সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১৯ পূর্বাহ্ন

একটি ধার করা জামা ও ত্রিশটি জুতোর বারী

সাবিনা ইয়াসমিন সুরভী। ব্যাবস্থাপনা পরিচালক সিসবা ট্রেড ব্র্যান্ডিং লিমিটেড, ঢাকা।
  • Update Time : শনিবার, ২ জুলাই, ২০২২
  • ৮৫০ Time View

একটি ধার করা জামা ও ত্রিশটি জুতোর বারী
——————————————————

২০০৩ সালে ক্লাস সেভেন এ পড়ি তখন। স্কুলে খেলাধুলায় বরাবরই ভালো করতাম। মাঝে মধ্যেই পিটি করতাম । সেই বছর আমাদের স্কুল থেকে স্কাউট এ যাবার জন্য বাছাই পর্ব চলছে, আমার নামতো অবশ্যই আছে। সব সিনিয়র আপুরা, সেই সঙ্গে আমাদের ক্লাস থেকে আমি আর আমার বন্ধু নাঈমা।

সবাই খুব খুব খুশি,অন্য রকম এক প্রিপারেশন। আমিও মহাখুশি, স্কাউটিং এ যাবো। আমার দাদি আবার খুব খুশি মনে আমাকে যেতে এলাউ করতো সব সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সবই ঠিকঠাক, প্রব্লেম হলো ড্রেস আর জুতা নিয়ে। স্কুলেতো প্রতিদিন একটা ইউনিফর্ম পড়েই যেতাম কিন্তু স্কাউট এ গিয়ে অবসর সময়ে সবাই যখন সিভিল ড্রেস পড়বে আম কি পড়বো? আমারতো কোন নতুন ভালো জামা বা জুতা নেই। আমি বেশিরভাগ সময় শামীমা ফুফু, সালমা ফুফু, নাজনীন, সুম্মি অ্যান্টি, শাম্মী, উনাদের ব্যাবহৃত জামা আমাকে দিতো ঐগুলোই সব সময় পড়তাম। তবে বছরে এক দুইবার আমার কাকু দাদী আমাকে ড্রেস বানিয়ে দিতো। কিন্তু এক দুইটা জামা নতুন পেয়ে মানুষকে দেখানোর জন্য একসাথে পরে একদম তেনা তেনা করে ফেলতাম।

যাহোক স্কাউট এ তো আর পুরাতন জামা পরে যাওয়া যাবেনা। হাই স্কুলের ছেলেরাও যাবে। তার মধ্যে কেউ কেউ আবারউঁকি দিয়ে দেখে মাঝে মধ্যে। এই তাদের সাথে স্কাউট এ গিয়ে যদি ভালো একটা ড্রেস না পড়ি প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাড়াবে। এখন স্কাউট এ যাওয়ার জন্য ভালো জামা জুতা কোথায় পাবো ? আমার আম্মা তখন হেলেন বুবুকে বলে সখিনা ফুফুর কাছ থেকে একটা ভালো জামা এনে দিয়েছে। আমি খুব খুশি। তারিখ অনুযায়ী আমরা আখাউড়ার গোপীনাথপুর স্কুলে স্কাউটিং এ চলে গেলাম। স্কাউট এ গিয়ে সিভিল ড্রেসের টাইমে দুই তিনবার ওই জামাটা পড়েছি। কারণ ভালো জামা তো আর ছিলনা। অবশ্য ওই জামাটার পাশাপাশি আমার বন্ধু নাঈমার কাছ থেকেও একবার কিছুক্ষণের জন্য একটা জামা পড়েছিলাম ।

স্কাউটিং এ প্রত্যেকটা খেলায় পাশ করলে একটা করে স্টিকার অর্জন করা যায়। ওই স্কাউটিং এ আমিই সবচেয়ে বেশি স্টিকার অর্জন করেছিলাম। স্কাউটিং শেষে বাড়ি এসে আমার দাদীকে সার্টিফিকেট দেখালাম এবং সার্টিফিকেটে প্রত্যেকটা খেলায় স্টিকার অর্জন করা দেখে না বুঝেও আমার দাদী খুব খুশি হয়েছিল। বাড়িতে বাড়িতে হেঁটে হেঁটে সবাইকে দেখিয়ে ছিলো।

এখন যার কাছ থেকে যা নিয়েছিলাম তা ফেরত দেবার পালা। পরদিন রাতে সখিনা ফুফুর জামা আর সালমা ফুফুর জুতা ফেরত দিয়ে আসলাম। জামা ফেরত দিয়ে আসার পরদিন সকালে সখিনা ফুফু, তার বোন মুছেনা এবং তার আম্মা এসে আমার আম্মাকে বলতেছে, জামা কাপড় পরানের ক্ষমতা না থাকলে বাচ্চা পয়দা করছো কেনো? তোমার মাইয়া জামাটা নিয়ে নষ্ট করে এনেছে। আমার আম্মা বললো একবার পড়েই নষ্ট করে ফেললো? জামা মনে হয় আগেই নষ্ট ছিলো। এই কথা বলার পর জামার মালিকগণ শুরু করলো তুমুল ঝগড়া, চিৎকার চেঁচামেচি। আশে পাশের সব মানুষ বাড়িতে এসে হাজির। তখন যেই কমন কথাগুলো শুনেছিলাম তা হলো, ভাত খাইতে পায়না তার আবার পড়াশুনা কেনো ? কাপড় পড়াইতে না পারলে লেংটা রাখলেই চলে। আমার দাদীর সেই কি কান্না এসব শুনে। তাদের বকাবকি আর মানুষের কথা শুনে প্রথমে আমার দাদী দিলো আমাকে মাইর। দাদী আমাকে মারলো কেনো এই রাগে আম্মা আমাকে মাইর। আম্মার মাইর ছিলো সবচেয়ে বাজে, ধপাস ধপাস চর। হাতে মারতে মারতে হাত ব্যাথা হলেতো কথাই নাই, হাত পাখা, চামচ, ঝাড়ু যা আছে সব ব্যাবহার করত। মাইর এর পর্ব এখানেই শেষ না, আসল মাইর শুরু হলো তখন , যখন আমার কাকু ঘুম থেকে উঠলো। আমার মেঝ কাকু রাতে দেরি করে ঘুমানোর কারণে সবসময় সকালে আটটা পর্যন্ত ঘুমাতেন। কিন্তু সেইদিন এই ঝগড়াঝাঁটি আর চিৎকার এর শব্দ শুনে উঠে পড়লো, আসলে আমার কাকু জানত না যে আমি স্কাউটিং এ যাওয়ার জন্য ধার করে জামা নিয়েছিলাম। কাকু সব কিছু শোনার পর কাঠের এক জোড়া জুতা কিনে এনেছিলাম স্কাউট ক্যাম্প এর মেলা থেকে ৩০ টাকা দিয়ে, সেই কাঠের জুতা দিয়ে যতক্ষণ কাকু ক্লান্ত না হল ততক্ষণ মারলোআমাকে। প্রায় ২০ কিংবা ২৫ টা বারী তো হবেই। বেশির ভাগ মাইর পিঠের একই জায়গায় পড়েছিল বলে পিঠে কালো কালো রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল।

আমার কাকু আসলে উনাদের কথায় অপমানিত হয়েই মেরেছিল । আমার কাকু আমাকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু অপমানটা তিনি হজম করতে পারেন নি। সেইদিন সেই মাইর খাওয়া পর প্রায় এক মাস আমার জ্বর ছিলো। এক মাসের মধ্যেই কোন এক সময় আমার ছোট কাকু আর চাচী ঢাকা থেকে বাড়ি গিয়েছিল বেড়াতে। তখন আমার দাদু কথায় কথায় আমার ছোট কাকু আর চাচীকে আমার অসুস্থ্যতার কথা জানালো। কি ভাবে, কি কারণে মাইর খেয়ে আমি অসুস্থ্য তা বললো। সেই সুযোগে আমার ছোট কাকু বললো, আর পড়াশুনার কি দরকার, ঢাকায় আমাদের বাসায় দিয়ে দাও, লাগলে ওইখানে পড়াবো। যদিও আমার মেজো কাকু রাজি ছিল না তবু বুবু রাজি। আমার ছোট কাকুর সাথে চলে আসলাম ঢাকায়।

ঢাকায় আসার পর আমার ছোট চাচী তার ব্যবহৃত দুইটা জামা ছোট করে আমাকে পড়তে দিয়েছিল। অবশ্য বাসার কাজের বুয়াদের এর চেয়ে ভালো জামা থাকে। আমি তাতেই খুশি ছিলাম। তখন খুব বেশিদিন ঢাকায় থাকিনি। আমার দাদী কয়েকমাস পরেই আমাকে গিয়ে নিয়ে আসলো এবং আমি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করি। তবে যেই কয়েকটা মাস আমার পড়াশুনা বন্ধ ছিলো সেই কয়েকমাস প্রতিদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখতাম, বড়ো হয়ে চাকরি করে আমিও ভালো নতুন জামা পরবো। আমারও অন্যের মতো অনেক জামা থাকবে। সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের জামা থাকবে।

সেই স্বপ্ন থেকে কাগজ কেটে কেটে নিজে নিজে কতো শত ভুংভাং জামার ডিজাইন বানাতাম তার কোন ইয়ত্তা নেই। ডিজাইনার হওয়ার জন্যে জীবনের কত শত রাত না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুধু কাগজ কেটে কেটে জামার ডিজাইন বানাতাম তার হিসাব শুধু আমার কাছেই আছে। আমার স্বপ্ন আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। সেই স্বপ্ন কিছুটা ডিজাইনার বানিয়েছে। এখনো সফলতা অনেক দূরে। আরো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে ,অর্জন করার বাকি আছে অনেক কিছুই।

আমি এ পর্যন্ত ৫৪৩ টি ড্রেসের ডিজাইন করেছি। একেকটি ডিজাইনের ১০০০ অথবা বেশি কোয়ান্টিটির প্রোডাক্ট হয়। আমার নিজস্ব একটি ছোট রেডিমেড গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে।

 

পাদটীকাঃ আমার স্বপ্ন পূরণের পেছনে আল্লাহর রহমতে একজন মহান মানুষের সাপোর্ট এবং অনুপ্রেরণা আমাকে উঠে দাঁড়ানোর ফাউন্ডেশন তৈরি করে দিয়েছে।

আমার নিজস্ব ডিজাইন কৃত লেডিস ডিজাইনের ড্রেস জাপান, দুবাই, আমেরিকা, ইন্ডিয়াতে এক্সপোর্ট করি। এছাড়া ও বাংলাদেশে এপ্রক্সিমিটলি ৩৫ টি স্টোরে এ আমার ডিজাইন কৃত লেডিস ডিজাইনার ড্রেস সেল করা হয়।

ইয়াসমিন সুরভী’র ডিজাইনকৃত ড্রেস।

এখন শুধু একটা জামা না, আমি চাইলে প্রতি মিনিটে একটা করে নতুন নতুন জামা পড়তে পারি আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমি তা করিনা, আমার মনে পড়ে যায় সেই করুন কাহিনী গুলো। আমি চেষ্টা করি আমার জানা মতে বা পরিচিত কেউ যেনো এই যুগে এসেও আমার মত ধার করে জামা পড়তে না হয়। আমি কাউকে পুরাতন জামা ধার দেই না। প্রতিদিন কাউকে না কাউকে আমি ড্রেস উপহার দেওয়ার চেষ্টা করি এবং সারাজীবন চেষ্টা করব যদি আল্লাহ্ আমাকে সেই সামর্থ দান করেন।

ইয়াসমিন সুরভী’র ডিজাইনকৃত ড্রেস।

পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আল্লাহ্ রহমতে স্বপ্ন মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে সব কিছু সম্ভব, শুধু মাত্র স্বপ্ন দেখতে হয়, লক্ষ স্থির করতে হয় এবং পরিশ্রম করতে হয়।

স্বপ্নকে বাস্তব করার জন্য কোনও জাদুমন্ত্র নেই। স্বপ্নকে বাস্তব করার জন্য শ্রম, ঘাম আর ইচ্ছাকে কাজে লাগাতে হয়। স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করতে ৪টি জিনিস প্রয়োজন; ইচ্ছা, আত্মবিশ্বাস, সাহস আর নিয়মিত কাজ করা।

 

জীবন পুস্পসজ্জা নয়! যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, দেখা হবেই বিজয়ে।

 

 

লেখিকাঃ সাবিনা ইয়াসমিন সুরভীব্যাবস্থাপনা পরিচালক সিসবা ট্রেড ব্র্যান্ডিং লিমিটেড, ঢাকা। তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে লেখাটি সংগৃহিত।

কিউএনবি/ বিপুল/ ০২.০৭.২০২২/দুপুর ২.৫২ 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit