মঙ্গলবার, ০৫ অগাস্ট ২০২৫, ০২:০৭ পূর্বাহ্ন

ইসলামি ইতিহাসে উপাসনালয়: মসজিদ, গির্জা ও সহাবস্থানের সোনালী ঐতিহ্য

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫
  • ১২ Time View

ডেস্ক নিউজ : ইসলামি সভ্যতা ইতিহাসে ধর্মীয় সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছে। এই সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি শুধু কথায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বাস্তব প্রশাসন, আইন, নীতিমালা এবং জনজীবনের প্রতিটি পরতে পরতে প্রতিফলিত হয়েছে। 

তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে সুলায়মান ইবনে আব্বাস (মৃত্যু: ১৭৮ হিজরি) যখন মিসরের শাসক ছিলেন, তিনি ‘মারইয়ামের গির্জা’ ও ‘মুহাররাস কুসতানতিন’-এর বিভিন্ন গির্জা ভেঙে ফেলেন। কিন্তু পরে যখন তাকে অপসারণ করে মূসা ইবনে ঈসা ইবনে আব্বাস (মৃত্যু: ১৮৩ হিজরি) শাসক নিযুক্ত হন, তিনি খ্রিষ্টানদেরকে পুনরায় সেসব গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। 

অবাক করার বিষয় হলো, সেই গির্জাগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয় তখনকার দুই বিশিষ্ট মুসলিম আলিম—ইমাম লাইস ইবনে সা‘দ (মৃত্যু: ১৭৫ হিজরি) এবং ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে লাহিই‘আ (মৃত্যু: ১৭৪ হিজরি)-এর পরামর্শে।

তারা বলেন, “এটি তো দেশের উন্নয়নের অংশ।” তারা আরও যুক্তি দেন যে, মিসরের অনেক গির্জা সাহাবা ও তাবেয়ীনদের সময়েই ইসলামি শাসনে নির্মিত হয়েছিল।

ইসলামি সভ্যতায় ধর্মীয় বহুত্ববাদ ও উপাসনালয়ের মর্যাদা

ইমামদের মুখে উচ্চারিত “عمارة الأرض” (ভূমির উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজ)—এই শব্দটি ইসলামের এক চমৎকার মানবিক দর্শনের প্রতিফলন: ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে তা রক্ষা করা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। এটি এমন এক উদারতা, যা আধুনিক কালে জাতিসংঘের মৌলিক মানবাধিকারের ঘোষণাকেও অতিক্রম করে।

এই সহাবস্থানের প্রাথমিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর “উমরী চুক্তি”-তে, যেখানে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম)-এর খ্রিষ্টানদেরকে নিজেরা ও তাদের গির্জা ও ধর্মীয় নিদর্শনের জন্য নিরাপত্তা প্রদান করেন। এটি ছিল একটি সভ্যতা ভিত্তিক ঘোষণাপত্র, যা ভবিষ্যৎ মুসলিম শাসকদের জন্য একটি আদর্শ পথনির্দেশিকা হয়ে ওঠে।

ইতিহাসে টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপট

যদিও বাস্তবতা হলো—ইতিহাসজুড়ে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের মাঝে বহুবার সংঘাত হয়েছে, যা উপাসনালয় ও ধর্মীয় পরিকাঠামোর উপর প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকগণ বলেন—ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর প্রতি তার আচরণকে অন্য জাতিগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায় না।

উদাহরণস্বরূপ, প্রথম ক্রুসেডের সময়কার ফরাসি যাজক “ফুচে আল-শারতেরী” তার গ্রন্থ তরীখুল হামলাতি ইলা কুদ্স এ উল্লেখ করেন, পোপ আরবান (মৃত্যু: ৪৯২ হিজরি) তার অনুসারীদের যুদ্ধের আহ্বানে বলেন: “হে আল্লাহর সন্তানগণ! তোমরা শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছো, তাহলে এবার এগিয়ে যাও! তোমাদের উচিত পূর্বের ভাইদেরকে সাহায্য করা।… যদি এই নিকৃষ্ট জনগণ বিজয়ী হয়, তাহলে এটি হবে আমাদের জন্য লজ্জা ও অপমান।”

এই উত্তেজনামূলক আহ্বান ও নৃশংসতা যা ক্রুসেডে প্রকাশ পেয়েছিল তা ইসলামি চুক্তিনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামি শাসকেরা যুদ্ধাবস্থায়ও চুক্তি রক্ষা করতেন এবং ধর্মীয় স্থাপনার মর্যাদা বজায় রাখতেন।

ইসলামি ফিকহে উপাসনালয় পরিবর্তন সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি

একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হলো, তামীমি গোত্রের প্রতিনিধি দল যখন রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট আসেন এবং জানান যে তাদের অঞ্চলে একটি পুরাতন গির্জা আছে, তখন নবী সা. বলেন: “তোমরা ফিরে গিয়ে তোমাদের গির্জা ভেঙে ফেলো এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করো।”

(সুনানে নাসায়ী, হাদিস: ৭০০)

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী (রহ.) বলেন: এটি প্রমাণ করে যে, গির্জা বা উপাসনালয়কে মসজিদে রূপান্তর করা বৈধ, বিশেষত যদি তা মুসলিম অধিকৃত এলাকায় হয়।

তবে ফকীহগণ দ্ব্যর্থহীনভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, এর অনুমতি নির্ভর করে দেশটি কীভাবে মুসলিম অধিকারে এসেছে তার উপর—

যদি যুদ্ধ করে (فتح عنوة) দখল করা হয়, তবে মুসলিমরা ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে।

যদি শান্তিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে (فتح صلحا) আসে, তাহলে সেই চুক্তির শর্তানুযায়ী উপাসনালয়ের সম্মান রক্ষা করতে হবে।

কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি

আল্লাহ তাআলা বলেন: যদি আল্লাহ মানুষদের একে অপরের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে নিশ্চয় ধ্বংস হয়ে যেত গির্জা, উপাসনালয়, প্রার্থনাস্থল এবং মসজিদসমূহ—যেখানে আল্লাহর নাম প্রচুর স্মরণ করা হয়। (সূরা হজ্জ: ৪০)

তাফসিরে রাজি-তে উল্লেখ আছে—এই আয়াতে “আল্লাহর রক্ষাকর্ম” শুধু মুসলমানদের নয়, বরং সকল ধর্মবিশ্বাসীদের জন্য। কারণ ইসলাম চায় না যে মুশরিকরা দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে ধর্মবিশ্বাসীদের উপাসনালয় ধ্বংস করুক।

ইমাম রশীদ রিযা (রহ.) বলেন, “এই আয়াত ইসলামে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তার এক সর্বজনীন নীতিমালা স্থাপন করেছে, যা মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবে মেনে চলেছে।”

সমকালীন প্রেক্ষাপটে পুনর্মূল্যায়ন

 আজ যখন ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজা ভূখণ্ডের ৩৩৫টি মসজিদ ও গির্জা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়েছে (ফিলিস্তিনি সরকারি তথ্য, ১ জানুয়ারি ২০২৪), তখন ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলোর দিকে ফিরে তাকানো সময়ের দাবি।

এই প্রবন্ধটি সেই অতীত ঐতিহ্য ও ফিকহি ভিত্তিকে সামনে রেখে সমকালীন “আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” ও “ধর্মীয় সহাবস্থান”-এর নতুন ব্যাখ্যা হাজির করার চেষ্টা করে। ইসলাম যেভাবে ন্যায়বিচার, সহনশীলতা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে, তার তুলনা আজও বিরল।

ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ইসলামি ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় সহাবস্থান

ইসলামি চুক্তিনীতির বাস্তব প্রয়োগ

 ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসে মুসলমানদের ন্যায়বিচার ও চুক্তির প্রতি নিষ্ঠার বাস্তব উদাহরণ বহু রয়েছে। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এবং বীর সেনাপতি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.)-এর সেই বিখ্যাত চুক্তিপত্রে, যা তারা সিরিয়ার অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পাদন করেছিলেন।

ইতিহাসবিদ ইমাম তাবারী (মৃ. ৩১০ হিজরি) তার ‘তারীখ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যখন হযরত উমর (রা.) বাইতুল মুকাদ্দাসের (জেরুজালেম) অধিবাসীদের সঙ্গে চুক্তি করেন, তখন তিনি তাদেরকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা প্রদান করেন:

“তাদের জীবন, সম্পদ, গির্জা, ক্রুশ, অসুস্থ ও সুস্থ ব্যক্তি, এবং তাদের ধর্ম—সব কিছুর নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তাদের গির্জাগুলো দখল করা হবে না, ধ্বংস করা হবে না, সেগুলোর পরিধি সংকুচিত করা হবে না, তাদের ক্রুশ কিংবা সম্পদের কোনো ক্ষতি করা হবে না, তাদেরকে ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হবে না, এবং কোনোভাবেই নির্যাতন বা বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। শুধু তাই নয়, ইলিয়াতে (জেরুজালেমে) ইহুদিদেরকে বসবাস করতে দেওয়া হবে না।”

এছাড়াও, ইমাম ইবনু আসাকির (মৃ. ৫৭১ হিজরি) তার তারীখে দিমাশক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাঃ) দিমাশকের (দামেস্ক) খ্রিস্টানদের জন্য এ ঘোষণা দেন:

❖  “আমি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ, দিমাশকের খ্রিস্টানদের রক্ত, সম্পদ ও গির্জাগুলোর নিরাপত্তা দিচ্ছি।”

ধারাবাহিকতা: উমর ইবনু আব্দুল আজীযের নীতি

এই মানবিক নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন খলিফা উমর ইবনু আব্দুল আজীয (মৃত্যু ১০১ হিজরি)। ইমাম ইবনু আবি শায়বা (মৃত্যু ২৩৫ হিজরি/৮৪৯ ইংরেজি) আল-মুসান্নাফ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, খলিফা উমর তার এক গভর্নরকে নির্দেশ দেন:

● “যেসব উপাসনালয় (গির্জা, উপাসনাগার, অগ্নিপূজকদের মন্দির) শান্তিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে তাদের কাছে রয়ে গেছে, সেগুলো ধ্বংস করা যাবে না।”

তিনি এই মতের বাস্তব প্রয়োগ করেনও। ইমাম কাসিম ইবনু সাল্লাম (২২৪ হিজরি/৮৩৮ ইংরেজি) তার কিতাবুল আমওয়াল-এ উল্লেখ করেছেন যে, আলী ইবনু আবু হিমলা (১৫৬ হিজরি/৭৭৩ ইংরেজি) বলেন:

●  “দামেশকের এক গির্জা নিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে স্থানীয় অ-মুসলিমরা বিরোধে জড়ালে, খলিফা উমর ইবনু আব্দুল আজীয আমাদের সেখান থেকে বের করে দেন এবং গির্জাটি খ্রিস্টানদের কাছে ফিরিয়ে দেন।”

পরবর্তীতে খলিফা ইয়াজিদ ইবনু আব্দুল মালিক (মৃ. ১০৫ হিজরি/৭২৪ ইংরেজি) পুনরায় সেটি মুসলমানদের কাছে ফিরিয়ে দেন।

এই ঘটনার ব্যাখ্যায় ইমাম কাসিম বলেন: উমর ইবনু আব্দুল আজীয কেবল চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই গির্জাগুলো ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝেছিলেন যে, এসব গির্জা শান্তিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে অধিবাসীদের অধীনে রয়েছে; তাই মুসলমানদের সেখানে কোনো মালিকানা দাবি নেই।

মসজিদ-গির্জার সহাবস্থান: উমাইয়া মসজিদের ইতিহাস

ইবনু কাসীর (মৃ. ৭৭৪ হিজরি/১৩৭৩ ইংরেজি) দিমাশকের বিখ্যাত উমাইয়া মসজিদ-এর নির্মাণ ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে মুসলিম-খ্রিস্টান সহাবস্থানের এক চমৎকার ছবি উপস্থাপন করেছেন।

তিনি লিখেছেন, যখন মুসলমানরা হিজরি ১৪ সালে (৬৩৬ ইংরেজি) দিমাশক বিজয় করেন, তখন সেখানে ১৪টি গির্জার অস্তিত্ব স্বীকৃত ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল খ্রিস্টানদের সেন্ট জন ব্যাপটিস্ট গির্জা (كنيسة مار يوحنا المعمدان), যার অর্ধেক মুসলমানরা গ্রহণ করেন এবং অন্য অর্ধেক খ্রিস্টানদের কাছে থেকে যায়।

এই স্থাপনা পরে দ্বৈতভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে:

 “একই দরজা দিয়ে মুসলিম ও খ্রিস্টানরা প্রবেশ করতেন। খ্রিস্টানরা পশ্চিম দিকে গির্জায় যেতেন, আর মুসলমানরা দক্ষিণ দিকে মসজিদ অংশে নামাজ পড়তেন।”

এই ব্যবস্থাপনা প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে।

সমঝোতা ও সম্মান বজায় রেখে পরিবর্তন

হিজরি ৮৬ সালে খিলাফতে আসেন ওমরীয় বংশধর খলিফা ওয়ালিদ ইবনু আব্দুল মালিক (মৃ. ৯৬ হিজরি/৭১৫ ইংরেজি)। তিনি মসজিদ সম্প্রসারণের প্রয়োজন অনুভব করেন এবং পুরো গির্জাকে মসজিদে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি।

বরং তিনি খ্রিস্টানদের ডেকে চুক্তির শর্ত পড়িয়ে শোনান এবং তাদের কাছে বিকল্প জমি ও চারটি গির্জা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। খ্রিস্টানরা প্রথমে অস্বীকার করলেও, পরে একটি বড় গির্জা (كنيسة توما) ছেড়ে দেওয়ার বদলে সেন্ট জন গির্জাটি মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিতে সম্মত হন। ফলে শান্তিপূর্ণ সমঝোতার ভিত্তিতে পুরো স্থানটি মসজিদে পরিণত হয়, যা আজও “উমাইয়া মসজিদ” নামে বিশ্বজুড়ে খ্যাত।

আন্দালুসিয়ায় একই অনুকরণ

এই ন্যায়নীতির প্রভাব অদূর আন্দালুস পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ইবনু আযারি আল-মারাকুশী (মৃ. ৭১২ হিজরি/১৩১২ ইংরেজি) তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-বাইয়ান আল-মুগরিব এ উল্লেখ করেন যে, মুসলমানরা আন্দালুস বিজয়ের পর দামেশকের মডেল অনুসরণ করেন।

তারা কর্ডোবার বৃহৎ গির্জার অর্ধেক অংশ গ্রহণ করে তাতে মসজিদ নির্মাণ করেন এবং অপর অর্ধেক খ্রিস্টানদের নিকটেই থাকে।

পরে যখন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং মসজিদ স্থান সংকুলান করতে ব্যর্থ হয়, তখন উমাইয়া শাসক আব্দুর রহমান আদ-দাখিল (মৃ. ১৭২ হিজরি/৭৮৮ ইংরেজি) খ্রিস্টানদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তিনি গির্জার বাকি অংশের জন্য মূল্য পরিশোধ করে সেটি মসজিদে পরিণত করেন এবং একই সাথে শহরের বাইরে খ্রিস্টানদেরকে নতুন গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন।

ইসলামি ভূমিতে গির্জার পুনর্নির্মাণ ও ক্ষতিপূরণ

শুধু দখল নয়, বরং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মুসলিম শাসকেরা কখনও কখনও গির্জা ভেঙে ফেললে তার ক্ষতিপূরণও দিতেন। 

তাকীউদ্দীন আল-মাকরীযী (মৃ. ৮৪৫ হিজরি/১৪৪২ ইংরেজি) আল-মাওয়ায়িজ ওয়াল-ই‘তিবার গ্রন্থে উল্লেখ করেন:

 “মুসলিম যুগে কায়রোর খনদাক অঞ্চলে নির্মিত দুটি গির্জা পূর্ববর্তী সময়ের ধ্বংসপ্রাপ্ত গির্জাগুলোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল।”

এই দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায়, ইসলামি শাসন শুধু দখলের রাজনীতি করেনি—বরং ন্যায্যতা, দায়িত্ববোধ এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের এক পরিশীলিত মানদণ্ড স্থাপন করেছিল।

ইতিহাসের দলিল: গির্জা সংরক্ষণ ও সহাবস্থান

বালাযুরী (মৃ. ২৭৯ হিজরি/৮৯২ ইংরেজি) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ফুতূহুল বুলদান-এ লাতাকিয়ার (সিরিয়া) প্রসঙ্গে বলেন:

 “যখন মুসলিম সেনারা শহর বিজয় করেন, তখন অনেক খ্রিস্টান শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে তারা নিরাপত্তা চেয়ে ফিরে আসলে, তাদের গির্জা ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং সাহাবি উবাদা ইবনুস সামিত (রা.)-এর আদেশে মুসলিমদের জন্য একটি জামে মসজিদ নির্মিত হয়।”

একই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন যে, সাহাবি আম্মার ইবনু ইয়াসির (রা.) যখন কুফার গভর্নর ছিলেন, তিনি হিত নামক অঞ্চলের খ্রিস্টানদের সঙ্গে চুক্তি করেন, যাতে গির্জার অর্ধেক মুসলমানদের জন্য এবং অর্ধেক খ্রিস্টানদের জন্য নির্ধারিত হয়।

উসমানীয় নিদর্শন: মসজিদে রূপান্তরিত একটি প্রতীকী গির্জার ইতিহাস

ইসলামি ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত যে গির্জাগুলো মুসলমানরা মসজিদে রূপান্তর করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আয়া সোফিয়া। এই স্থাপনাটি মুসলমান ও খ্রিস্টান—উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই এক প্রতীকী ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।

 খ্রিস্টানদের কাছে এর গুরুত্ব এমন যে, ভ্রমণকারী আবুল হাসান আল-হরভী (মৃ. ৬১১ হিজরি/১২১৪ ইংরেজি) তার ‘ইশারাত ইলা মা‘রিফাতি যিয়ারাত’ গ্রন্থে বলেন:

● এটি তাদের সবচেয়ে বড় গির্জা, তারা বলে: এতে এক ফেরেশতা বাস করে!

সমসাময়িক সময়ে ইতিহাসবিদ উইল ডিউরান্ট এটিকে বলেন: খ্রিস্টান বিশ্বের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ধর্মীয় তীর্থস্থান!

তিনি আরো বলেন, আয়া সোফিয়া অবস্থিত কনস্টান্টিনোপল ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী এবং এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি এশিয়ার আগ্রাসন থেকে ইউরোপকে রক্ষা করার দুর্গ ছিল।

মুসলমানদের কাছে আয়া সোফিয়ার গুরুত্ব মূলত এই কারণে যে, এটি সেই শহরের অন্তর্ভুক্ত, যার ফাতেহ (জয়কারী) হওয়ার সুসংবাদ রাসুলুল্লাহ সা. দিয়েছেন। 

সহিহ বুখারিতে এসেছে: “আমার উম্মতের প্রথম সেনাদল যারা কায়সারের নগরীতে আক্রমণ করবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত।”

এখানে “কায়সারের নগরী” বলতে বোঝানো হয়েছে কনস্টান্টিনোপল।

আর এক হাদিসে (মুসনাদে আহমদ ও মুস্তাদরাকে হাকিম):

★  “অবশ্যই কনস্টান্টিনোপল বিজিত হবে। সেই আমির কত উত্তম, এবং সেই বাহিনী কতই না উত্তম বাহিনী!”

এই নবি(সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল মুসলমানদের বহুবার এই শহর বিজয়ের চেষ্টার অনুপ্রেরণা। মোহাম্মদ ফারিদ পাশা (মৃ. ১৩৩৮ হিজরি) তার ‘তারিখুদ দাওলাহ আল-উস্মানিয়্যাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন: মুসলমানরা কনস্টান্টিনোপল ১১ বার অবরোধ করেছে, যার মধ্যে সাতটি ছিল ইসলামের প্রথম দুই শতাব্দীতে।

শেষ পর্যন্ত ৮৫৭ হিজরি/১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে উসমানী সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতেহ শহরটি বিজয় করেন এবং এই বিজয়ের কারণে “আল-ফাতেহ” উপাধি লাভ করেন।

বিজয়ের পরের আচরণ

যদিও এই বিজয় ছিল অস্ত্রের মাধ্যমে, তবে মুহাম্মদ আল-ফাতেহ বিজয় পরবর্তী আচরণে ছিলেন এক বিরল উদাহরণ। তিনি খ্রিস্টানদের উপাসনালয় নিশ্চিহ্ন করেননি, বরং তাদের অধিকারের নিরাপত্তা দেন। 

আয়া সোফিয়ায় প্রবেশ করে সেখানে আজান দেওয়ার নির্দেশ দেন, যাতে এটি মুসলমানদের জামে মসজিদে রূপান্তরিত হয়। এরপর তিনি খ্রিস্টানদেরকে আশ্বস্ত করেন যে, তাদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা বজায় থাকবে এবং তাদের সম্পত্তি নিরাপদ থাকবে।

তিনি খ্রিস্টানদের জন্য একটি গীর্জা নির্বাচন ব্যবস্থা (নির্বাচনের মাধ্যমে ধর্মগুরু নিয়োগ) পরিচালনা করেন। নির্বাচনে জর্জ স্কলারিয়াস নির্বাচিত হন এবং সুলতান তাকে পূর্ব খ্রিস্টান রোমান বাদশাহদের রীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত করেন। এমনকি তাকে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা ও ধর্মীয়-বিচারিক ক্ষমতাও প্রদান করেন।

তুলনার জন্য উল্লেখযোগ্য, চতুর্থ ক্রুসেডে (৬০০–৬০৪ হিজরি/১২০২–১২০৪ ইংরেজি) খ্রিস্টান সেনারা আয়া সোফিয়া লুটপাট ও অপবিত্র করেছিল। সুতরাং ফাতেহের আচরণ এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ।

ঘৃণার প্ররোচনা: যুদ্ধের নামে ধর্মীয় নিপীড়ন

ক্রুসেড ছিল একটি ধর্মভিত্তিক যুদ্ধ—ইসলামের প্রতি ঘৃণা ও শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ। পোপ ও যাজকদের নির্দেশে খ্রিস্টান যোদ্ধারা ইসলামি নিদর্শন ও ধর্মীয় চিহ্ন ধ্বংসে তৎপর ছিল। তারা মসজিদগুলোকে গির্জায় পরিণত করে।

৪৯২ হিজরি/১০৯৯ ইংরেজি জেরুজালেম দখলের পর প্রথম কাজ ছিল কুব্বাতুস সাখরা (পাথরের গম্বুজ) মসজিদকে গির্জায় রূপান্তর।

৬১৬ হি./১২১৯ ইংরেজি ডামিয়াত (মিশর) দখলের পর মসজিদকে গির্জায় পরিণত করা হয়।

আন্দালুসি ভ্রমণকারী ইবন জুবাইর ৫৮০ হিজরি/১১৮৪ ইংরেজি আক্কা সফরে গিয়ে বলেন:

“এর মসজিদগুলো গির্জায় রূপান্তর হয়েছে, মিনারগুলোতে ঘণ্টা বাজে, যা একসময় আজান দিত।”

তবে তিন বছর পর (৫৮৩ হিজরি) সালাহউদ্দিন আইউবি আক্কা পুনরুদ্ধার করে মসজিদে জুমার নামাজ চালু করেন।

মিশর ও শামের মসজিদগুলো ফের মুসলমানদের দখলে এলেও, আন্দালুস ও সিসিলির (ইতালির একটি দ্বীপ) হাজার হাজার মসজিদ মুছে ফেলা হয়—অধিকাংশই গির্জায় পরিণত হয়।

ভ্রমণকারী ইবন হাওকল ৩৬২ হিজরি/৯৭৩ ইংরেজি সিসিলিতে একটি শহরে বিশাল মসজিদের বর্ণনা দেন—যেখানে ৭০০০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতেন।

কিন্তু দুই শতাব্দী পরে ইবন জুবাইর সেই জায়গায় যান এবং দুঃখ করে বলেন:

“সেখানে মুসলমানদের অবস্থা করুণ; তাদের ধর্মীয় নিদর্শনগুলো লোপাট হয়েছে, মসজিদগুলো গির্জায় রূপান্তরিত হয়েছে।”

এক ভণ্ড মুসলমান—ইবন জারআ—একটি মসজিদকে গির্জায় রূপান্তর করেন এবং খ্রিস্টানদের অনুসরণ শুরু করেন। তবে জানা যায়, তিনি অন্তরে মুসলিমই ছিলেন। 

তার এই অবস্থা কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা: “যে ব্যক্তি বাধ্য হয়ে (ইমান অস্বীকার করে), অথচ তার অন্তর ইমানে শান্ত, সে ব্যতিক্রম।”

 (সূরা নাহল: ১০৬)

ক্রমবর্ধমান “গির্জায় রূপান্তর”: আন্দালুসে ইসলামি নিদর্শন মুছে ফেলার ইতিহাস

সিসিলির মসজিদ ও বিস্মিত পর্যবেক্ষণ

ভ্রমণকারী ও ভূগোলবিদ ইবন হাওকল বিস্ময় প্রকাশ করেন সিসিলির মতো ছোট দ্বীপে থাকা বিপুলসংখ্যক মসজিদের প্রতি। 

তিনি বলেন, “সিসিলিতে তিন শতাধিক মসজিদ রয়েছে—যা বিশেষজ্ঞরা একমত হয়ে গণনা করেছেন। আমি কোনো শহরে বা অঞ্চলে এই পরিমাণ মসজিদ দেখিনি, এমনকি কর্ডোবাতেও না, যদিও কর্ডোবাবাসীরা দাবি করে তাদের শহরে ৫০০ মসজিদ আছে। তবে সেখানকার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারিনি, কিন্তু সিসিলিরটি আমি নিজে দেখেছি।”

আন্দালুসে মসজিদের প্রকৃত সংখ্যা

পরবর্তীকালে আন্দালুসি ঐতিহাসিক আহমদ আল-মাক্কারি (মৃ. ১০৪১ হিজরি/১৬৩২ ইংরেজি) তার বিখ্যাত গ্রন্থ “নাফহুত তীব”-এ আন্দালুসের গির্জাগুলোর পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করেন। তিনি বলেন:

“আবদুর রহমান আদ-দাখিলের (খিলাফত ১৩৮–১৭২ হিজরি/৭৫৫–৭৮৮ ইংরেজি) সময় কর্ডোবায় মসজিদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯০-এ, পরবর্তীতে তা আরও বৃদ্ধি পায়। আল-মুরাবিত ও আল-মুয়াহহিদ আমলে মসজিদের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩৮৩৭টি।”

এই বিপুল সংখ্যক মসজিদ পরবর্তীতে গির্জা কিংবা ঘোড়ার اصطبل (অশ্বশালায়) রূপান্তরিত হয়।

 “পুনরুদ্ধার যুদ্ধ” ও গির্জা-রূপান্তরের পরিকল্পনা

স্প্যানিশ খ্রিস্টানদের তথাকথিত “আন্দালুস পুনরুদ্ধার যুদ্ধ” শুরু হয় তোলে-দো (طليطلة) নগরী থেকে।

 এটি ছিল মুসলমানদের হাতছাড়া হওয়া প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নগর। ইবন আল-খাতিব (মৃ. ৭৭৬ হিজরি/১৩৭৪ ইংরেজি) বর্ণনা করেন:

“খ্রিস্টান রাজা আলফনসো ষষ্ঠ যখন ৪৭৮ হিজরিতে (১০৮৫ ইংরেজি) তোলেদো দখল করলেন, তিনি সাধারণ জনতাকে খ্রিস্টান ধর্মে উদ্বুদ্ধ করলেন এবং ৪৯৬ হিজরি/১১০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান জামে মসজিদটি গির্জায় পরিণত করেন।”

মসজিদ রূপান্তর: পরস্পর নকশা

মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আনন, আন্দালুসি ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ, লিখেছেন—আন্দালুসের প্রতিটি শহর দখলের সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে থাকা মসজিদ গির্জায় রূপান্তরিত করা হতো। উদাহরণস্বরূপ:

I. লিসবন (542 হিজরি/1147 ইংরেজি): মুসলমানদের প্রধান মসজিদ গির্জায় পরিণত হয়।

II. কুয়েনকা (573 হিজরি/1177 ইংরেজি): মুসলমানদের হস্তান্তরের পরপরই মসজিদ গির্জায় রূপান্তর।

III. হিসন কাবালা (623 হিজরি/1226 ইংরেজি): শান্তিপূর্ণ চুক্তি সত্ত্বেও মসজিদ দখল করে গির্জা বানানো হয়।

কর্ডোবার জামে মসজিদের করুণ পরিণতি

৬৩৩ হিজরি/১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে যখন কাস্টিলের সৈন্যরা কর্ডোবা দখল করে, তারা মসজিদের মিনার থেকে ইসলামি প্রতীক সরিয়ে ক্রুশ টানিয়ে দেয়। এরপর বিশপ এসে মসজিদটিকে গির্জায় পরিণত করেন এবং পরদিন রাজা ফার্নান্দো তৃতীয় শহরে প্রবেশ করে, বিশপের নেতৃত্বে সেখানে ধন্যবাদসূচক প্রার্থনা (mass) অনুষ্ঠিত হয়।

পরবর্তীতে ৬৪৩ হিজরি/১২৬৫ ইংরেজি কাস্টিল বাহিনী জায়েন শহর দখল করে এবং তার প্রধান মসজিদও গির্জায় রূপান্তরিত করে, যেখানে রাজা নিজে গিয়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

পশ্চিমা ইতিহাসের স্বীকৃতি

 পশ্চিমা ইতিহাসবিদ উইল ডিউরান্ট ‘Story of Civilization’ গ্রন্থে জানান—আবদুর রহমান প্রথম খ্রিস্টানদের কাছ থেকে কর্ডোবার একটি গির্জার জমি কিনে সেখানে নীল মসজিদ নির্মাণ করেন। কিন্তু ১২৩৮ সালে স্পেন খ্রিস্টানদের দখলে এলে, ঐ মসজিদটি পুনরায় গির্জায় রূপান্তরিত হয়।

তিনি বলেন: “এভাবেই ধর্মীয় সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও সত্যের মানদণ্ড যুদ্ধের ভাগ্য পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়!”

ডিউরান্ট আরও জানান: সেভিয়া’র বিখ্যাত মসজিদ (নির্মিত ৫৬৭ হিজরি/১১৭১ ইংরেজি) ৬৩২ হিজরি/১২৩৫ ইংরেজি সালে গির্জায় পরিণত হয়।

পরে ৮০৪ হিজরি/১৪০১ ইংরেজি সালে সেটি ভেঙে ফেলে সেভিয়া ক্যাথেড্রাল নির্মাণ করা হয়, যেখানে মসজিদের ইট-পাথরও ব্যবহার করা হয়।

শোকগাথা ও আন্দালুসি কাব্য

আহমদ আল-মাক্কারি বলেন: “আন্দালুসে খ্রিস্টানদের আধিপত্যের পর কবিতা ও গদ্যে মসজিদ হারানোর দুঃখে রাজা ও সাধারণকে জাগ্রত করার চেষ্টা চলেছে, কিন্তু কোন লাভ হয়নি।”

এই অবস্থার প্রতিফলন আমরা পাই “মদিনা বিলাপ” (مراثي المدن) নামে পরিচিত কাব্যধারায়।

 উদাহরণস্বরূপ:

 অজ্ঞাত কবির কবিতা:

 কীভাবে হাসবে তোমার ঠোঁট,

যখন তোলেদোর সীমান্তই শত্রুর হাতে বন্দী?

মসজিদগুলো গির্জা হয়ে গেছে!

এমন হৃদয় কোথায়, যে শান্ত থাকবে—আর উড়ে যাবে না বেদনায়?

ইবনুল আব্বার (মৃ. ৬৫৮ হিজরি) বলেন: শিরক হাসিমুখে শহরে প্রবেশ করেছে, আর ঈমান কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়েছে।মসজিদ এখন গির্জা, আজান রূপ নিয়েছে ঘণ্টাধ্বনিতে! যেখানে তিলাওয়াত হতো, সেখানে এখন নীরবতা—শুধু কান্না!

আবুল বাক্বা রুন্দি (মৃ. ৬৮৪ হিজরি)-র বিখ্যাত বিলাপ:

ধর্মীয় নিদর্শন—সাদা ইসলাম—কাঁদছে,

ভালোবাসার সঙ্গীকে হারিয়ে কেউ যেমন কাঁদে।

মসজিদগুলো এখন গির্জা—

সেখানে ঘণ্টাধ্বনি ও ক্রুশ ছাড়া কিছুই নেই।

এমনকি মিনবার আর মিহরাবও কাঁদছে নীরবে!

শোকগাথা পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়ে

“মদিনা বিলাপ”-এর ধারা কেবল আন্দালুসে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সালাহউদ্দিন আইউবির সময়ে রামলার সন্ধি (৫৮৮ হিজরি) উপলক্ষে ইবনুস সাআতি লেখেন:

ইংরেজ রাজা রিচার্ডের হৃদয় কেঁপে উঠেছিল সালাহউদ্দিনের সাহসিকতায়।

যদি না থাকতেন সালাহউদ্দিন, তাহলে কাবা পর্যন্ত পৌঁছে যেত শত্রুরা!

জেরুজালেম আবার কাঁদল, কারণ সেখানে ঘণ্টা বাজতে লাগলো!

শায়ের শারফুদ্দিন ইবনু উনাইন (মৃ. ৬৩০ হিজরি) বলেন—ডামিয়াত দখলের পর:

ডামিয়াতের মসজিদগুলো এখন গির্জা,

যেখানে এক সময় আজান উঠত,

সেখানে আজ ক্রুশ পূজিত হয়!

ইসলামি ইতিহাসে ধর্মীয় সহনশীলতা ও গির্জা-মসজিদের রূপান্তরের একচিত্র

সিরিয়ান ইতিহাসবিদ আল্লামা মুহাম্মদ কুর্দ আলী (মৃ. ১৩৭২ হিজরি) তার বিখ্যাত গ্রন্থ খিতাত ash-Shām-এ উল্লেখ করেন যে, আহলে কিতাবদের উপাসনালয় সম্পর্কিত ইসলামের সহনশীলতা কেবল খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়েই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং উমাইয়া ও আব্বাসীয় অনেক খলিফাও সেই পথ অনুসরণ করেন। 

তিনি ইবন আসাকির থেকে উদ্ধৃত করেন, আবু জাফর মানসুর (মৃ. ১৫৮ হিজরি) দামেস্কে ‘আল-জাওরা’ এলাকায় খ্রিস্টানদের জন্য একটি গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন।

তার নাতি খলিফা মামুন (মৃ. ২১৮ হিজরি)-ও একই ধারা অব্যাহত রাখেন। ইমাদুদ্দীন আল-ইসফাহানী (মৃ. ৫৯৭ হিজরি) আল-বুস্তান আল-জামি’-তে বর্ণনা করেন, খলিফা মামুন ২১৬ হিজরি সালে মিসরে সফরের সময় তার খ্রিস্টান কর্মচারীরা একটি গির্জা নির্মাণের অনুরোধ করলে তিনি অনুমতি দেন এবং তারা ‘কানিসাত আল-কানাতির’ নামে গির্জাটি নির্মাণ করেন।

কুর্দ আলী উল্লেখ করেন, যখন আহমদ ইবন তুলুনের আমলে (মৃ. ২৭০ হিজরি) দামেস্কের মারিয়াম গির্জায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তখন তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য সত্তর হাজার দিনার (আজকের হিসেবে প্রায় ১.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দ করেন।

ইবনে কাছীর তার আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-তে দামেস্কে মুসলিম বিজয়ের পর দুটি গির্জা মসজিদে রূপান্তরের ঘটনা উল্লেখ করেন। 

অন্যদিকে, ইসফাহানী বর্ণনা করেন, ৩০৯ হিজরি/৯২২ ইংরেজি সালে মুসলমানরা যখন ফিলিস্তিনের রাম্লায় কিছু গির্জা ভেঙে ফেলে, তখন খ্রিস্টানরা খলিফা মুকতাদিরের (মৃ. ৩২০ হিজরি) কাছে অভিযোগ করলে তিনি গির্জাগুলো পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন।

আল-মাকরিজি তার আল-মাওইযাহ ওয়াল ই’তিবার গ্রন্থে মিসরের খ্রিস্টান গির্জা নিয়ে তখনকার তাবেয়ীনদের মাঝে চলমান বিতর্কের বর্ণনা দেন। লায়স ইবন সা’দ ও ইবন লাহিয়াআর মতানুসারে, এই গির্জাগুলো ইসলামিক আমলেই নির্মিত হয়, এবং তারা এটিকে ‘দেশের উন্নয়নের অঙ্গ’ বলে অভিহিত করেন। এমনকি কায়রোর ইহুদি উপাসনালয়গুলোও ইসলামি যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মাকরিজি উল্লেখ করেন।

একটি দারুণ উদাহরণ দিয়েছেন আল-আলিমী তার আল-উনস আল-জালীল গ্রন্থে, যা ‘ইহুদিদের গির্জা মামলা’ নামে পরিচিত। দশম হিজরি শতকে (১৬শ শতক ইংরেজি) জেরুজালেমের হারা আল-ইহুদ এলাকায় একটি মসজিদ ছিল, যার পাশেই ছিল ইহুদি উপাসনালয়। 

পাশের একটি ভবন ধসে পড়লে মুসলমানরা তা দখল করতে চায়, কিন্তু ইহুদিরা আদালতে যায় এবং দলিল দেখিয়ে নিজেদের অধিকারের পক্ষে রায় আদায় করে। অবশেষে শাফিয়ি মাজহাবের একজন বিচারক একটি মধ্যপন্থী রায় দেন: 

“আমি তাদের হাত থেকে সম্পত্তি কেড়ে নেইনি, শুধু এটিকে গির্জা বানানোর অনুমতি দেইনি। তারা এটিকে দোকান হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।”

অন্যধারার রূপান্তর: মসজিদে রূপান্তরিত গির্জাগুলোর ইতিহাস

অন্যদিকে, পশ্চিমা ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্ট Story of Civilization-এ ক্রুসেড যুদ্ধের পর ইসলামি দুনিয়ায় খ্রিস্টানদের প্রতি সহনশীলতার প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ার দিকে ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, ক্রুসেডারদের বারবার আক্রমণের কারণে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আর আগের মতো সহনশীল থাকেনি এবং অবশেষে খ্রিস্টানরা ফিলিস্তিন-শামের কোনো শহর ধরে রাখতে পারেনি। তাঁর মতে,

 “ইসলামি সভ্যতা খ্রিস্টীয় সভ্যতার তুলনায় অনেক বেশি কোমল, শিক্ষিত ও পরিশীলিত।”

এই সত্যই বুঝিয়ে দেয় যে, একপাক্ষিকভাবে ইতিহাসকে দেখা ভুল; কারণ মুসলমানরা যখন দেখতে পায় তাদের ধর্মীয় স্থানগুলো লুণ্ঠন করা হচ্ছে, তখন জনসাধারণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। 

এর এক করুণ উদাহরণ পাওয়া যায় ৭২১ হিজরি/১৩২১ ইংরেজি সালে মিসরে ঘটে যাওয়া “হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা” থেকে, যেখানে বেশ কিছু গির্জা ও মসজিদ আক্রান্ত হয়। আল-মাকরিজি বলেন, সাধারণ জনগণ নিজেরাই গির্জা ভাঙে, যদিও সুলতান কোনো নির্দেশ দেননি। এর এক মাসের মধ্যে প্রতিশোধস্বরূপ খ্রিস্টানরাও বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগিয়ে দেয়, যাতে ক্ষতি হয় আরও বেশি।

তবে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান সাধারণ ধর্মীয় সহনশীলতাকে নস্যাৎ করে না। অধিকাংশ সময়ই মুসলিম শাসকরা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করেছেন। কোনো গির্জা বা উপাসনালয়কে মসজিদে রূপান্তরের ঘটনা ঘটলেও তা সাধারণত স্থানীয় রাজনৈতিক বা কৌশলগত প্রয়োজনেই ঘটেছে।

উদাহরণস্বরূপ:

হামা নগরীতে (সিরিয়া), মুসলমানরা রোমানদের সঙ্গে সন্ধি করার পর তাদের প্রধান গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করে। (সূত্র: আল-মুখতাসার ফি আকবার আল-বাসার, ইবন আবদুল হাদী)

দারা শহরে (বর্তমান তুরস্ক), সাহাবি ঈয়াদ ইবন গনম ফাতেহের পর গির্জা থেকে মসজিদ তৈরি করেন। (সূত্র: ফুতুহুশ শাম, আল-ওয়াকিদি)

একইভাবে, ২২ হিজরিতে মুসলিমরা কিরকিসিয়ায় ‘বাইয়াত জর্জিস’ নামক গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করে এবং তৎক্ষণাৎ সেখানে সালাত আদায় করে।

অব্যাহত ব্যতিক্রম

মেয়াফারিকিন শহরের (আজকের তুরস্কের দিয়ারবাকির প্রদেশে অবস্থিত) বড় গির্জাটিও এক সময় মসজিদে পরিণত হয়েছিল। ‘ফুতুহুশ শাম’ গ্রন্থে বলা হয়েছে,

 শহরের বাসিন্দারা যখন সব অস্ত্র মুসলিম সেনার হাতে তুলে দিল, তখন তাদের আন্তরিকতা দেখে বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে, আর বড় গির্জাটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়।

মেয়াফারিকিনের নিকটবর্তী আমেদ শহরের (বর্তমান দিয়ারবাকির কেন্দ্র) ব্যাপারেও ওয়াকিদি বলেন, ১৮ হিজরিতে যখন মুসলিমরা শহরটি জয় করে, সেনাপতি ‘ইয়াযিদ বিন গনম’ বলেন:

 “যদি আল্লাহ আমাদের নবীকে দয়ার প্রতীক না বানাতেন, তবে আমরা তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতাম।” 

এরপর তিনি শহরের গির্জাটিকে মসজিদে পরিণত করেন।

ওয়াকিদি আরও জানান, ‘দিয়ার বকর’ অঞ্চলের অধিকাংশ শহর মুসলিমরা যুদ্ধ ছাড়াই দখল করে। তবে ‘রাসুল আইন’ শহরটি (আজকের হাসাকায়) জোরপূর্বক দখল হয় এবং সেখানে ‘নেস্টোরীয়’ গির্জাটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়। অনেক গির্জা তখন মসজিদে পরিণত হয়।

ফিলিস্তিনের লুদ শহরে – আলিমি জানান – একটি গির্জা ‘জামে মানুস’ নামে পরিচিত একটি বড় মসজিদে পরিণত হয়। মিশরে, যা ইসলাম-পূর্ব সময়ে খ্রিস্টধর্মের প্রধান কেন্দ্র ছিল, ওয়াকিদি বলেন:

মুসলিমরা ২১ হিজরিতে আলেকজান্দ্রিয়া জয় করে গির্জাগুলি অক্ষত রাখলেও প্রধান গির্জাটি মসজিদে রূপান্তর করে এবং মুসলিমদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করেন।

এমনকি মিশরের তিনিস দ্বীপ ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতেও মুসলিমরা গির্জাগুলিকে মসজিদে রূপান্তর করেন।

এটি শুধু প্রাথমিক বিজয়ের সময় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং উত্তর সিসিলির ‘পালেরমো’ নগরীর (বর্তমান পালেরমো) একটি প্রধান গির্জাও মুসলিমরা মসজিদে রূপান্তর করেন; যেটি সেই সময়ের একটি শৈল্পিক ও স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন ছিল।

আলেপ্পোর ঘটনায় (৫১৮ হিজরি/১১২৪ ইংরেজি) দেখা যায়, যখন ফ্রাঙ্ক ক্রুসেডাররা নগরী ঘিরে ফেলে, তখন মুসলিম নেতৃত্বাধীন ক্বাযী আবু ফজল ইবনুল খাশশাব নগরীর গির্জাগুলিকে মসজিদে রূপান্তর করেন এবং সেগুলিতে কিবলার দিকে মিম্বর স্থাপন করেন।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যখন ৫৮৩ হিজরিতে (১১৮৭ ইংরেজি) বাইজান্টাইনদের কাছ থেকে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন, তখন তিনি ‘কিয়ামা গির্জা’র পাশের আরেকটি গির্জাকে হাসপাতাল (বিমারিস্তান) বানিয়ে দেন।

আরও পরে, ৬৬৪ হিজরিতে (১২৬৫ ইংরেজি), সুলতান যাহির বাইবার্স সিরিয়ার কারা শহর দখল করে তার গির্জাটি মসজিদে রূপান্তর করেন, যেখানে ইমাম ও ক্বাযী নিযুক্ত করা হয়। তিনি হামসের ‘হিসনুল আকরাদ’ (আজকের “কেলআতুল হুসন”) দখলের পর তার গির্জাটিও জামে মসজিদে রূপান্তর করেন। আনতাকিয়ায়ও একই কাজ করেন।

ভ্রাম্যমান পর্যটক ইবনে বতুতা জানান, আনাতোলিয়ার ‘আইয়া সলুক’ (আজকের সেলজুক শহর) শহরের একটি গির্জা এতটাই সম্মানিত ছিল রোমানদের কাছে যে দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা সেখানে আসত। ইসলামিক বিজয়ের পর সেটি একটি মহান জামে মসজিদে পরিণত হয়।

এই সব ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বলেন, এসব ঘটনার যতই সমালোচনা হোক না কেন, তা কখনোই সেই নির্মমতা ছুঁতে পারে না যা অন্য ধর্মীয় শক্তিগুলো মুসলিমদের উপরে চালিয়েছে — বিশেষত “আধুনিক যুগে”, যেখানে ‘আন্তর্জাতিক আইন’ আর ‘মানবাধিকার সংহিতা’ প্রচলিত।

উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়ন ১৭৯৮ সালে মিশরে অভিযান চালিয়ে আল-আজহার মসজিদে সেনাবাহিনী ঢুকিয়ে দেয়, যা ইতিহাসে ‘ঘোড়া আজহারে প্রবেশ করল’ নামে পরিচিত।

উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক যুগে, ফরাসিরা আলজেরিয়া দখল করার পর বহু মসজিদ গির্জায় রূপান্তর করে। একই রকমভাবে, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন দখলের পর ইসরা্ল ১২০০ এরও বেশি মসজিদ ধ্বংস করে এবং এর অনেকগুলোকে মদখানা, জাদুঘর কিংবা উপাসনালয়ে রূপান্তর করে।

তুর্কি স্থপতি মুহাম্মদ আমিন ইলমাজ তার গবেষণায় দেখান, অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারভুক্ত ১৮টি দেশ আজ পর্যন্ত ৩২৯টি ইসলামি স্থাপত্য — যার মধ্যে বেশিরভাগই মসজিদ — গির্জায় রূপান্তর করেছে।

আল জাজিরা আরবি থেকে জাহেদুল ইসলাম আল-রাইয়ানের অনুবাদ 

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর।

 

 

কিউএনবি/আয়শা/৫ আগস্ট ২০২৫/রাত ১২:১৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

August 2025
M T W T F S S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit