শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:০০ পূর্বাহ্ন

গাজী মাজহারুল আনোয়ার : যদি আমাকে জানতে সাধ হয়, বাংলার মুখ তুমি দেখে নিও

Reporter Name
  • Update Time : শনিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৫
  • ২৩ Time View

সত্য সাহা ১৯৬৭ সালে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে নিয়ে গেলেন সুভাষ দত্তের কাছে। বললেন আপনার নতুন ছবিতে এ ছেলে গান লিখবে। সুভাষ দত্ত গাজী মাজহারুল আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অল্প বয়স। ভালো করে গোফই উঠেনি। তিনি বিরক্ত হলেন। সত্য সাহার জন্য কিছু বলতেও পারলেন না। গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে গানের সিচুয়েশন বুঝিয়ে দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

মনে মনে চ্যালেঞ্জ অনুভব করে গাজী মাজহারুল আনোয়ার লিখলেন প্রথম লাইন, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’। সেটাই সুরে তুললেন সত্য সাহা। আরও কয়েক লাইন লিখলেন। কিছুক্ষন পর কাছে এসে সুভাষ দত্ত বললেন, ‘এই, ভালোই তো লাগছে জিনিসটা। শেষ করো তাহলে।’ গান শেষ হলো। ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমায় আনজুমান আরা বেগমের গাওয়া সেই গানের আবেদন আজও ফুরায়নি। ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি ৫৫ বছর যাবৎ জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থা করছে। বাংলা চলচ্চিত্রে এটিই ছিল গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা প্রথম গান।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার অনবদ্য এক ইতিহাস। প্রায় ২০ হাজারের অধিক গান লিখেছেন তিনি। যা অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর ও অসাধারণ এক সাফল্য। মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ, স্নেহ; অনুভূতির বৈচিত্রময় প্রকাশে গেল কয়েক দশক ধরেই এদেশের মানুষের কাছে খুব প্রিয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গান। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। আমাদের সংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি। বিবিসি বাংলার তৈরি করা করা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকায় রয়েছে তার লেখা তিনটি গান। এটাও এক বিরল সম্মান বটে।

গানের বাইরেও গাজী মাজহারুল আনোয়ার বিকশিত হয়েছেন একজন চলচ্চিত্র চিত্রনাট্যকার,পরিচালক ও প্রযোজক ও রাজনীতিবিদ হিসেবেও। কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে এক জীবনে কোটি মানুষের ভালোবাসা ও দোয়াকেই সেরা বলে মনে করেন। পেয়েছেন বেশ কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশের একুশে পদকও লাভ করেন। তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর আদর্শের অনুসারী একজন। বেগম খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত একজন হয়ে বিএনপির রাজনীতিতে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার জন্মেছেন কুমিল্লায়। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে । বনেদি পরিবারের সন্তান। দাদা ও দাদি দুজনই ছিলেন জমিদার বংশের। বাবা ব্রিটিশ আমলের আইনজীবী। মা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। বেড়ে উঠেছেন কুমিল্লাতেই। তার প্রথম স্কুল কুমিল্লা জেলা স্কুল। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। জীবনের দারুণ সময় কেটেছে তার কুমিল্লায়।

কিংবদন্তি গীতিকার, সুরকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক, রাজনীতিবিদ গাজী মাজহারুল আনোয়ার মারা গেছেন ৭৯ বছর বয়সে।

১৯৬৪ সালে ২১ বছর বয়সে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করেন তিনি । পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন। ১৯৬৭ সালে আয়না ও অবশিষ্ট চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষতা দেখান তিনি। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ মুক্তি পায় ১৯৮২ সালে। তিনি মোট ৪১টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন।

অসংখ্য কালজয়ী গানের রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান লিখেছেন। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ ও ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’ তুমি সুতোয় বেধেছ শাপলার ফুল নাকি তোমার মন, তার লেখা তুমুল জনপ্রিয় গান।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার ‘পীচ ঢালা পথ’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘অবুঝ মন’, ‘চাষীর মেয়ে’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘মহানগর’, ‘নতুন বউ’, ‘নাজমা’, ‘অভিযান’, ‘মা ও ছেলে’, ‘রাজলক্ষী শ্রীকান্ত’, ‘রাঙা ভাবী’, ‘ছুটির ফাঁদে’, ‘বাবার আদেশ’, ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে গান লিখেছেন।

২০০২ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ২০২১ সালে তিনি সংস্কৃতিতে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ অর্জন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য গাজী মাজহারুল স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার ‘বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। এছাড়াও গাজী মাজহারুল আনোয়ার পাঁচবার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’, একাধিকবার ‘বাচসাস পুরস্কার’, ‘বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন।

গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন জাতীয় নেতা। মৃত্যু অবধি লড়াই করে গেছেন দেশের জন্যে। আসুন কালজয়ী এই মানুষটির বিদেহী আত্মার শান্তির জন্যে আমরা প্রার্থনা করি। আমিন।

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে চারটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত পাঠক মহলে। গঠনমূলক ও ইতিবাচক লেখনীতে তিনি এক নতুন মাত্রা সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছেন।

 

 

কিউএনবি/মোহন/১৫.১১.২০২৫/রাত ১২.২৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

November 2025
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit