শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০৫ পূর্বাহ্ন

শামীমা আক্তার এর জীবনালেখ্যঃ শূন্যতা

শামীমা আক্তার। ইডেন কলেজের দর্শন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর।
  • Update Time : শনিবার, ২ জুলাই, ২০২২
  • ২২৩ Time View

শূন্যতা
——–
আজ পার্লারে ঢুকে আকাশলীনা একটু অবাক হোলো। যা ভেবেছিল সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। একেবারেই নীরব। খুব অল্পসংখ্যক ক্লায়েন্ট। লকডাউন হয়ে যাবে শুনছে কয়েকদিন থেকেই। সেজন্য প্রায় প্রতিদিনই ভাবে আজ যাবো, এমন করে করে আর যাওয়া হচ্ছিল না। ভীড়ের ভয়েই আরও যাচ্ছিল না। কিন্ত আজ একদম সকাল থেকেই ভেবেছে যাবেই যাবে।

আকাশলীনা কেন যেন ছোটবেলা থেকেই পায়ের নখ কাটতে পারে না। তখন আম্মু কেটে দিত আবার কখনও আব্বু। বাবা- মায়ের একমাত্র সন্তান সে। বড় হবার পর থেকে শুধু এই সার্ভিসের জন্যই পার্লারে যাওয়া হয় আকাশলীনার। কারণ আর কোন কিছুর প্রয়োজন হয় না ওর। মহান আল্লাহ ওকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন অপার সৌন্দর্য দিয়ে । বাবা- মায়ের অতি আদুরে মেয়ে সে। পড়াশুনাতেও তেমন তুখোড়। বাবা সরকারি কর্মকর্তা আর মা শিক্ষক। খুব ছিমছাম গুছানো সংসারে বড় হয়েছে আকাশলীনা। অনেক শখের মাঝে একটি ছিল বাগান করা। খুব ভালোবাসতো একটি বারান্দায় গাছ থাকবে আর সেখানে বসে চা পান করবে, বই পড়বে। বাবা ঠিক তেমনই একটি বারান্দা বানিয়েছিলেন মেয়ের জন্য। পুরো বিকেলটা ওখানেই সময় কাটাতো। গাছের সবরকম পরিচর্যা নিজ হাতেই করতো

দেখতে দেখতে পড়াশুনা কমপ্লিট হয়ে গেল। মেয়ে অন্য বাড়ি চলে যাবে ভাবতেই মা- বাবা দুজনেরই মন খারাপ হয়ে যায়। তবুও সমাজের নিয়ম মানতেই হবে। বেশ কয়েকবছর পর আকাশলীনার বাবার বন্ধু আফজাল সাহেব ঢাকা বদলি হয়ে আসেন। বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এসেতো মেয়ে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ এত বড় হয়ে গিয়েছে! আফজাল সাহেব সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন বন্ধুকে। বললেন তোর মেয়েকে এবার আমার মেয়ে করে ঘরে নিয়ে যাবো। কোন না শুনবো না। আমার ছেলে বুয়েট থেকে পাস করে ওখানেই আছে শিক্ষকতা পেশায়। তিনি নাছোড়বান্দা। একটু সময় চাইলেন মেয়ের বাবা । তারপর খুব দ্রুত সময়ে মাত্র ৭ দিনের মাঝেই বিয়ে হয়ে গেল পিয়াস এর সাথে আকাশলীনার। বিয়ের সময়ই প্রথম পার্লারে নিয়ে যাওয়া হয় ওকে। আর কখনও পার্টি মেকামও করে নি পার্লারে ।

আকাশলীনার বাবা ইসকান্দার সাহেব মেয়ের শ্বশুরালয়ের এক বারান্দায় ঠিক নিজের বাসার মতই একটি বাগান করে দিলেন। আস্তে আস্তে বাগানের সৌন্দর্য বাড়তে থাকে। পিয়াস বাসায় ফিরলে খুব সুন্দর সময় কাটায় দুজনে বারান্দা বাগানে। কথাপ্রসঙ্গে পিয়াসকে বললো লকডাউন হয়ে যাচ্ছে, আমি আগামীকাল একটু পার্লারে যাবো। তার বউ যে পায়ের নখ কাটতে পারে না তা এতদিনে বেশ জেনে গেছে। পিয়াস তাই বললো আসো আমি তোমার নখ কেটে দেই, তবুও এই সময়ে আমি তোমাকে বের হতে দেবো না। কথা শুনে হাসতে হাসতে বলে পাগলামি কথা বলবে না। তুমি নখ কেটে দিবে বাবা- মা একবার দেখলে কি ভাববে ভেবে দেখো তো। কিছুতেই আমি তোমাকে এ কাজ করতে দেবো না।

অগত্যা পরদিন সকালে স্বামী বেচারা বাধ্য হয়ে পার্লারে নামিয়ে দিয়ে বললো আমি এসে আবার তুলে নিয়ে যাবো তোমাকে। কাজ শেষ হলে কল দিও আমাকে। পার্লারে সবাই এসে কি সার্ভিস নিবে জানতে চাইলো।

আকাশলীনা বললো শুধু পেডিকিওর। একজন বললো আপু আপনার স্কীন কেমন ড্রাই হয়ে গিয়েছে। নুতন একটা হার্বাল ফ্রেসিয়াল এসেছে করে ফেলুন আপু। পেছন থেকে আর একজন বললো আপু সাথে মেনিকিওর আর হেয়ার ট্রিটমেন্টটাও নিয়ে নিন। সবার এত্ত কথায় ও বিব্রত হয়েও কেন যেন রাজী হয়ে গেল। কিন্তু সব সময় যার কাছে সার্ভিস নেয় তাকে পেলো না।

সবকিছু শেষ করতে অনেক সময় লেগে গেল। এর মাঝে তিনবার কল দিয়েছে পিয়াস। পিয়াসের মনে কেন যেন অস্থিরতা কাজ করছিল। এতবার কল আসাতে পার্লারের মেয়েরা বলছিল আপু ভাইয়া খুব ভালোবাসে আপনকে। আসলে তো অনেক ভালোবাসেই। কিন্ত ওদের মুখে শুনে খুব লজ্জা পাচ্ছিল। কাজ সেরে গাড়িতে উঠেই তাই পিয়াসকে বললো এতবার কেউ কল করে! আর কারও মনে হয় বউ নেই ঘরে। পিয়াস বলে আছে কিন্তু আমার আকাশলীনার মত একটিও নেই পৃথিবীতে।

ঘরে ফিরেই পিয়াস বললো কোন কথা নয় আগে শাওয়ার নাও। এরপর পিয়াসও শাওয়ার নিল। বাসার সবাই একসাথে লাঞ্চ করলো। বিকেলে পছন্দের বারান্দায় বসে কত গল্প করলো দুজনে। কথার ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প কাশি দিচ্ছিল আকাশলীনা। পিয়াস বললো কি ব্যাপার তোমার কাশি হচ্ছে কেন হুট করে! আরে কিছু না বলে উড়িয়ে দিলো সে ।

রাতে বিছানায় যাবার পর মাঝরাতে গা গরম অনুভব করলো আকাশলীনা। কিন্ত পিয়াসকে কিছুই বললো না। তখন সে ভাবলো পার্লারের কথা। সব পুরোনো মানুষগুলোকে ছাটাই করে অল্প বেতনে নুতন মানুষ নিয়েছে। তারা কতটুকু পরিচ্ছন্ন এবং এক্সপার্ট ছিল তাও তার জানা ছিল না। আর কেন ওদের কথায় এত সার্ভিসে রাজী হয়ে গেল।নিজের উপরই রাগ হচ্ছিল। সকালে ব্রেকফাস্ট শেষ করে কর্মস্থলে গেল। যাবার আগে বাসায় প্রয়োজনীয় কি লাগবে মা কে জিজ্ঞেস করলো।

দুপুরের দিকে প্রচন্ড শরীর ব্যথা শুর হোলো আকাশলীনার। সাথে হালকা টেম্পারেচার। পিয়াস বাড়ি ফেরার পর বললো না অসুস্থতার কথা। কারণ সে জানে এসব শুনলে পিয়াসের মাথা গরম হয়ে যাবে, ওর বাবা- মাকে জানাবে। ডাক্তার কল করবে। তাই চুপ করেই থাকলো। তৃতীয় দিন সকালে হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল খাবার টেবিলের পাশে। পিয়াস দৌঁড়ে এসেও ধরতে পারলো না। দেখলো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। দ্রুত পারিবারিক ডাক্তার কে কল করা হোলো। ডাক্তার বললেন কোভিড ১৯ আগে টেস্ট করাতে হবে। একথা শুনে পিয়াসের সমস্ত পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেল। মনে হোলো পার্লার ছাড়া তো আর কোথাও যায় নি। টেস্টের রিপোর্ট পাবার আগেই চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে ডাক্তারের পরামর্শে। রিপোর্ট পেতে ৪৮ ঘন্টা সময় লেগে গেল। এর মাঝে অবস্থার অবনতি হোলো এবং রিপোর্ট পজিটিভ আসলো।

আকাশলীনার মা- বাবা চলে আসলো পিয়াসদের বাসায়। সবাই স্থবির হয়ে বসে আছে। পিয়াস উন্মাদের মত হাসপাতালে একটি সিট খুঁজছে। কারণ ডাক্তার বলেছেন পেসেন্টকে যে কোন সময় হাসপাতালে নিতে হতে পারে। অনেক কষ্টে পিয়াস একটি সিট পেলো স্বনামধন্য এক হাসপাতালে। নিয়ে যাওয়া হোলো আকাশলীনাকে হাসপাতালে। কিন্ত পিয়াসকে কেউ শত চেষ্টা করেও হাসপাতাল থেকে আনতে পারলো না।
করোনা ইউনিটে কেউ যেতে পারে না। তবুও পিয়াস সারাদিন হাসপাতালের নিচে বসে থাকে। কথা বলে আকাশলীনার সাথে। পিয়াসকে বারান্দার বাগানের কথা জিজ্ঞেস করে। উত্তরে বলে সব ঠিক আছে। ও যে বাসায়ই যায় নি আর সে কথা বলেনি আকাশলীনাকে। সাত দিনের দিন কল আসে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছে অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে পেসেন্টের। এ সংবাদ পেয়ে পিয়াসের মা- বাবা,আকাশলীনার মা- বাবা ছুটে আসেন হাসপাতালে।

সব বুঝেও তারা আজ অবুঝের মত হাসপাতালে এসেছেন। এক সময় আত্মীয় – স্বজনরা কল করে বুঝিয়ে উনাদের বাসায় ফেরার ব্যবস্থা করেন। কিন্ত পিয়াস কে নেয়া গেলো না বাসায়। অক্সিজেন মাস্ক খুলে আকাশলীনা কল করে বলে আমাদের বাসার ‘হোম সুইট হোম ‘ লেখাটি কি আছে। পিয়াস বলে আছে,আছে সব আছে। শুধু তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসো আমার কাছে। কথা শেষ না হতেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে লাইফ সাপোর্টে চলে যায় আকাশলীনা।

আজ অসুস্থতার দশ দিন। খবর এলো আকাশলীনা এখন লাশ। পিয়াসের চিৎকারে পুরো হাসপাতাল কেঁদে উঠলো।
সবই আছে। সেই বারান্দা বাগান, ‘,হোম সুইট হোম’ লেখা বোর্ড। শুধু আকাশলীনা নেই। বারান্দায় আছে একটি শূন্য চেয়ার।

 

 

লেখিকাঃ শামীমা আক্তার। ইডেন কলেজের দর্শন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে অনার্স /মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। চমৎকার লেখালেখির পাশাপাশি দারুন আবৃত্তি চর্চাও করেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়েছে । বর্তমানে ভার্চুয়াল গ্রুপ গুলোতে অবসরে লিখতে পছন্দ করেন।

 

কিউএনবি/ বিপুল/ ০২.০৭.২০২২/ রাত ১১.৪২

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

December 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit