জীবন থেকে নেয়া
————————-
আজ হতে ৩০ বছর আগে, সবে মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে বের হয়েছি। বাল্যকাল থেকে আমার লালিত আকাংখাকে নিস্পেসনের জন্য তখনই আমার এক দিকে দাঁড়িয়ে গেল স্বজাত্ব বোধ ও ধর্মের দেওয়াল আর একদিকে দাঁড়িয়ে গেল আভিজাত্য ও অহংকারের দেওয়াল।
জীবনের তাগিদে আমার আকাংখার চারাগাছরুপি মানুষটা হাজার হাজার মাইল দুরে! কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে,তার বিদায়ের ক্ষণে ছোট্ট করে বলেছিলাম “হাসিব, অপেক্ষায় থাকব!” সেও ছোট্ট করে বলেছিল “বিশ্বাস রাখলাম!” কিন্তু অপেক্ষা আমি করতে পারি নাই, কারণ হেলেনের ট্রয় নগরীর মত ধ্বংস আমি চাই নাই। তাই এমনি এক অগ্নি পরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে, সকলের অজান্তে এক বস্ত্রে, রাতের অন্ধকারে, দেশান্তরী হলাম। প্রতিশ্রুতির মানুষটি হয়তো সেই সময় জীবিকার তাগিদে কর্মব্যস্ত ঘর্মাক্ত মুখে ক্লান্ত সময় পার করছে ভূগ্লোবের অপর প্রান্তে। সে কিছুই জানল না যে তার অপেক্ষার মানুষটি হারিয়ে গেলো জনারণ্যে।
চলে এলাম আরেক বাস্তবতার শহর কলিকাতায়! সেখানে সান্নিধ্য লাভ করলাম সেকালের সংগ্রামী এবং বর্তমানের সফল এক মহীয়সী রমনী মমতা ব্যানার্জির! আস্তে আস্তে শুরু করলাম চিকিৎসা পেশা। অর্জন করলাম সার্জারী ও গায়ানোকলজিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি। কলিকাতা থেকে পরে চলে গেলাম মুম্বাই। চুক্তিতে যুক্ত হলাম এক নাম করা হাসপাতালে সার্জন হিসাবে এবং আর এক নামকরা হাসপাতালে গায়ানোকলজিষ্ট হিসাবে।
৩০ বছর ধরে অপারেশন থিয়েটারে রাতের পর রাত জেগে, মানুষের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, মন প্রান ও শিক্ষার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিলাম। দীপ জ্বালালাম জীবনের আশা ত্যাগকরা অজস্র মানুষের জীবনে পরম দ্বায়ীত্বে। তবে সমাজ ও সমাজের মানুষের অবিচারে, নিজের অধিকার না পাওয়ার কারনে হৃদয়ে সঞ্চিত ক্ষোভে,মানুষের অংগ ব্যবচ্ছেদ করতাম কসাইয়ের মত দ্রুত হাতে পরম তৃপ্তিতে।
এমনি এক গভীর রাতে হাসপাতালের ফোনে ঘুম ভেংগে গেলো। সংকটাপন্ন রোগীর জীবন বাঁচাতে জরুরী ভাবে অপারেশন করতে হবে। হাসপাতালের গাড়ি এলো আমার ফ্লাটে। মুখ না ধুয়ে, গায়ে একখান চাদর জড়ায়ে, হাসপাতালে ছুটলাম। ওটি প্রস্তুত। চেম্বারে বসে রোগীনির কেস ফাইল ষ্টাডি করলাম। লিভারে টিউমার ব্রাষ্ট হয়ে রক্তের অন্ত:ক্ষরণ হচ্ছে। ওটিতে প্রবেশের আগে বদ অভ্যাসগত ভাবে পরম তৃপ্তি ভরে একখান সিগারেটে ফুকে নিলাম (সরি)! নার্স এসে ওটির ড্রেস পরিয়ে দিলেন। সার্জিক্যাল ওয়াস-রুম থেকে সার্জিক্যাল ওয়াস নিলাম। ওটিতে প্রবেশ করলাম।
রোগীনিকে দেখে, ৩০ বছর আগে ছেড়ে আসা আমার মায়ের মত মনে হলো। মনটা আবেগ প্রবন হয়ে উঠলো। এনেস্থেসিয়ার কার্যকরীতা পরীক্ষা করে শুরু করলাম শরীর কাটা। তবে আজ কসাইয়ের মত না। পরম মমতায় মায়ের প্রতি আদরের মত। আড়াই ঘন্টায় অপারেশন সেরে, নিজ হাতে সেলাই দিয়ে, ফিরে এলাম ক্লান্ত শরীরে আমার ফ্লাটে!
ফিরে এসে ঘুম আর হলো না। শুধু মায়ের মুখ চোখে ভেসে ভেসে আমাকে আবেগ প্রবন করে তুলতে লাগলো। জীবনের দুর্গম পথে একা চলা ক্লান্ত পথিক আমি অবশেষে শক্তি সঞ্চয় করে, সব অভিমান ত্যাগ করে, সিদ্ধান্ত নিলাম, বাংলাদেশে যাবো মাকে দেখতে। কারন এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে বাবা বিগত হয়ে চলে গেছেন স্বর্গে। তার সাথে আর কোনদিন দেখা হয় নাই। যাবার বেলায় কতটা আক্ষেপ নিয়ে গেছেন কে জানে!
অবশেষে ৩০ বছর পরে মাকে দেখতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের বগুড়াতে গত মার্চ মাসে। কি যে এক করুন অবস্থার সৃষ্টি হলো তখন, যখন আমরা মুখোমুখি হলাম। মা আমকে চিনতে পারে না, আমি মাকে চিনতে পারি না। মার চোখে ভাঁসে ৩০ বছর আগের তার সেই বাঁশ পাতার মতন পাতলা ফিনফিনে মেয়েটাকে, আর আমার চোখে ভাঁসে ৩০ বছর আগের আমার সেই কালো কেশি সুঠাম দেহি মা, এই শুভ্রকেশি ও কৃষ দেহি মা না। তবুও বাস্তবকে মেনেই নিতে হলো, এই যে আমার মা, আমার মা।
আমাদের কথাঃ কুইকনিউজবিডি.কমে ফেসবুক কর্নার নামে একটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন ফেসবুক টাইমলাইনে অনেকেই জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে থাকেন। আমরা সে খন্ডচিত্র গুলোকে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করছি। এখন থেকে ফেসবুক কর্নার নামের এই বিভাগে নিয়মিতভাবে অনেকের জীবনের খন্ডচিত্র তুলে ধরা হবে।
আজকে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক হসপিটালে কর্মরত গাইনোকোলজিস্ট ও জেনারেল সার্জন “ডা.সুচিত্রা মুখার্জী’র” ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পোস্টটি সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বগুড়া মেয়ে ডা. হাসিবা ইসলাম সুচিত্রা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় “ডা.সুচিত্রা মুখার্জী’ হিসাবে অধিক পরিচিতা। তিনি নিয়মিতভাবে চমৎকার লেখনীর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক চমৎকার পোস্ট উপহার দিয়ে থাকেন।
কিউএনবি/বিপুল/ ০৮ মে ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/ রাত ৮.৫৮