দর্শন না ছোঁয়া আমি
—————————-
ড্রামা প্রত্যেকের জীবনেই থাকে। কে কিভাবে সেই নাটককে দেখবে তার উপর এর ব্যাপ্তি নির্ভর করে। এইচএসসি পাশ করলাম এত সাদামাটাভাবে যে কোথাও এডমিশন টেস্ট দিয়ে চান্স পাওয়াই এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো।
মধ্যবয়সে এসে যখন আবার নিটশের দর্শন পড়ছি তখন দর্শন বিভাগে ভর্তির সে কাহিনী আঁশ ছাড়া মাছ হয়ে চোখের সামনে মুখ ব্যাদান করে পড়ে আছে। ইচ্ছা ছিল লিটারেচার পড়ার। প্রথমবার ঢাকা ইউনিভার্সিটির ঘ ইউনিটে চান্সই পেলাম না। পরেরবার ওয়েটিং লিস্ট থেকে পেলাম দর্শন। তাও আমার প্রথমবারেই চান্স পাওয়া ফিজিক্সের বান্ধবী আমার জন্য পেছনের সিটে বসে আবার পরীক্ষা দেওয়াতে।
পাতার পর পাতা মুখস্থের ফিলোসফি আমার ভেতর সে কালে বিরক্তি উৎপাদন করলেও একালে আমি স্থিতধী। আসলেই তো অনেক দূর থেকে নির্বিকার ভাবে জীবনকে যাচাইয়ের যে খেলা তা দার্শনিক ছাড়া কে করতে পারবে!
“যারা ধ্বংসবাদে বিশ্বাস করে, তাদের নিকট পৃথিবীর সবকিছু অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন।”
“নিটশের মতে, নায়ালিজম মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের একটি পর্যায় মাত্র। যখন মানুষ প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতায় ভোগে, তখন তারা ধীরে ধীরে প্রচলিত নীতি নৈতিকতা এবং সত্যের প্রতি বিমুখ হতে থাকে। অসীম হতাশা মানুষের কাছে সবকিছু অর্থহীন করে তোলে ধীরে ধীরে। নিটশের মতে, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর উদ্দেশ্যহীনতায় ভোগা এই পর্যায় মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। কারণ, মানুষ ততদিন নতুন কোনো নিয়ম প্রবর্তন করবে না, যতদিন না পুরাতনের প্রতি তার বিশ্বাস ভেঙে যায়। পরমকারণবাদে বিশ্বাস করে না, পৃথিবীতে কোনো কিছুর পেছনে কোনো যুক্তি বা কারণ আছে বলে বিশ্বাস করে না। ধ্বংসবাদের বিশ্বাস এই যে, সকল জীব ও জড়ের পেছনে আমরা যে কারণ বা উদ্দেশ্য খুঁজে পাই, সেগুলো পরম নয়, সেগুলো আমাদেরই কল্পনা মাত্র!”
নিজেকে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগি – আমি কি স্বক্রিয় নায়ালিস্ট, না নিষ্ক্রিয়? তারপর ভাবি আমাকে কেন কিছু হতেই হবে!
“ধ্বংসবাদের অধিকতর গ্রহণযোগ্য রূপটি হলো স্বক্রিয় ধ্বংসবাদ। একজন স্বক্রিয় নায়ালিস্ট প্রচলিত ধ্যান-ধারণার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান না। বরং তার ইচ্ছাশক্তি প্রবল হয় এবং তিনি সেই ধ্যান-ধারণা ও নীতি নিয়ম ভেঙে ফেলতে চান। তৈরি করতে চান নতুন নিয়ম, নতুন প্রথা। স্বক্রিয় নায়ালিস্ট শুধুমাত্র সামাজিক অবস্থার বিচার বিবেচনা করেই ক্ষান্ত হন না, তিনি সেগুলো সমাজ থেকে মুছে ফেলে নতুন কিছু আনয়নের চেষ্টা করেন। নিটশের চোখে এটি ইতিবাচক এবং সমাজকে এগিয়ে নেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণও বটে। এভাবেই নিটশে তার নায়ালিজম বিষয়ক আলোচনার ইতি টেনেছেন। তার মতে, একজন ব্যক্তি যখন স্বক্রিয় নায়ালিস্ট হয়ে উঠবেন, তখন তার নিকট ঈশ্বর মৃত। কারণ সে নিজের কর্তৃত্ব নিজে নিয়ে নিয়েছে এবং নিজের জীবনধারা নিজে ঠিক করে নিচ্ছে। বিজ্ঞান এবং দর্শনের আলোকে সকল প্রকার পবিত্র এবং অশরীরী বিশ্বাস সে নিজ হাতে হত্যা করেছে।”
আমাদের ধ্যান ধারণা উল্টেপাল্টে দেখার সাধ জাগায় দর্শন। অথচ এক জায়গায় গিয়ে আটকে যাই যখন কেউ প্রশ্ন করে নারী দার্শনিক এত কম কেন! ইচ্ছে করে বলি নিটশে সিংকে আধোয়া থালাবাটি নিয়ে ভাবেননি,বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে হবে,বাসায় কি রান্না হবে এসব ভাবেনি। তারপর আর বলা হয় না। দার্শনিকরাও অনেকটা ধর্ম প্রবক্তাদের মতো?কোন কায়িক শ্রম বা প্রচলিত কাজ ছাড়া শুধু চিন্তা ছড়িয়ে ও বক্তৃতা দিয়ে রুটি রুজির ব্যবস্থা করেছে! নারী দার্শনিক যাদের নাম নেয়া হয় কেউ গণিতবিদ,কেউ বা নারীবাদী।
এক আয়ুতে কত কি আমাকে পড়তে হয়েছে,আহ! ঘোর লেগে যায় ভাবলে কিভাবে উতরেছি চার বছরের অনার্স,এক বছরের মাস্টার্স! যারা এই দর্শন বিষয়টিকে ভালোবেসে শিক্ষকতায় আছে,ব্যক্তিগত জীবনে চর্চা করে সেভাবেই যাপন করছে আয়ু তাদের আমার বেশি বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। ওদের মতো সৌভাগ্যবান/বতী কে আছে!
আমার তো মিটিলো না পূর্ণাঙ্গ কোনকিছুরই আশ।
আমাদের কথাঃ কুইকনিউজবিডি.কমে ফেসবুক কর্নার নামে একটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন ফেসবুক টাইমলাইনে অনেকেই জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে থাকেন। আমরা সে খন্ডচিত্র গুলোকে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করছি। এখন থেকে ফেসবুক কর্নার নামের এই বিভাগে নিয়মিতভাবে অনেকের জীবনের খন্ডচিত্র তুলে ধরা হবে।
আজকে কানাডা প্রবাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক মেধাবী ছাত্রী আফসানা কিশোয়ার লোচন এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পোস্টটি সংগ্রহ করা হয়েছে। আফসানা কিশোয়ার লোচন নিয়মিতভাবে তাঁর চমৎকার লেখনীর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে থাকেন।
কিউএনবি/বিপুল/ ০৭ মে ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/ রাত ১১.৪৫