মনের ক্যানভাসে
———————-
মনে মনে প্রতিদিন হিসেব করি, আজ কত তারিখ? মাস শেষ হতে আর কয়দিন বাকী? বেতনের যে টাকা হাতে আছে বাকী দিন ঠিক মত চলবে তো? কিন্তু প্রতি মাসেই এমন সব ঝুট-ঝামেলা বাঁধে যে, হিসেবের বাইরেও নতুন করে আবার হিসেব করতে হয়। হয়তো দেখা যায় হঠাৎ করে নিকট আত্মিয় অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অনিবার্যভাবেই তার পিছনে টাকা খরচ করতে হচ্ছে কিংবা স্ত্রী- সন্তানের জন্য এমন সব খরচ করতে হচ্ছে যা হিসেবের মধ্যে ছিল না, অথবা নিজেই অসুস্থ, বাধ্যতামূলকভাবে ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে।
প্রতিমাসে এমন অনেক বাড়তি ঝামেলা অতিক্রম করে, হিসেবের বাইরেও খুটিনাটি হিসেব করে, পরিবারে কিছুটা কঠোরতা ও কিছুটা কিপ্টে হিসেবে পরিচিতি লাভ করে মাসটা পার করতে পেরে অনেকটা তৃপ্তির নিশ্বাস নেই। এভাবেই তো চলে যাচ্ছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
দিন, মাস ও বছর পার করার এরূপ তৃপ্তি-অতৃপ্তির নিশ্বাস নিতে নিতে কখন যে বয়সের একটা বিপদজনক সীমায় এসে পৌঁছে গেছি, তা টেরই পাইনি। এলাকায়, কর্মস্থলে, পরিচিত মহলে এই বয়সে অনেকেই তো চলে যাচ্ছে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, অজানার গন্তব্যে। এসব দেখে নিজের ভিতরেও একধরনের প্রস্তুতি তৈরী হয় আবশ্যিকভাবে। মনে মনে সব কিছু গুছানোর চেষ্টা করি। কাগজপত্র গুছাই, হিসাব-নিকাশ গুছাই, নমিনি ঠিক করি। কিন্তু গুছাবো বললেই তো আর গুছানো হয় না। কী করলে, কতটা কী কী গুছালে ঠিক গুছানো বলা যায়, তা-ই বুঝতে পারি না। শেষমেষ এই বলে মনকে প্রবোধ দেই যে, যেখানে যা আছে স্ত্রী সন্তানদের বুঝিয়ে দিলেই হল।
জীবনের পড়ন্ত বেলায় সময়ের চৌকাঠ পেরিয়ে স্মৃতির আঙিনায় কত ঘটনা- দুর্ঘটনা, আনন্দ -বেদনার ছবি ভেসে উঠে, যা এখনো তরতাজাই মনে হয়। শৈশবে দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে জামবুরা কিংবা খরের দলা পাকিয়ে ফুটবল খেলা। ঝুট বেঁধে পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে, ডুব দিয়ে চোখ লাল করে ফেলা, ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো, গভীর জঙ্গলে বেতফল টুকিয়ে গাছের ছায়ায় বসে আরামে আস্বাদ গ্রহণ, কৈশোরে যাত্রা- সিনেমার পাঠ মুখস্থ করে বন্ধুদের সামনে প্রদর্শন করা। ফুটবল, হাডুডু, গুটিবাড়ি, দাইড়া বান্ধা, লাফালাফি, দাপাদাপি, মারামারিসহ কত ঘটনায় ভরে আছে স্মৃতির পাতা!
ঝাকি পলো দিয়ে, জাল ফেলে, বড়শীতে গেঁথে মাছ ধরা, ঝিলে বিলে শাপলা শালুকের সাথে মিতালি, স্কুলের বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমীর সাতকাহন, স্কুল পালানো, কাঠফাটা রোদে বন্ধুদের সাথে হারিয়ে যাওয়া, এসব ঘটনা তো এখনো ঝকঝকে তকতকেই রয়ে গেছে। নতুন যৌবনে বুকের ভিতর রঙিন স্বপ্নের জাল বুনা, উতল হাওয়ায় ব্যাকুল মনে আকাশকুসুম প্রেমের গল্প তৈরি করা, জীবনকে গড়ে তোলার দুর্দান্ত নকশা এঁকে এলোপাথারি পরিকল্পনা করা, এ সবকিছুই প্রায় অবিকৃত রয়ে গেছে মনের আঙিনায়।
জীবনে স্বপ্নের জাল বুনা, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব এখনো এই বয়সে এসে শেষ হয়ে যায়নি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এর অস্তিত্ব থাকবে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া পাওয়া আছে বলেই হয়তো বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাই। স্বপ্ন দেখি, কাজে প্রেরণা পাই, ভিতরে কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। তবে ইদানিং কী পেলাম, কতটা পাচ্ছি, আর কী পাব, সে ভাবনাও অনিবার্যভাবে চিন্তার নদীতে এসে ভীড় করে।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই ভ্রমণে সুখ নামক পাখিটিকে ধরার জন্য মানুষ কত চেষ্টাই না করে! কিন্তু কতটা উদার কিংবা কঠোর হলে, ভালোবাসলে কিংবা ঘৃণা করলে অথবা প্রাচুর্যের অধিকারী হলে সুখী হওয়া যায়, তা কী নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে? সুখ আসলে কী? কোন উপাদান, কী পরিমাণ প্রাপ্তি হলে সুখ অর্জিত হয়, তাও নির্ধারণ করার কোনো মাপকাঠি নেই। তাই দেখা যায়, বিরাট চাকুরি করে কিংবা বিপুল প্রাচুর্যের মালিক হয়েও অনেকের কাছে এই সুখ নামক পাখিটি অধরাই রয়ে যায়।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটা মনে হয় তা হলো, জীবনে পরিপূর্ণ সুখ লাভ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এই যে অতৃপ্তি, অপূর্ণতা ও সুখী হওয়ার আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে কাজে উদ্দীপনা দিয়ে, বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়ে গতিশীল করে রাখে আজীবন। তাই জীবনের প্রতি ধাপেই সুখ ও আনন্দকে খুঁজে নিতে হয় নিজের মতো করে। মানবজীবনে সুখ ও আনন্দ লাভের অজস্র উপাদান থাকতে পারে। তবে অভিজ্ঞতা থেকে মোটা দাগে বলা যায়, দৈহিক ও মানসিক সুস্থতা, মানুষকে ভালোবাসা, কাজে-কর্মে নিযুক্ত থাকা, মানুষের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন, বর্তমান সময়কে কাজে লাগানো, স্বাভাবিক ও স্বচ্ছ জীবন যাপন, সৃষ্টিশীল ভাবনা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়া, ইতিবাচক ও হাসিখুশি মনোভাব নিয়ে চলা, সর্বোপরি যে যেখানে অবস্থান করে সেখান থেকে সুখ ও আনন্দকে খুঁজে নেওয়ার মধ্যে অনেকাংশেই সুখ নির্ভর করে। সবার জন্য শুভকামনা।
লেখকঃ মজিবর রহমান। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজ সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষাভবন, ঢাকা এর উপ প্রকল্প পরিচালক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক ছাত্র মজিবর রহমান বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের মাধ্যমে তাঁর কর্মময় জীবন শুরু করেন। সাহিত্য সংস্কৃতি সংগীত এর ধারক বাহক মজিবর রহমান বাঁশিতে অপূর্ব সুর সৃষ্টি করতে পারেন। তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে এই পোস্টটি সংগৃহিত।
কিউএনবি/বিপুল/ ৩০.০৫.২০২২ খ্রিস্টাব্দ/ বিকাল ৪.২৫