সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৫ পূর্বাহ্ন

ফায়াজুন্নেসা চৌধুরীর বাস্তব রুপরেখার আলোকে রচনা : প্যারেন্টিং বক্র

ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী, শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
  • Update Time : রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২২
  • ৮৩৬ Time View

 প্যারেন্টিং বক্র
——————-

গত কয়েক বছর যাবত একটি স্মার্ট জেনারেশনের আবির্ভাব ঘটেছে। এই জেনারেশনের নাম প্যারেন্টিং জেনারেশন। প্যরেন্টিং একটি ইংরেজি শব্দ। যার অর্থ বাবা-মা হিসাবে সন্তানের লালন পালনের সঠিক ক্রিয়াকলাপ।

আমরা যে জেনারেশনে বড় হয়েছি সেই জেনারেশনের মা বাবা রা এই কঠিন শব্দের সাথে পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু প্যারেন্টিংএর ব্যবহারিক জ্ঞানের সাথে পরিচিত ছিলেন। বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমি কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে মনে ভাবতাম,”আচ্ছা, মানুষ যে কথায় কথায় এত পারিবারিক শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষা’র কথা বলে… আমি ছোটবেলা থেকে কি ধরনের পারিবারিক শিক্ষায় বড় হয়েছি, নিজেই তো জানি না। কিছুই তো আলাদা করে বাসা থেকে শিখায় নাই।”

তাই আমি প্যারেন্টিং এর পুরাতন ভার্সন ‘পারিবারিক শিক্ষা’ শব্দ দুটিকেও নিজের ক্ষেত্রে প্র‍য়োগে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতাম। এখন তো নিজেও মা হয়েছি। বয়স ত্রিশ পার। তবুও সকালে-বিকালে প্রয়োজন’ভেদে মা,শাশুড়ি,খালা,মামা ফুপু সবার কাছেই ধমক খাই। “তোর এইটা হয় না,ওইটা হয় না, রান্না হয় না, বাচ্চা পালা হয় না, কথাবার্তা, কাজকর্ম যা যা করি কিছুই ঠিকঠাক হয় না।

মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম এইটাও আমার জীবনে একটি পারিবারিক শিক্ষার পার্ট। তারপর এই বিষয় নিয়ে কিছুদিন চিন্তাভাবনা করে আরো একটু গভীর হই। আচ্ছা আমার পারিবারিক শিক্ষাটা তাহলে কোথায় হারায় গেলো? এরপর নিজেকে নিয়ে কিছু তুলনামূলক পর্যবেক্ষন করি।

আমি সাধারনত বিছানা থেকে ওঠা মাত্র বিছানাপত্র ঝেড়ে টান টান করে রাখি।এই কাজ শুধুমাত্র নিজের বাসায় না, যেখানেই যাই সেখানেই গিয়া করি। দ্যাট মিনস, এইটা আসলে আমার পারিবারিক শিক্ষার পার্ট। কারন ছোটবেলা থেকেই ঘুম থেকে উঠেই আম্মু আমাদের কে দিয়া বিছানা ঝারাতো।

তারপর আরেকটা কাজ, ফার্নিচার মোছা, এই কাজও আম্মু একটু বড় হওয়ার পর থেকেই করাতো। হাতে এক টুকরা কাপড় ধরায় দিয়ে বলতো ‘বাসার সবকিছু মোছো।’এই কাজটাও আমি প্রয়োজন বা জায়গাভেদে এখনো নিজের বাসা ছাড়াও যেখানেই যাই সেখানে গিয়েই করি। তারমানে ধরে নেয়া যায়, এইটাও আরেকটা শিক্ষার অংশ।

সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে বাসায় মেহমান বা মূল সদস্যের বাইরে কেউ না থাকলে ভালো কোনো নাস্তা কখনোই আম্মু আমাদের জন্য সাজায় রাখতেন না। এক কাপ লাল চা বা,দুধ চায়ের মধ্যে পাউরুটি কিংবা আটার রুটি চুবান দিয়ে খেয়ে উঠে আমরা স্কুলে চলে যেতাম। নিজেকে অন্যের থেকে স্পেশাল মনে না করা কিংবা জীবনে আসা সব রকম পরিস্থিতিতেই অভ্যস্ত হবার শিক্ষাটা হয়তো এই চর্চা থেকেই পাওয়া।

রান্নার কাজ কখনো আম্মু কিংবা বাসার বড়রা আমাদের দিয়ে করাতেন না, কিন্তু সিংকের বড় বড় হাড়ি পাতিল বাদে প্লেট/বাটি/চামচ খাওয়ার পর শুধু নিজেরটাই নয়, বরং সিংকে বাকি যত বাসন আছে সেগুলাও সব ধুয়ে রাখার অভ্যাস শুরু হয়েছিলো সম্ভবত হাইস্কুল থেকে। এই অভ্যাসের চর্চা থেকে জীবনে একটা চায়ের কাপও এদিক ওদিক ফেলে রাখতে পারি নাই। সিংকে আরও চার টা কাপ থাকলে, বাকিগুলা সহ একসাথে ধুয়ে আসি সেটা যেখানেই যাই না কেনো।

ছোটবেলা থেকেই বাসায় মেহমান আসা মানেই নিজেদের রুম ছেড়ে ড্রইং রুমের মেঝেতে সবাই মিলেমিশে রাত কাটাবার। এই অভ্যাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে ঘর ভর্তি মানুষ থাকা অবস্থায় কখনো দরজা আটকে বসে না থাকবার কিংবা এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো প্রাইভিসি প্রাইভিসি করতে করতে গলা শুকিয়ে ফেলবার।

এরকম প্রত্যেকটা ছোট ছোট অভ্যাসই ছিলো আমাদের মায়েদের পারিবারিক শিক্ষা তথা এই যুগের প্যরেন্টিং। যা আমি এতোদিন আসলে বুঝি নাই। হয়তো আরও অনেক ভালো ভালো শিক্ষায় অনেকে শিক্ষিত হয়েছে, হয়তো সেগুলোর চর্চা আমার হয়নি। সেই বিষয় ভিন্ন।

তবে, এই প্যারেন্টিং টার্ম কে আলাদা করে জানার জন্য আমাদের মায়েদের কোনো বইপুস্তক পড়তে হয়নি। ফেসবুকে শিশুদের প্যারেন্টিং গ্রুপে জয়েন দিতে হয়নি। দিন রাত বাচ্চার ক্যলরি গুনে পুষ্টি মেপে খাবার খাওয়াতে হয়নি। চাইল্ড সাইকোলোজি রিলেটেড জ্ঞানী জ্ঞানী ফুটেজ দেখে বাচ্চার সাথে লুতুপুতু করতে হয়নি। কিংবা রাতের বেলা ঘুম পাড়ানোর সময় স্টোরি-বুক পড়ে শুনায় পড়ার অভ্যাস তৈরী করতে হয়নি। উপরে উল্লেখ্য এগুলো কোনোকিছু না করেও আমাদের কে তারা দিব্যি বড় করেছেন এবং আমরা পেয়েছি একটা লৌহবর্ম জীবন।

এই জীবন আমাদের শিক্ষা দিয়েছে প্রতিটি পরিচ্ছন্ন ঘরেই খালি পায়ে প্রবেশ করা যায়। স্টাটাসভেদে কোথাও জুতা পায়ে, কোথাও খালি পায়ে প্রবেশ করা যায় না। এই জীবন আমাদের শিক্ষা দিয়েছে রোদ ঝড় বৃষ্টিতে বাসে ঝুলে ঝুলে গন্তব্যে পৌছাবার। শিক্ষা দিয়েছে বয়সে বড় মানেই গুরুজন। এবং পরিবারের বয়জেষ্ঠ্য মানেই সে অধিকার রাখে ভুল দেখলেই আমাদের দুইটা ধমক দেয়ার।

কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছে এইসব প্যারেন্টিং। এখনকার বাচ্চারা বড্ড অভিমানী, বেজায় রকম চুজি, প্রচণ্ড রকম আত্বসম্মানধারী এবং ছোট থেকেই তারা অধিকার সচেতন। যুগের সাথে, সময়ের সাথে,শতাব্দীর সাথে পরিবর্তনের হাওয়া আগেও এসেছে, ভবিষ্যতেও আসবে। কিন্তু এই হাওয়ায় যেনো হারিয়ে না যায় এই যুগের সন্তানদের স্বাভাবিক মৌলিকতা। নিজেদের ইনডিভিজুলাইটির চর্চা করতে করতে তারা যেনো হয়ে না পরে প্রকট রকম বাক্সবন্দী কিংবা প্র‍য়োজনের চেয়ে বেশি আত্বসম্মান বাহক। স্পষ্টবাদী হওয়ার নামে যেনো হয়ে না যায় উদ্ভট রকম বেয়াদব কিংবা অহংকারী…।

অটুট থাকুক তাদের মাঝে সৌজন্যবোধের চর্চা, পারিবারিক নীতিবোধ আর ইতিবাচকতা। জীবন কে ভাবুক তারা বক্র নয় বরং সরল রেখার ন্যায়।

 

 

লেখিকাঃ ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী, শিক্ষক, ডিপার্টমেন্টে অফ সিএসই, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

 

 

 

 

কিউএনবি/বিপুল/০৮.১০.২০২২/ রাত ৮.৫৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit