সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:২১ অপরাহ্ন

সাদাপাথরে যে সৌন্দর্য ফিরবে না আর

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ১১ Time View

নিউজ ডেক্সঃ  প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন সিলেটের সাদাপাথর। পাহাড়ি ঝরনার স্বচ্ছ জলে ভেসে থাকা পাথরগুলোর দিকে তাকালে মনে হবে চকচকে সাদা পদার্থ। দূর থেকে মনে হয় যেন কেউ নদীর তলদেশে মুক্তার মালা বিছিয়ে রেখেছে।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান এই সাদাপাথর। মনোমুগ্ধকর পাথরগুলো কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে তার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস।

ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর এসেছে মূলত ভারতের মেঘালয়ের খাসি ও জৈন্তা পাহাড় থেকে। সেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিলার ক্ষয়, আবহাওয়ার প্রভাব ও নদীর স্রোতের ধাক্কায় গড়ে উঠেছে পাথরের স্তূপ। এসব শিলা মূলত গ্রানাইট, কোয়ার্টজ ও অন্যান্য কঠিন পাথরের মিশ্রণ। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল ও ঝরনা থেকে গড়িয়ে আসা এসব পাথরের প্রধান বাহক হলো ভারতের পিয়াইন নদী ও বাংলাদেশের ধলাই নদী। ভারতের খাসি-জৈন্তা পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর পানির সঙ্গে প্রতিবছর বর্ষায় প্রচুর পাথর ভেসে আসে। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে বিপুল পাথরের মজুত। বর্ষার প্রবল ঢল পাথরগুলো ভাসিয়ে আনে ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত, আর স্রোত কমে গেলে ভারী পাথর নদীর তলদেশে ও তীর ঘেঁষে স্তূপাকারে জমা হয়। শত বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই ভোলাগঞ্জে গড়ে উঠেছিল সাদাপাথরের বিশাল ভান্ডার।

এক সময় ভোলাগঞ্জের এই সাদাপাথর হয়ে ওঠে অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু এই পাথরে শ্যেন দৃষ্টি পড়ে মানুষরূপী শকুনদের। সাদাপাথরে বুকে তারা চালায় খুন্তি, শাবল। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর লুটপাট প্রকাশ্য হয়। গত আগস্ট মাসের প্রথমদিকে পরিবেশবাদী ও সাংবাদিকরা টের পান সাদপাথর বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিরোনাম সিলেটের সাদাপাথর লুটপাট। টনক নড়ে প্রশাসনের। পাথর লুটের পর ১৩ আগস্ট বুধবার সিলেটের সাদাপাথরে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতি দমন কমিশন সাদাপাথর চুরির সঙ্গে জড়িত সিলেটের ৪২ জনকে চিহ্নিত করে। এর মধ্যে স্থানীয় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা রয়েছেন। কমিশনের এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান ও অনুসন্ধান চালিয়ে এদের সংশ্লিষ্টতা পায়। সাদাপাথর চুরির ঘটনায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের কর্তব্যে অবহেলার তথ্যও পায়। এরপর খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) কোম্পানীগঞ্জ অজ্ঞাত আসামি উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করে।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ১২ আগস্ট পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসনের অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, বিজিবি ও টাস্কফোর্সের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তাদের কাউকেই সাক্ষী করা হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির সদস্যরাও সরেজমিন স্পট পরিদর্শন করেন। সিলেটে তারা গণশুনানিতে অংশ নিলেও সাদাপাথর পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসা বা আসামি গ্রেপ্তারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না, তা বলেননি।

পরিবেশবিদরা বলছেন, সাদাপাথরে এক অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার পরে প্রতিস্থাপনের নামে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। একাধিক মামলা ও তদন্ত কমিটি হলেও আলোর মুখ দেখবে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। আসামি ধরার ব্যাপারেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল করিম কিম বলেন, যে হারে পাথর লুট হয়েছিল, তার তুলনায় এই প্রতিস্থাপন খুবই নগণ্য, তবুও প্রত্যাশা থাকবে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র আগের অবস্থা ফিরে পাক। গত দুই দশক ধরে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বিচারে সিলেট জেলার বিভিন্ন নদনদী, পাহাড়টিলা ও কৃষি জমি থেকে পাথর লুণ্ঠন করে যা ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। আমরা চাই, প্রশাসন পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় বর্তমানে যে ভূমিকা পালন করছে তা ধরে রাখুক।

সাদাপাথরে যে সৌন্দর্য ফিরবে না আরপরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাড. শাহ শাহেদা আক্তার কালবেলাকে বলেন, প্রকৃতির উপর আমরা চরম অন্যায় করেছি। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে এই প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। এই বোধটা মানুষের মাঝে তৈরি করতে পারলে লুটপাট বন্ধ হবে। তিনি বলেন, প্রশাসন পারে না এমন কোনো কাজ নেই। তাদেরও ভক্ষকের পথ থেকে সরে আসতে হবে।

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লা শহিদুল ইসলাম শাহীন কালবেলাকে বলেন, জাফলং-সাদাপাথর এখন ইকোনমিক্যাল ক্রিটিক্যাল জোনের আওতায়। এসব এলাকায় প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টর থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা উচিত ছিল। সম্প্রতি সাদাপাথরে যে লুটপাট হয়ে গেল সেটি কিন্তু প্রকাশ্যে সংঘটিত হয়েছে। দিনেদুপুরে এমন ঘটনা ঘটার পরও যদি কেউ বলে প্রশাসন জড়িত না, তাহলে ভুল বলবে। প্রশাসন জড়িত, তাদের কাছে তথ্য ছিল। টানা এক সপ্তাহ লুটপাট হওয়ার পর তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিটি সেটিও ছিল লোক দেখানো। লুটপাটের শেষ দিনে কেন তদন্ত কমিটি গঠন হবে? তার মানে প্রশাসন লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং লুটপাট শেষ করার সুযোগ দিয়েছে। প্রশাসনের তৎকালীন দায়িত্বরত জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসিল্যান্ড, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-তারা কেউই দায় এড়াতে পারেন না। তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঘটনাটি তদন্ত করেছে। আমরা মনে করি, যদি দুদক পাবলিক সার্ভেন্টদের সংশ্লিষ্টতা পেয়ে থাকে তাহলে সেটি সুনির্দিষ্ট করা উচিত। পাথর লুটে জড়িতদের গ্রেপ্তার না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে আদালতের পরোয়ানা না থাকলে তো কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। আর যদি পরোয়ানা থাকার পরও তদন্তকারী সংস্থা আসামি গ্রেপ্তার না করেন সেখানে তাদের ব্যর্থতা চিহ্নিত হবে। আমাদের প্রত্যাশা, ন্যায়বিচারের জন্য উপযুক্ত প্রমাণাদিসহ প্রকৃত জড়িতদের নাম-তালিকা চার্জশিটে উল্লেখ করে আদালতের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রনি বসাক কালবেলাকে বলেন, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সাদাপাথর পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এটা প্রকৃতির নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ঘটতে দিতে হবে। তবে শঙ্কা হচ্ছে, পাথর মূলত পানির স্রোতের সাথেই আসত, সেক্ষেত্রে পানির তীব্র স্রোতে বর্তমানে যে পাথরহীন স্থানগুলো রয়েছে সেখানে ক্ষয় বা বিপর্যয় ঘটতে পারে। এ কারণে সাদাপাথরের চিত্র পূর্বের অবস্থায় ফেরত আনতে দীর্ঘ সময় দিতে হবে।

আরেকটি বিষয়, যেহেতু এটি একটি পর্যটন স্পট হওয়ায় মানুষের আনাগোনা বেশি। এখানে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই নাজুক। ঘটছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তা ছাড়া মানুষজন নানাভাবে এখানকার পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে। এই ছোট ছোট বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি অ্যান্ড অ্যানভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য একবার বিনষ্ট হয়ে গেলে কৃত্রিম পন্থায় সেটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুব অসম্ভব হয়ে পড়ে।

সাদাপাথর পর্যটন স্পটটি আগের অবস্থায় ফেরানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যদি এখান থেকে পাথর উঠানো বন্ধ করা হয়, তাহলে ছয় মাস পরই প্রাকৃতিক একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। দীর্ঘ সময় ধরে যদি এখান থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখা যায়, তাহলে আগের মতো না হলেও অনেকাংশেই সেটা পূরণ হবে। সর্বোপরি, বাইরে থেকে পাথর এনে এখানে ফেলে শূন্যস্থান পূরণ করা যাবে; কিন্তু শতভাগ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, সাদাপাথর এক দিনের বিষয় নয়, এর ইতিহাস দীর্ঘ। এটা যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিকভাবে পাথরের লেয়ার তৈরি করে এটা হয়েছে। বলা হচ্ছে সাদাপাথর একরাতে নির্মূল করা হয়েছে, আবার বলা হচ্ছে সাদাপাথর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে—এটা কখনো সম্ভব নয়। প্রশাসনের যে গাফিলতি ছিল, সেটা নিয়ে পাবলিক জনসচেতনতা দরকার। প্রশাসনকে দেশপ্রেম ধারণ করে, দেশমাতৃকা মনে করে সাদাপাথর রক্ষা করতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে সিলেটের নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. সারওয়ার আলম কালবেলাকে বলেন, সাদাপাথরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে যা যা করার দরকার আমরা তা করব। প্রশাসন বজ্রের মতো কঠিন হতে পারে আবার ফুলের মতো নরমও হতে পারে। পাথর তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত টহল দিচ্ছে। তার পরও কেউ দুঃসাহস করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সাদাপাথরে স্যানিটেশন ও ক্যামেরা বসানোর ব্যবস্থা করা হবে।

অনলাইন নিউজ ডেক্সঃ
কুইক এন ভি/রাজ/০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫/ দুপুরঃ ১২.০৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

September 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit