আমি এক আজন্ম উলা
—————————-
আমার বয়স তখন পাঁচ বছর সম্ভবত। আমাদের পিছধর এ হাসেম দাদার রান্না ঘরের চাল থেকে বৃষ্টির পানি পড়ে আমাদের দুইটা তিন মুখা চুলায় বন্যার সৃষ্ঠি হয়েছিলো।
পিছধর কথাটি অনেকেরই অপরিচিত হতে পারে। বর্তমানে ড্রইং রুমকে আমরা আগে বলতাম হমুকধর, ডাইনিং রুমকে বলি পিছধর।
যখন অতিরিক্ত পানি জমে রান্না ঘর, পিছধর একদম ভেসে গেলো, রান্না ঘরের সামনে একটু খোলা জায়গায় আমি হাঁটতে গিয়ে কাদায় পা পিছলে পরে যাই। এই পরা যেমন তেমন পরা না, একদম উলটপালট হয়ে গিয়ে পড়েছি ঐ তিনমুখি চুলার উপর। চুলাটা ভেঙে গিয়ে মাটির সাথে মিশে সমান হয়ে গেল।
তিন মুখী চুলা মানে, মাটির তৈরী বড় এক চুলা যেইখানে বড় বড় তিনটা মুখ থাকে। সেখানে একসাথে তিনটা বড় পাতিল বসিয়ে মূলত ধান সেদ্ধ করার কাজে ব্যাবহার করা হত। ঐ সময়টা ছিল বর্ষা কাল। বাড়ি ভর্তি ধান ছিল। আমাদের নিজেদের কোন জমি ছিল না। আমার দাদা অন্যের জমি চাষ করে ধান বুনত এবং সেই ধান রেডি করে অর্ধেক জমির মালিককে দিত, আর অর্ধেক আমরা পেতাম।
যাই হোক ওই সময়ে ওই তিনমুখী চুলায় আমি আছাড় পড়ে ভেঙে চুরমার করলাম। এখন ধানই বা কোথায় সেদ্ধ করবে? আমার পা ছুলে গেছে, নাক ভেঙে গেছে, আর ডান হাতে বরুই গাছের কাটা বিধেছে। সব গুলো জখমই হালকা ছিল। আমি কাঁদছি। সেই কান্না ব্যাথায় নয়, চুলা নষ্ট করার ভয়ে।
সেই সময় আমার দাদী হাসেম দাদাকে ডেকে বললো, হাসেম তোর বড়ই গাছের ডাল গুলা কাট। কাটা এসে আমার বাড়িতে পড়ে। এই কাঁটা নিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছে। এই বিষয়ে কথা কাটাকাটি করতে গিয়ে বিরাট ঝগড়া লেগে গেল। বলে রাখা ভালো হাসেম দাদা আমার দাদীর চাচাতো ভাই। শুধু দাদা নয়, দাদার বউ মেয়ে যারা আছে সবাই মিলে ঝগড়া। তখন আমার দাদাভাইও ঝগড়া করতে গিয়েছে, কিন্তু হটাৎ করে একজন বলে উঠলো, এই তুমি তো ”উলা”, তুমি এত কথা বলো কেনো। উলা শব্দটা আগেও কয়েকবার শুনেছি কিন্তু সেই প্রথম আমি উলা শব্দটাকে সিরিয়াসলি নিলাম।
উলা আসলে কি, আমাদের দাদাভাইকে কেন মানুষ এইটা বলে ? তার মানে আমি আস্তে আস্তে একটু বড়ো হচ্ছিলাম । আবার ভুলেও গিয়েছি। কিছুদিনের মধ্যেই আমি পুকুরে গোসল করতে গিয়ে কাদা ছুড়াছুড়ি খেলতে গিয়ে কোন একজনের কানে কাদা ঢুকিয়ে দিয়েছি। দুর থেকে ঢিল দিয়েছি সে পালাতে চেয়েছিল, হয়তো সে কারণে ঢিল গিয়ে টপ করে পড়ল তার কানে। সে তো চিৎকার শুরু করলো। আমি ভয়ে একদম পুকুরের মাঝখানে চলে গেলাম।
যার কানে কাদা ঢুকেছে তার মা গাছ থেকে আম পাড়ার এক ইয়া বড়ো লাঠি নিয়ে পানিতে বারি দিচ্ছে আর আমাকে কাছে আসতে বলতেছে। আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে আমি উনার কাছে যাবো। যেই বাড়ি উনি পানিতে মারতেছে সেই একটা বারি যদি আমাকে দেয়, তাহলে সোজা আমি জমের দুয়ারে এ যাব।
আমি কিছুক্ষন ডুব দিয়ে পানির নিচে লুকিয়ে থাকি আবার আস্তে করে মাথাটা তুলে দেখি আছে না গেছে। কতক্ষনই বা সাঁতরিয়ে থাকা যায়, আস্তে আস্তে লুকিয়ে লুকিয়ে পুকুরের অন্য পার আসলাম। ঠিক ওই সময় উনি চিৎকার করে আমাকে বললো, ওই উলার জাত ডরাস কেরে , আয় এইখানে, উলার্ গুষ্টির কইলজা কতটুকু দেখতাছি। আমার ভেজা শরীর, আধ ঘন্টা পানিতে, আবার মাথা ফাটার ভয় কিন্তু উলা শব্দ শুনে অটোমেটিক্যালি রাগ চলে আসলো, ভাবলাম উলা এই উলাটা কি ?
এরই মধ্যে সেই মহিলা আমার দাদীর কাছে বিচার দেওয়া শেষ করেছে। যাহোক বুক ভরা ভয় আর্ ক্ষুধা নিয়ে কিছুক্ষণ পুকুর পরের বাঁশ ঝাড় এ বসে কাপড় শুকিয়ে গেলাম মলিনা বুবুর বাড়ি। পেটে অনেক ক্ষুধা। শামীমা ফুফুর সামনে গিয়ে দরজায় একটু দাড়িয়ে থাকলে শামীমা ফুফু জিজ্ঞেস করবে, কিরে ভাত খাবি? মলিনা বুবু শামীমা ফুফু’র মেয়ে। আমাদের বাড়ির পাশেই তাদের বাড়ি।
ঠিক তাই করলাম, দরজায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলাম। ফুফুও জিজ্ঞেস করলো, ভাত খাস নাই ? খাবি ? আমি বললাম ‘হ’। ভাত খাওয়ার সময় ফুফুকে জিজ্ঞেস করলাম ফুফু উলা কি ? সবার আমাদেরকে উলা বলে কেন? ফুফু বলল তুই ছোট মানুষ, এইগুলা জানার দরকার নাই। তখন মনে আরো সন্দেহ সৃষ্টি হল। জানতেই হবে আমাকে। পরে মলিনা বুবু শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ উনার পা টিপে দিলাম, আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, বুবু উলা কি, বুবু বলল, উলা মনে ঘর জামাই। এখন আবার আরেক সমস্যা সৃষ্টি হল, ঘর জামাই আবার কি ? জিজ্ঞেস করলাম বুবুকে। বুবু বললো ঘর জামাই মানে কোন বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করে জামাইয়ের বাড়িতে না নিয়ে যদি জামাই আইসা বউয়ের বাড়িতে থেকে যায় তাহলে তাকে ঘর জামাই বলে। তাইলে উলা আর ঘর জামাইয়ের মধ্যে পার্থক্য কি? পার্থক্য হইলো, ঘর জামাই কিছুটা ভালো শব্দ আর উলাটা খুব খারাপ শব্দ মনে অসম্মান করা, এক প্রকার গালি। আমি বললাম এইটা কি আমার দাদা ভাইয়ের বাড়ি না ? মলিনা বুবু বললো না, তোমার দাদীর কোন ভাই নাই দেখে তোমার দাদী এইখানে রয়ে গেছে আর তোমার দাদা তার বাড়ি বিক্রি করে এইখানেই আছে। আল্লাহ্ তাইলে আমার দাদার বাড়ি কই? যাহোক এখন আমার কাছে ক্লিয়ার উলা আসলে কি।
আগে উলার মনে জানতাম না বলে কানে এই শব্দটা এত গুরুত্ব দিয়ে শুনতাম না। সেইদিন থেকে প্রায় প্রতিদিনই এই শব্দ টা শুনি। আমার আব্বাকে শুধু শুধুই গালি দিতো উলার পুত বলে। আমার দাদাকে বলতো উলা, আমাদেরকে উলার বংশ। বলতো তোমরাতো এই সমাজের কেউ না. তোমরা উলা হয়ে আসছ, উলাই থাক। আমার দাদীর সাথে কেউ কিছু নিয়ে তর্ক লাগালেই এই কথা বলে ঘায়েল করত। আমার বাবা চাচাকে অযথাই সামান্য ব্যাপারে এই উলা শব্দ বলত। তোরাতো উলা, উলার পুতাইট, আমার মা চাচিকেও বলত, তোরা উলা, উলাই থাকবি। উলার বংশধর।
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ পার হয়ে গেল। দাদী মারা গেল, দাদা মারা গেল, বাবা মারা গেল, তবু আমাদের উলা শব্দ শুনা বন্ধ হলনা । এখনো আমার মা, আমার চাচি, আমার ভাইবোন যারা গ্রামে আছে, এই উলা শব্দটি তারা প্রতিনিয়ত কারও না কারও মুখে শুনছে।
আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, এই উলার বংশধর এখন সেই সমস্ত লোকদের পাশে দাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। তাদের উপকার করার তৌফিক দিয়েছে আমাকে। ভবিষ্যতে আরও চেষ্ঠা করব এবং আমরা আজন্ম উলাই থেকে যাব।
পরের জায়গা পরের জমিতে ঘর বানিয়ে আমরা পৃথিবীতে বেঁচে আছি । উলার মতই আমাদের আশ্রিত জীবন সকলের। এক অর্থে পৃথিবীর সকল মানুষই ”উলা”।
লেখিকাঃ সাবিনা ইয়াসমিন সুরভী। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, সিসবা ট্রেডিং লিমিটেড, ঢাকা। তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে লেখাটি সংগৃহিত।
কিউএনবি/বিপুল/২৩.০৬.২০২২/ সকাল ১১.৫০