন।
কিউএনবি/বিপুল/২৪.০৬.২০২২/সন্ধ্যা ৬.৫০