প্রবাসী জীবনের গল্প
———————–
এক এক প্রবাসীর এক এক রকম গল্প হয়ে থাকে তাদের প্রবাসী জীবনে।
আমার প্রবাসী জীবনে অনেক ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে এখেছি, শুনেছি। আজকে আমি বর্ণনা করতে যাচ্ছি খুব কাছ থেকে দেখা এক প্রবাসী পরিবারের গল্প। কিভাবে তারা নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন পুরো ৩১ বছর ধরে!
১৯৯১,ওবায়েদ এবং শাহেদা, তাদের একমাত্র ছেলে যায়েদ, বয়স পাঁচ বছর। দেখতে ফর্সা, শুকনা আর গাল দুটো যেনো ঠিক লাল আপেল!
যায়েদ সব সময় অসুস্থ থাকতো, কিছুই খেতে চাইতো না আর শ্বাস কষ্টও ছিল খুব। ডাক্তার বলেছিলো সুস্বাস্থের জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যেতে। ওবায়েদ এবং শাহেদা ঠিক করলো ছেলেকে নিয়ে দেশের বাইরে বেড়াতে যাবে, তাতে যদি ছেলের স্বাস্থের কোনো পরিবর্তন আসে!
ঠিক করলো আমেরিকা যাবে। সেখানে তাদের আত্মীয় স্বজন আছে সেই সুযোগে সবার সাথে দেখাও হয়ে যাবে!
যেই ভাবা সেই কাজ, পারি জমালো আমেরিকায়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ক্যানাডা থেকে যায়েদ এর চাচা এবং মামা দাওয়াত পাঠালো ক্যানাডা ঘুরে যাবার জন্য। যায়েদ এবং বাবা মা দাওয়াত পেয়ে কিছু দিন পর চলে এলো ঘুরতে ক্যানাডায়। চাচা, চাচী আর মামা তাদেরকে বিমানবন্দর থেকে বরণ করেনিলো। চাচী জিজ্ঞেস করলো “যায়েদ তুমি কি খাবে?” যায়েদের উত্তর ছিল “ডাল দিয়ে ভাত”।
এই প্রথম পাঁচ বছরের ছেলে নিজে থেকে ভাত খেতে চেয়েছে! সেই খুশিতে শাহেদা কান্নায় ভেংগে পড়লো। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর শাহেদা খেয়াল করলো যায়েদের স্বাশ কষ্ট একদম কমে গেছে! শাহেদা খুশিতে আত্মহারা! ছেলে সুস্থ হয়ে উঠছে! দিন দিন তাদের মনে ক্যানাডার জন্য ভালোবাসা বেড়েই চললো!
ছেলেকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন আর উচ্চ শিক্ষা উপহার দিতে ক্যানাডায় স্থানীয় হবে এমনটা ঠিক করে ফেললো তারা। প্রথমে একটা ইমিগ্রেশন উকিল নিতে হলো বেশ বড় রকম দিয়ে। যেনো লিগল ভাবে ক্যানাডায় থাকতে পারে সেই আশায়। মাসের পর মাস যাচ্ছে কিন্তু উকিল কাজ করছে না ঠিক করে। শুধু ঘুরাচ্ছে আর ডলার নিয়ে যাচ্ছে নতুন তারিখের জন্য। একদিন উকিল আশ্বাস দিলো কিছুদিনের মধ্যেই একটা ফাইনাল রেজাল্ট পাওয়া যাবে আর তার জন্য কিছু টাকাও লাগবে।
অনেক কষ্টে যোগার করলো উকিলের টাকা। কিন্তু আবারও মাস পার হয়ে যাচ্ছে, কোনো খবরই এলো না উকিল থেকে। ওবায়েদ গেলো উকিলের অফিসে, জানতে পারলো উকিল তার অফিস গুটিয়ে আমেরিকা চলে গেছে চির তরে। ওবায়েদ চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো, মাথায় যেনো তার আকাশ ভেঙে পড়েছে, সব শেষ হয়ে গেলো! দরকারি ডকুমেন্টস, পাসপোর্ট, টাকা পয়সা সব! ইচ্ছে করলেও আর দেশে যেতে পারবে না তারা! কান্নার রোল পড়লো পরিবার জুড়ে। থেকে গেলো ক্যানাডায় ইলিগেল হয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
যায়েদ স্কুল যাওয়া শুরু করলো। অত্যন্ত ভালো ছাত্র হিসেবে খেতাব পেতে থাকলো প্রতিটা ক্লাস থেকে বছরের পর বছর। ছেলের স্কুলের খরচ যোগার করতে ওবায়েদ এবং শাহেদা ছোট ছোট কাজ করতে লাগলো যেখানে যা পায়। তারা তাদের প্রাপ্য বেতন টুকুও পেতনা ক্যানাডায় লীগেল না বলে। এভাবেই চলতে থাকলো জীবন যুদ্ধ একমাত্র ছেলের জন্য।
যায়েদের ইউনিভার্সিটি ভর্তির সময় ঘনিয়ে এলো। অনেক টাকার প্রয়োজন! লিগেল না থাকার কারণে ক্যানাডা সরকার কোনো সুযোগ সুবিধাই দেবে না উচ্চশিক্ষার জন্য। শাহেদা, ওবায়েদ দিনরাত টাকা যোগারে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
অবশেষে যায়েদ ভর্তি হলো টরন্টোর শীর্ষ ইউনিভার্সিটিতে “University of Toronto” সাবজেক্ট “computer since”। প্রতি সেমিস্টারে তাকে তেরো হাজার ডলার জমা দিতে হবে ইউনিভার্সিটিতে, যার বাংলা টাকার পরিমাণ “নয় লাখ বাইশ হাজারের সমান”। তার উপর বই এর খরচ আলাদা।
এর মাঝে আবারো কয়েকজন উকিল ধরলো একের পর এক। সবাই টাকা নেয়, কিন্তু কাজ করে না কেউ ঠিক করে! এখানেও অনেক টাকা নষ্ট হলো তাদের। বলতে গেলে পুরো পুরি হাল ছেড়ে দিল। কখনোই বুঝি আর কিছুই হবে না এই দেশে তাদের!
বছর গড়াতে লাগলো। দেশে শাহেদা এবং ওবায়েদ এর অনেক নিকট আত্মীয় স্বজন, প্রিয় মুখ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে থাকলেন একের পর এক। বুকে পাথর চাপা দিয়ে সহ্য করে গেছে সব বেদনা। উড়ন্ত প্লেন দেখলেই কান্নায় ভেংগে পরে শাহেদা, ভাবে জীবনে বুঝি তাদের আর দেশে ফেরা হবে না! হয়তো এভাবেই একদিন তাদেরকেও চির বিদায় নিতে হবে এই পৃথিবী থেকে।
যায়েদ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হলো! এক সময় ভালো চাকরিও পেলো! এখন তিনজন মিলে চেষ্টায় নামলো লিগেল ভাবে ক্যানাডায় কিভাবে থাকা যায়। আবার তারা উকিল হায়ার করলো। কেস চলছে বছরের পর বছর। টাকা পয়সাও কম যাচ্ছে না উকিলের পেছনে!
২০২২, অবশেষে তারা ক্যানাডায় পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেলো। খুশি হয়েও যেনো খুশি হতে পারছে না কেউ! এতগুলো বছর! জীবন থেকে চলে গেছে শুধু এই একটা সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে!
পুরো ৩১ বছর পর, আজ তারা নিজের দেশের উদ্দেশ্যে পারি জমালেন। শাহেদা দেখতে পাবেনা তার বাবাকে, মা শয্যাশায়ী হয়ে আছেন! ওবায়েদ পাবেনা তার মা আর বড় ভাই বোনকে! তবুও তাদের দেশে যাওয়া! শুধু মাত্র মাটির টানে।
লেখিকাঃ রুপা মোজাম্মেল। কানাডা প্রবাসী। দেশে লেখাপড়া শেষ করে কানাডায় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স শেষ করেছেন। সেখানেই তাঁর কর্ম জীবন। লেখালেখি করেন নিয়মিত।
কিউএনবি /বিপুল/ ১০.০৬.২০২২/ রাত ১১.২৯