ডেস্ক নিউজ : তিনি শুধু একজন ধর্মীয় নেতা নন; ছিলেন শিক্ষাবিদ, নৈতিকতার দিকনির্দেশক, সমাজসংস্কারক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা। তাঁর শিক্ষা–পদ্ধতি ছিল সহজ, গভীর, মানবিক এবং সময়োপযোগী। যার শিক্ষায় গড়ে উঠেছিল এমন এক প্রজন্ম, যারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে, অন্ধকারচ্ছন্ন সমাজকে আলোর পথ দেখিয়েছিল। তাই বলা হয়, তিনি শুধু ‘জ্ঞানদাতা’ নন, বরং ‘জীবনের শিক্ষক’। তার শিক্ষা পদ্ধতি আজও বিশ্বমানের যেকোনো শিক্ষকতার মডেল হিসেবে কার্যকর।
তৎকালীন জাহেলি যুগে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন-শিক্ষক রুপে। সে কথা নবীজি নিজেই বলেছেন-আমি প্রেরিত হয়েছি শিক্ষক রুপে। এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলেন । ফলে জাহেলি যুগ হলো, সোনালী যুগ।আর অসভ্য মানুষ হলো আদর্শ মানুষ।তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা, মক্কার দারুল আরকাম এবং মদিনা শরীফের মাদরাসাতুস্সুফ্ফাহ । তাঁর ছাত্র ছিলেন, হযরত সাহাবায়ে কেরাম রিজওয়ানুল্লাহি আজমাইন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছিলেন ছাত্রদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তারা তাঁকে ভালোবাসতেন, নিজের চেয়েও বেশি। তিনিও তাদের ভালোবাসতেন। তাদের সঙ্গে মিশতেন, রসিকতা করতেন। সাহাবীরা তাঁর কাছে মন খুলে নিজের সব কথা বলতেন। আর নবীজি একজন পিতার মতো তাদের সবকিছু শেখাতেন। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য।
তোমাদের আমি দ্বীন শিক্ষা দিয়ে থাকি। তোমাদের কেউ পায়খানায় গেলে কেবলামুখী হয়ে বসবে না। এবং কেবলার দিকে পিঠ দিয়েও বসবে না। ডান হাতে শৌচ করবে না। তিনি তিনটি ঢিলা ব্যবহারের নির্দেশ দিতেন। এবং গোবর ও হাড় ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস :৮) এভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ছাত্রদের সবকিছু শেখাতেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিতেন খুব সহজ ভাষায়, যাতে অশিক্ষিত মানুষও বুঝতে পারে। তিনি দ্রুত বা জটিল ভাষায় কথা বলতেন না।আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন-রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা এত সুস্পষ্ট ছিল যে প্রত্যেক শ্রোতা তাঁর কথা বুঝত (আবু দাউদ : ৪৮৩৯)। তিনি আরো বলেন-রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে কথা বলতেন যদি কোনো গণনাকারীর গণনা করতে ইচ্ছা করে তবে সে গুনতে পারবে (মুসলিম : ৭৩৯৯)
এতে বোঝা যায়, তিনি শিক্ষাকে সহজ ও গ্রহণযোগ্য করার ওপর গুরুত্ব দিতেন। এছাড়া তাঁর ভাষায় ছিল মধুরতা ও ভালোবাসা। একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় গুণ হলো কোমল আচরণ নবীজি সেই গুণে ছিলেন অতুলনীয়। মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। যে ভুল করে না সে মানুষই নয়-ফেরেশতা।একারনই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরা যখন কোন ভুল করতেন, তিনি কখনো তাদের সঙ্গে রাগারাগি কিংবা তিরস্কার করতেন না। বরং বুঝিয়ে বলতেন। হাদীস শরীফে আছে -একদিন এক বেদুইন দাঁড়িয়ে মসজিদে প্রস্রাব শুরু করল।
উপস্থিত লোকজন দেখে তাকে বাধা দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন, ওকে ছেড়ে দাও। ওর প্রস্রাব শেষ হলে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ো। (বুখারি শরিফ: ২২০) এরপর তিনি বেদুইনকে স্নেহভরে শেখালেন মসজিদের আদব।সে কথা বেদুইন নিজেই বলেছেন- হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে আমার মা-বাবা উৎসর্গিত, তিনি তখন আমার নিকট এলেন। কিন্তু আমাকে ধমকও দেননি, শাসিয়েও কিছু বলেননি, শুধু এইটুকু বললেন, এই মসজিদে তো প্রস্রাব করা যায় না, এটা বানানো হয়েছে আল্লাহতায়ালার জিকির ও নামাজ আদায়ের জন্য। এরপর তিনি এক বালতি পানি আনতে বললেন। তখন তা প্রস্রাবের ওপর ঢেলে দেওয়া হলো। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৫২৯)
এই হাদীস আজকের শিক্ষকদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমাদের অনেক শিক্ষক এমন আছেন, যারা ছাত্রদের সামান্য ভুলও ক্ষেপে যান, তাদের তিরস্কার করেন। ফলে এটাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, কখনো তা বেয়াদবিতে রূপ নেয়। অথচ শিক্ষক যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন, তবে হয়তো এমনটা হতো না। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিতেন উদাহরণ,ও উপমা দিয়ে, যা বিষয়কে মনে গেঁথে দিত। যেমন, তিনি বললেন— এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য অট্টালিকার ন্যায়, যার এক অংশ অন্য অংশকে মজবূত করে রাখে। তারপর তিনি (বুঝাবার জন্য) তাঁর এক হাতের আঙ্গুলগুলিকে অপর হাতের আঙ্গুলগুলির ফাঁকে ঢুকালেন। (বুখারি ৪৮১, মুসলিম ৬৭৫০)
আরেকটি হাদিস শুনুন!হযরত আবুযর গিফারি রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একবার শীতের সময় যখন গাছের পাতা ঝরে পড়ছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে তশরীফ আনলেন এবং একটি গাছের দুটি ডাল ধরে ঝাঁকি দেয়া শুরু করলেন, এবং ঝরঝর করে (শুকনো) পাতা পড়তে লাগলো। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবু যর! যখন কোন মুসলমান একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকতার সাথে নামায পড়ে, তখন তার গুনাহ ঠিক এভাবে ঝরে পড়ে, যেমন এ গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়ছে।(মুসনাদে আহমদ: ২১৫৯৬)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তি পরিস্থিতি হিসেবে শিক্ষা দিতেন। যেমন-কোনো ব্যক্তি এসে জানতে চাইল, কোন আমল সবচেয়ে উত্তম ?তখন নবীজি পরিস্থিতি ও ব্যক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিয়েছেন, কখনো সালাত, সদকা, হজ। কখনো জিহাদ, কখনোবা পিতা–মাতার সেবা।অর্থাৎ ব্যক্তিকে যে বিষয়ে কমতি দেখতেন। তাকে সেই কাজ করার দিকনির্দেশনা দিতেন। কিংবা যখন যে পরিস্থিতি আসতো। তখন সে কাজ করার দিকনির্দেশনা দিতেন। যাতে ব্যক্তি সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু উপদেশ দিতেন না; নিজেই ছিলেন তার সর্বোত্তম অনুসরণযোগ্য উদাহরণ।কোরআনে বলা হয়েছে
নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলের উত্তম আদর্শ। (সূরা আহজাব, আয়াত:২১) তিনি যেসব নৈতিকতা শেখাতেন, সত্যবাদিতা, নরম ব্যবহার, দানশীলতা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়। তিনি নিজেই ছিলেন সেগুলোর প্রতিমূর্তি । অতএব, তাঁর শিক্ষা শুধু কথার নয়; কর্মের শিক্ষা।শিক্ষার্থী প্রশ্ন করলে নবীজি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। অতঃপর উত্তর দিতেন, কখনো উপহাস করতেন না। কিন্তু কখনো কখনো নিজেই প্রশ্ন করে শিক্ষা দিতেন।
একবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, গাছপালার মধ্যে এমন একটি গাছ আছে, যার পাতা ঝরে পড়ে না। এবং তা হল মুমিনের দৃষ্টান্ত। তোমরা আমাকে বলতে পার, সেটা কোন গাছ? অতঃপর লোকজনের খেয়াল জঙ্গলের গাছ পালার প্রতি গেল। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনই আমাদের তা বলে দিন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তা হল, খেজুর গাছ। (মুসলিম, হাদীস:২৯৯) এর মাধ্যমে তিনি চিন্তা–শক্তি জাগ্রত করতেন।
শিক্ষক হিসেবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন, এক অনন্য প্রতিভা ও অনুপম আদর্শ। তিনি কোমলতা, ধৈর্য, উদাহরণ, ভালোবাসা, যুক্তি, প্রশ্নোত্তর, দৃষ্টান্ত, বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার এবং ব্যবহারিক আচরণের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষা ছিল মানবিক, নৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবসম্মত, যা আজকের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুতরাং আজকের শিক্ষকরা যদি নবীজির শিক্ষা-পদ্ধতির অনুসরণ করেন, তবে শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষায় নয়, জীবনেও সফল হবে, হবে নৈতিক ও মানবিক সমাজের নির্মাতা। নবীজি সত্যিই ছিলেন, সমস্ত যুগের সর্বোত্তম শিক্ষক। লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম রামপুরা (বনশ্রী মাদরাসা) ঢাকা
কিউএনবি/আয়শা/০৪ ডিসেম্বর ২০২৫,/রাত ৮:৩০