সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ০৬:২৪ পূর্বাহ্ন

বিডিআর বিদ্রোহে এড.আব্রাহাম লিংকন এর সাহসি ভূমিকার কথা

জিএম কামরুল ইসলাম, সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
  • Update Time : শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪
  • ৩৯৯ Time View

বিডিআর বিদ্রোহে  এড.আব্রাহাম লিংকন এর সাহসি ভূমিকার কথা

——————————————————————————-

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বিডিআরের ঘটনা নিশ্চয়ই আপনাদের সবার মনে আছে। সে সময় আমি রংপুরের একটি পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলাম। তখন রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট আমাদের দায়িত্বে ছিল।

পিলখানার পরে বংপুর ও কুড়িগ্রামেও বড় ধরনের বিপর্যয়/বিদ্রোহ হয়েছিল। কুড়িগ্রামের ২৭ রাইফেলস ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক লে: কর্নেল সুমন কুমার বড়ুয়ার (পরে কর্নেল ও বিজিবির পরিচালক প্রশাসন) সাথে ছিল টুআইসি মেজর আলতাফুল কবির, অপারেশনস্ অফিসার মেজর কামাল, ক্যাপ্টেন ডা: ইদি আমিন। অবশ্য সে সময় একটি ট্রেনিংয়ে ক্যাপ্টেন ইদি আমিন কুড়িগ্রামের বাইরে ছিলেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার নারকীয় ঘটনার অব্যবহিত পরেই কুড়িগ্রামে বিডিআরের জোয়ানেরা অধিনায়ক কর্নেল সুমনসহ সেনাকর্মকর্তাদের টেলিফোন অপারেটারদের রুমে আটক করে সকল ধরনের যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয়। তাঁদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। একইসাথে অফিসারদের পরিবারও (স্ত্রী ও শিশু সন্তানরা) আটক হয়ে পড়ে।

সীমান্ত অরক্ষিত রেখে ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখেই কুড়িগ্রামের সীমান্তগুলোর বিওপির থেকে সকল কোম্পানি কমান্ডাররা কুড়িগ্রামে ব্যাটলিয়ন হেডকোয়ার্টারে চলে আসে। তারা ডিএডিকে অধিনায়ক ঘোষণা করে। বিডিআর সদস্যরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক বক্তব্য প্রদান ও অবস্থান নিয়ে অস্ত্রাগার (কোত) ভেঙে সমরাস্ত্র জওয়ানদের সরবরাহ করে। তারা কুড়িগ্রাম কলেজের ছাত্রাবাসসহ বিডিআর ক্যাম্পের বহুতল ভবনের ছাদগুলোতেও ভারী অস্ত্র বসায়।

রংপুর সেনানিবাস থেকে আর্মি আসছে এই মিথ্যাপ্রচার করে তারা কোথ ভেঙে নিজেদের স্বশস্ত্র করেছিল। তারা বিক্ষিপ্ত ভাবে গোলাগুলি করে ও গ্রণেড বিষ্ফোরন ঘটিয়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে। তারা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে সরে যেতে বাধ্য করে। ফলশ্রুতিতে ব্যাটলিয়ন হেডকোয়ার্টারের নিকটবর্ত্তী জজ কোর্ট, ডিসি অফিস, আশপাশের কলেজ ও স্কুলগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। আদালতে বিচারক ও আইনজীবীরা কর্মস্থল থেকে সরে যান। সেখানে ভীষন ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সমগ্র কুড়িগ্রাম শহর থমথমে অবস্থার সৃস্টি হয়।

ঢাকায় যখন রক্তাক্ত পরিস্থিতি তখন কুড়িগ্রামে বিডিআর ক্যাম্পে আটক সেনা কর্মকর্তারা বেঁচে আছে কিনা আমরা জানতে পারছিলাম না। যদি বেঁচে থাকেও তাহলে কোথায় আছে? কেমন অবস্থায় আছে? সবকিছুই আমাদের কাছে অজানা ছিল। ব্যাটলিয়নে গোলাগুলির খবরে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে তারা অফিসারদের হত্যাই করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকরাও ভেতরের সঠিক খবর দিতে পারছিল না। জেলার সিভিল প্রশাসনের লোকজনেরাও অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। পুলিশ প্রশাসনও তেমন কিছু করতে ও বলতে পারছিল না।

এমতাবস্থায় রংপুর সেনানিবাস থেকে আমি কুড়িগ্রামের আইনজীবী আমার বড় ভাই এনায়েত হোসেনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ ও রাজনৈতিক সহকর্মী জনাব আব্রাহাম লিংকনের সাথে কথা বলি। আব্রাহাম লিংকন এবং কর্নেল সুমন বড়ুয়া যথাক্রমে সদস্য সচিব ও আহবায়ক ছিলেন তারামন বিবি বীরপ্রতীকের বাসগৃহ নির্মাণের জন্য গঠিত কমিটির। যে কাজে অনেক বিডিআরের সদস্য আব্রাহাম লিংকন সাহেবকে নানা ভাবে হেল্প করেছিল। তাঁদের একমাত্র সন্তান কুড়িগ্রামে রাইফেলস স্কুলে প্রাথমিকে পড়তেন। সে সুত্রে তিনি স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিরও সহ-সভাপতি ছিলেন। যেখানে বিডিআর সদস্যদের সন্তানরাও পড়তো।

এসব কারণে তিনি ডিএডিসহ বিডিআর সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিজ্ঞ পিপি হওয়ার কারণে আদালত সংশ্লিষ্ট কাজে বিডিআর সদস্যরা তার সাথে যোগাযোগ রাখতো যে তথ্যগুলি আমার জানা ছিলো। সে জানা থেকেই আব্রাহাম লিংকনকে অনুরোধ করি তিনি বিষয়টি সমাধানে আমাদের যেনো সাহায্য করেন। তাঁকে অনুরোধ করি ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো ও তাঁর গুড অফিস ব্যবহার করে তিনি যেন প্রকৃত খবরটি আমাদের জানান।

তাছাড়া সেনা অফিসার ও তাঁদের পরিবারগুলোকে উদ্ধারের জন্যে অনুরোধ করি। তিনি শুধু জানতে চেয়েছিলেন- সেনা অফিসারদের উদ্ধারে কুড়িগ্রামে আর্মির কোন অভিযান হবে কিনা? তাঁকে নিশ্চিত করি এধরণের কিছুর পরিকল্পনা নেই। এরপর তিনি কাজে নেমে পড়েন। মনে পড়ে একজন ওয়ারেন্ট অফিসারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমার সাথে ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করেন। তার কাছ থেকে নিশ্চিত হই যে কর্নেল সুমন বড়ুয়াসহ সেনা কর্মকর্তারা বেঁচে আছেন।

আব্রাহাম লিংকনকে বলি আপনি যেহেতু সুত্র বের করতে পেরেছেন বাকিটুকুও পারবেন। তিনি আমাদের অনুরোধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিস্তৃত কাজ শুরু করেন। বিডিআর ক্যাম্পে গিয়ে তিনি কোম্পানি কমান্ডারদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করে প্রথমে পরিবারগুলোকে উদ্ধার করে নিজের বাসায় রাখেন। পরিবারগুলোর সাথে আমার কথাও বলিয়ে দেন।

এরপর আব্রাহাম লিংকন নতুন করে উদ্যোগী হন তথাকথিত কমান্ডারদের সাথে কথা বলে অফিসারদের বের করে আনার কাজে। আব্রাহাম লিংকন সাহেব তাদের নিশ্চিত করেন তাদের অবস্থানে সেনাবাহিনীর কোন অভিযান হবে না এবং প্রস্তাব করেন “অফিসারদের অক্ষত অবস্থায় পেয়েছি” এই রকম একটা লিখিত দেবেন। প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসককে সঙ্গে এনে তাদেরকে নিয়ে যাবেন। বিডিআরের সিনিয়র কোম্পানি কমান্ডাররা লিখিত কাগজ দেয়া এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে হস্তান্তরের বিষয়টিতে তারা রাজি হলে তিনি লিখিত জিম্মানামা প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসককে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পে যান।

সেখান থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৭টার পর লিখিত মুচলেকা দিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্ধার করে আনেন। তিনি লিখিত জিম্মানামার রিসিভ কপিতে ডিএডি ময়শের আলীর সাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলেন যা পরে (সম্ভবত)বিডিআর বিদ্রোহের বিচারে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উদ্ধারের রাতেই পরিবারসহ অফিসারদের তিনি রংপুর সেনানিবাসে পৌঁছে দেন। আমরা তাকে ও অফিসারদের রিসিভ করি। ২৬ ফেব্রুয়ারী তারিখের জওয়ানদের কোথ ভেঙে নেয়া অস্ত্র উদ্ধারেও সহায়তা করেন জনাব আব্রাহাম লিংকন।

স্থানীয় প্রশাসন যখন কিংকর্তব্যবিমূড় ও ভীতসন্ত্রস্ত। অনেকেই যখন সেনানবাহিনী ও সরকারের দোষ ত্রুটি খোঁজা আর পক্ষে বিপক্ষ নিয়ে ব্যস্ত তখন জনাব আব্রাহাম লিংকন একজন সাধারণ নাগরিক হয়েও আমাদের অনুরোধে নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে একাই আলোচনার মাধ্যমে শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি নাটকের রক্তপাতহীন অবসান ঘটিয়ে সেনা অফিসার ও তাঁদের পরিবাকে উদ্ধার করেছিলেন।

আজকে মনে হয় স্বপ্নের মতন কিন্ত সেদিন এটিই ছিলো বাস্তব ও সত্যি। ফলশ্রুতিতে বিডিআর ক্যারেনেজের মামলায় তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যদাতাও ছিলেন।

তখন আমরা তাঁকে তেমনভাবে সম্মানিত করিনি। তবে সাহসি ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে আমরা একটি প্রশংসাপত্র দিয়েছিলাম। তাছাড়া তিনি রংপুরে সেনাবাহিনী পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর “শাশ্বত বাংলা”-য় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন স্মারকও আমাদের যোগাড় করে দিয়েছিলেন।

এডভোকেট এস এম আব্রাহাম লিংকন একজন তৃণমূল পর্যায়ের নিবেদিত প্রাণ সমাজ কর্মী ও পরোপকারী মানুষ। তিনি কুড়িগ্রামে নিজের বাড়িতে প্রায় একক চেষ্টা, অর্থ ও শ্রমে অনন্য সুন্দর উত্তরবঙ্গ জাদুঘর নামে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণ/পরিচালনা করে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি একজন সুবক্তা এবং লেখকও বটে। আমার জানা মতে তিনি ফেলানী হত্যা মামলায়ও গঠনমূলক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ও ভারসাম্যমূলক ভুমিকা পালন করেছেন। তিনি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় যাত্রীর অধিকার সংরক্ষণে এবং স্কোয়াশ খেলার প্রচলনে আমাকে নানাভাবে সহযোগিতাও করেছেন।

একজন মানুষ পুরস্কারের জন্য কাজ করেন না, আব্রাহাম লিংকনের মতন মানুষও করেননি। পুরস্কার নিয়ে আজকাল নানা কথামালা চোখে পড়ে যা পুরস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এরকম এক সংকটেরকালে স্বাধীনতা পুরস্কারে এস এম আব্রাহাম লিংকনকে মনোনয়ন দানে শুধু তাঁকেই সম্মানিত করা হলো না বরং পুরস্কারটিও মর্যাদায় ফিরলো বলে বিশ্বাস করি।

সঙ্গতকারণে টেলিভিশনের স্ক্রলসহ যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তাঁর মনোনয়ন দেখে খুবই আনন্দিত হয়েছি। রাষ্ট্রের বিপদে যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে অফিসারদের উদ্ধার করেছেন রাষ্ট্র তাঁকে দলমতের উর্ধ্বে যথার্থ ভাবে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন। এই মনোনয়নের সাথে সংশ্লিষ্টদের কৃতজ্ঞতা জানাই।

নোটঃ সংগত কারনে কিছু কথা/তথ্য এই লেখায় উহ্য রাখা হয়েছে।

 

লেখকঃ জিএম কামরুল ইসলাম একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। বর্তমানে তিনি ব্যবসা ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বিডিআরের ঘটনার সময় তিনি রংপুরের একটি পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। জিএম কামরুল ইসলাম এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে তার অনুমতি স্বাপেক্ষে স্ট্যাটাসটি প্রকাশ করা হলো।

 

 

কিউএনবি/ নাহিদ/ ২৩.০৩.২০২৪/ রাত ১২.১০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit