অনলাইন নিউজঃ বাবা-মা হওয়ার কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান মানুষ করা যেমন আনন্দের, তেমনই চ্যালেঞ্জিং। এই পথে আপনাকে অনেক পরামর্শ শুনতে হতে পারে—ডাক্তার, পরিবার, বন্ধু, এমনকি অপরিচিত লোকজন থেকেও। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক বাবা-মা এবং প্রতিটি শিশুই আলাদা। আপনার সন্তানের প্রতি সংবেদনশীল ও সাড়া দেওয়ার মনোভাবই আপনাদের সম্পর্ককে সুস্থ ও ইতিবাচক করে তুলতে পারে।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির শিশু-বিকাশ বিশেষজ্ঞ ড. কিথ ক্রনিক বলেন, ‘সংবেদনশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল পিতামাতা হওয়া মানে হলো, আপনি বুঝতে পারছেন আপনার শিশুর ঠিক তখন কী প্রয়োজন এবং সেটি সঠিকভাবে দিচ্ছেন।’
বিশেষ করে ছোট শিশু ও নবজাতকদের ক্ষেত্রে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের শুরুর বছরগুলোতে শিশুর সঙ্গে ভালোবাসায় জড়ানো, কাঁদলে সাড়া দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে এক ধরনের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এ ধরনের মজবুত সম্পর্ক শিশুদের নিজস্ব আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। তারা নিজেকে নিরাপদ মনে করে এবং নতুন কিছু শেখা, চারপাশ অন্বেষণ করা ও অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার উৎসাহ পায়। বিশেষজ্ঞরা এই সম্পর্ককে বলেন ‘সিকিওর অ্যাটাচমেন্ট’ বা নিরাপদ আবেগীয় বন্ধন। এই বন্ধন থাকলে শিশুরা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ যেমন দারিদ্র্য, পরিবারে অস্থিরতা, বাবা-মায়ের মানসিক চাপ বা হতাশা সামলে উঠতে আরও সক্ষম হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে ৬ জনের মধ্যে বাবা-মায়ের সঙ্গে এমন বন্ধন তৈরি হয়। বাকি ৪ শিশুর মধ্যে এই বন্ধনের অভাব দেখা যায়—তারা বাবা-মাকে এড়িয়ে চলে বা উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখায়। এর ফলে শিশুদের মধ্যে জটিল আচরণগত সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই এমন আচরণ তৈরিতে বাবা-মাকে সহায়তা করতে বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
উপস্থিত থাকা
আজকের ব্যস্ত জীবনে অনেক কিছুই আছে যা আপনাকে সন্তানদের প্রতি কম মনোযোগী করে তুলতে পারে—কাজের চাপ, ঘুমের অভাব, মোবাইল ফোন ইত্যাদি। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এমন ‘বিক্ষিপ্ত প্যারেন্টিং’-এর কারণে শিশুর আবেগগত বিকাশ, ভাষা শেখা এবং সামাজিক আচরণে প্রভাব পড়তে পারে।
যদি বাবা-মা সব সময় সন্তানের জন্য মানসিকভাবে উপস্থিত না থাকেন, তাহলে শিশুরা কষ্ট পায়, অবহেলিত বা প্রত্যাখ্যাত বোধ করে। তারা বেশি রাগ করে বা একাকিত্বে ভোগে। এমনকি কোনো সময় তারা আর বাবা-মায়ের মনোযোগ পেতে চেষ্টা করাও বন্ধ করে দেয়।
ড. ক্রনিক বলেন, ‘শিশুদের জীবনে এমন সময় আসে যখন তারা আপনার মনোযোগ ও স্বীকৃতি চায়।’ বাবা-মা হিসেবে আপনাকে বোঝাতে হবে যে তারা গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনি তাদের ভালোবাসেন।
শিশুর রাগ, চিৎকার বা ঝগড়ার সময়ে সংবেদনশীল থাকা কঠিন হতে পারে। কিন্তু ড. ক্যারল মেটজলার বলেন, ‘যদি বাবা-মা রেগে যান বা আক্রমণাত্মক আচরণ করেন, তবে শিশুরাও সেই আচরণ শিখে ফেলে এবং এক ধরনের নেতিবাচক চক্র শুরু হয়।’
ক্রনিক বলেন, সাধারণত ৩ বছর বয়সে শিশুরা নিজে থেকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। তার আগে তারা আপনাকে দেখে শেখে—আপনি কীভাবে কথা বলেন, রাগ সামলান বা উত্তেজনা প্রকাশ করেন।
কৌশল শেখানো
শিশুদের নিজস্ব আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করার পাশাপাশি, তাদের সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা শেখানো দরকার। এতে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়। মেটজলার বলেন, ‘যখন বাবা-মা শিশুকে ইতিবাচকভাবে শেখান, তখন শিশুরা নিয়ম মানতে শেখে এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।’
ক্রনিক বলেন, ‘আমরা অনেক সময় চেষ্টা করি সন্তানদের সব খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু তারা যদি কখনো কোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়, তবে তারা নিজে থেকে সামলানো শিখবে কীভাবে?’ তাই শিশুদের ছোটখাটো সমস্যার মুখোমুখি হতে দিন, তারপর তাদের সঙ্গে কথা বলে সেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করুন। এতে তারা শেখে কীভাবে বাস্তব জীবন সামলাতে হয়।
প্রয়োজন পূরণ করা
শিশুর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে, তার ‘প্রয়োজন’ পূরণ মানেই ‘সব ইচ্ছে’ পূরণ নয়। ক্রনিক বলেন, ‘এই দুটো এক নয়। আপনি ঠিক বুঝে নিন, ওই মুহূর্তে আপনার সন্তানের কী লাগছে—এটা জানা একজন দক্ষ পিতামাতার বড় গুণ।’
শিশুর বয়স অনুযায়ী ভাবুন, সে কী শেখার সময় পার করছে। হয়তো আবেগ নিয়ন্ত্রণ, নতুন কিছু শেখা, বা বন্ধুদের সঙ্গে মিশে চলা—এসব বিষয়ের মধ্যে কোনটিতে সে সহায়তা চাইছে। ক্রনিক বলেন, ‘আপনি চান যেন শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়। এমন কিছু করবেন না যা তার পক্ষে খুব কঠিন, আবার এমনটাও নয় যা সে আগেই রপ্ত করেছে।’ আরেকটি ভালো উপায় হলো—শিশুকে সুযোগ দিন সে যেন নিজেই নেতৃত্ব নিতে পারে।
ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির শিশু আচরণ গবেষক ড. জন বেটস বলেন, ‘দিনের কিছু সময় দিন যেখানে আপনি সন্তানের নেতৃত্বে চলবেন, বিশেষ কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া খেলাধুলা বা আড্ডা দেবেন। শিশুদের এটা ভালো লাগে এবং সম্পর্ক অনেক দৃঢ় হয়।’
ভালোবাসা দেখান
বেটস বলেন, শুধু নির্দিষ্ট কিছু অভিভাবকত্ব নীতিতে আটকে না থেকে শিশুর প্রকৃত চাহিদার দিকে মন দিন। সম্পর্ক জটিল হয়ে গেলেও কখনোই দেরি হয়ে যায় না। নতুনভাবে শুরু করা সবসময় সম্ভব।
ড. মেটজলার বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আপনার সন্তান যেন জানে, আপনি তাকে ভালোবাসেন এবং সবসময় তার পাশে আছেন।’ বড় শিশুদের ক্ষেত্রে, তাদের জানান যে আপনি সম্পর্ক গড়তে আন্তরিকভাবে আগ্রহী এবং তাদের সফল দেখতে চান।
সন্তানের সঙ্গে সংযোগ গড়ার সহজ কিছু টিপস
– ভালো আচরণ করলে ধন্যবাদ দিন, নির্দিষ্ট করে প্রশংসা করুন।
– ঘরের ছোট কাজগুলোতে তাদের দায়িত্ব দিন এবং কাজ শেষে প্রশংসা করুন।
– গলা চড়ানো বা কড়া কথা না বলে, নম্রভাবে কথা বলুন বা নির্দেশ দিন।
– প্রতিদিন কিছুটা সময় ভালোবাসাময় ও ইতিবাচকভাবে কাটান—একসাথে হাঁটা, বই পড়া ইত্যাদি।
– ঘরে বা স্কুলে কোনো সমস্যা হলে একসাথে সমাধান খুঁজুন।
– মোবাইল ফোন বা অন্যান্য মনোযোগ নষ্ট করা জিনিসের সময় বেঁধে দিন—যেমন সন্তান ঘুমিয়ে গেলে ফোন চেক করুন।
– সন্তানের চিন্তা, ভয়, লক্ষ্য ও স্বপ্নের কথা শুনুন। তাদের পছন্দের কাজগুলোর সঙ্গে নিজেও যুক্ত থাকুন। তাদের খেলাধুলা বা পারফরম্যান্স দেখতে যান।
অনলাইন নিউজ ডেক্সঃ
কুইকট এনবি /রাজ/৪আগস্ট ২০২৫/দুপুরঃ ১২.৪০