আজ থেকে ঠিক ছয় বছর আগের কথা। সেদিন ছিল ৩০ এপ্রিল,২০১৬ সাল। আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা ভুল করেও জানতে চান না রোগী কতদূর থেকে এসেছে চিকিৎসা নিতে! রাজধানী শহরে মাসের পর মাস থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রোগীর পরিবারের আছে কি না! রোগীর পরিবার ইতোমধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেল কি না! নিঃস্ব হলেও জীবনসঙ্গীকে মাঝপথে ফেলে আসতে সবাই কি আর পারে! সেদিন আমিও পারিনি। কারণ,এ শপথ যে ছিল ভালোবাসার শপথ।সুখে দুঃখে,ভালোয় মন্দে, বিপদে আপদে একে অপরের হাত ধরে একসাথে বেঁচে থাকার শপথ। তাইতো শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে যেকোনো অবস্থাতেই তার পাশে থাকতে চেষ্টা করেছি আমি। চাকরির তোয়াক্কা না করে সবকিছু ফেলে দীর্ঘ এক বছর ঢাকা শহরে ভাড়া বাসায় থেকে সহধর্মিণীর চিকিৎসা চালিয়েছি সাধ্যমতো।
দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময়ের উন্নত চিকিৎসার ফলে প্রথম ধাপ শেষ হয়ে গেল। এরপর তিন মাস পর পর ফলোআপ। সেজন্য ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার আর দরকার নেই বলতে গেলে। আমার চাকরিও ক্যান্টনমেন্ট প্রশাসনের অধীনে।ক্যান্টনমেন্ট অথরিটি বিশেষ করে তখনকার মহানুভব সামরিক প্রিন্সিপাল,কমান্ডার ও জিওসি মহোদয় অনেক সদয় ছিলেন আমার প্রতি। ইতোমধ্যে ওনাদেরও বদলী হয়েছে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে অন্যখানে। নতুন প্রশাসন তখনো তেমন চেনে না জানে না আমাকে।স্ত্রীর ক্যান্সার চিকিৎসা জনিত হোক বা পিতৃত্বকালীন হোক, আপাতত আমার ছুটি শেষ হলো ৩০ এপ্রিল,২০১৬ ।০২ মে আমাকে জয়েন করতে হবে প্রতিষ্ঠানে। ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বারের মেট্রো শপিং মলের ঠিক বিপরীতে ওভার ব্রিজের সাথেই তখন আমার অস্থায়ী ঠিকানা। খবর দিলাম ঢাবিতে আমার ছাত্র শুভ্র,ড্যাফোডিলের পিয়াল, রেজা দেরকে। সেসময় ঢাকার নানান ভার্সিটিতে পড়ুয়া আমার এই ছাত্ররাই ওদের আন্টিকে অনেক রক্ত দিয়ে সাহায্য করে।
সৈয়দপুর ফিরতে হবে বলে ভাড়া করলাম একটা বড় পিকআপ।মে দিবসে নাকি ভাড়া কিছুটা বেশি।তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ৩০ এপ্রিল সৈয়দপুরে ফেরার। হঠাতই আগের রাত থেকে ছোট্ট মেয়ে নাওয়ালের জ্বর। বিষন্ন হলো দুজনের মন। দীর্ঘ একটা বছর যে কত কষ্ট করেছি ঢাকায়! তখন শুধুই ক্ষণ গণনা করেছি যে, কবে হবে এই কষ্টের দিনের অবসান! কিন্তু কেন যেন ফিরে আসার সময় নানান কারণে মনটা খারাপ হয়ে গেল দুজনারই! অনেক ভালো মানুষ ছিলেন ঢাকার অস্থায়ী বাড়িওয়ালা। সেই বাসা থেকে মাঝে মাঝে ছোট্ট নাওয়াল আর ছেলে মাহদীকে নিয়ে যেতাম ৩২ নাম্বারের বিকেলের মিলনমেলায়। দেখিয়ে দিতাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। পাশে ধানমন্ডি লেক, নয়নাভিরাম তাকওয়া মসজিদ। রাসেল স্কয়ার দিয়ে হেঁটে হেঁটে সুরাইয়া কে নিয়ে যেতাম স্কয়ার হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দিতে। মাঝে মধ্যে ওর মনটা একটু ভালো করবার জন্য দুজনে বসতাম বত্রিশ নাম্বারের লেকের ধারে। দুজনে আইসক্রিম খেতাম, কখনো ডাব বা এটা সেটা খাওয়া হতো।এসব নিছকই সুরাইয়ার মন ভালো করার প্রয়াস মাত্র।সবকিছু খুব করে মনে পড়ে যাওয়ায় বুঝি দুজনের মন খারাপ হলো ফেরার সময়! তবু যে ফিরতে হবে আমাদের। সুচিকিৎসার জোরে আর আল্লাহর রহমতে সুরাইয়া যে সুস্থ হয়েছে। নাজিবের ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের লেখাপড়াও যে বন্ধ হয়ে আছে মায়ের অসুস্থতার কারণেই।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াবে ছোট্ট নাওয়াল। আমাদের সংসার আবার ভরে উঠবে অনাবিল সুখ আর শান্তিতে।ঢাকার বাড়িওয়ালা বললেন, আরো কিছুদিন থেকে যান না হয়! কিন্তু তাই কি আর হয়! নৌকার পালে ততক্ষণে হাওয়া লেগেছে। ফিরতেই হবে উত্তরের ছোট শহর সৈয়দপুরে। ক্ষণিকের পৃথিবীতে কেই বা কার! রবীন্দ্রনাথের গল্পের পোস্টমাস্টারও ফিরতে চেয়ে আর পারেননি ফিরে আসতে শেষমেশ। বাংলা সাহিত্যের অন্য একটা গল্পে এক বালক তো টিঙচার আয়োডিন খেয়ে ফেলেছিল হাসপাতালে আরো বেশিদিন থাকতে।আর আমার সহধর্মিণী তো আপাতত ক্যান্সারজয়ী নারী। তাকে কি আর রাখতে পারে ঢাকার হাসপাতাল গুলো!
আপাতত বিদায় ঢাকার বাড়িওয়ালা, বিদায় স্কয়ার হাসপাতাল,ল্যাব এইড, ইবনে সিনা ও সেন্ট্রাল হাসপাতাল।বিদায় প্রফেসর কোহিনুর বেগম, প্রফেসর মোয়াররফ হোসেন, প্রফেসর রায়হানা আউয়াল সুমী প্রমুখ ঢাকার প্রখ্যাত চিকিৎসকেরা।বিদায় আহমেদ মেডিকেল, শাহবাগের নাজ ফার্মেসী ও কলাবাগানের লাজ ফার্মা। বিদায় ধানমন্ডি ৩২, শুক্রাবাদ কাঁচা বাজার। বিদায় ধানমন্ডি ২৭ এর মিনাবাজার । বিদায় ঢাকার আত্মীয় স্বজনেরা।শুভ্র, পিয়াল ,রেজা ও আরো কয়েকজন ছাত্র ছাত্রীরা এসে হাজির,স্যার আজকেই যাচ্ছেন তো! ওদের সাহায্যে মাল ছামানা উঠিয়ে দিলাম পিকআপে। আজকের তারিখে সকালের উত্তরবঙ্গ গামী বাসে রওনা হলো ছেলে দুটো ওদের নানী আর শাহনাজকে নিয়ে।জ্যামে আটকে গেলে দশ বারো ঘন্টাও লাগতে পারে। শিশুকন্যা নাওয়াল আর সুরাইয়াকে নিয়ে বাসে ওঠাটা নেহায়েত বোকামি হবে।তাই সেদিন বিকেলের বাংলাদেশ বিমানের দুটো টিকিট কনফার্ম করলাম।ঢাকা বিমানবন্দরে কি প্রচন্ড জ্বর তখন নাওয়ালের। ওষুধ সাথেই ছিল।
একই বিমানে সেদিন ফিরছিলেন খুব পরিচিত শিশু বিশেষজ্ঞ ড. আবু আহমেদ মুর্তজা ভাই। বিমানবন্দরে তিনি দেখেই এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন আমার স্ত্রীর অবস্থা।ডা মুর্তজা ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের শিক্ষক আমি আর উনি আমার প্রতিষ্ঠানের পর্ষদের সদস্য।পুরো পরিচালনা পর্ষদ সেই দুঃসময়ে আমার পাশে।মেয়ের জ্বর দেখে ওনার পরামর্শ মতো ওখানে আরো ওষুধ খাইয়ে দেই মেয়েকে। সেদিন সেই বিমানে সৈয়দপুরের মেয়র সদ্য প্রয়াত আমজাদ হোসেন ভাইও ছিলেন। পঞ্চাশ মিনিটের আকাশ পথে দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাই সৈয়দপুর। নতুন ভাড়া বাসায় কিভাবে থাকবো, সেই রাতে এসেই বা কি খাবো,সবকিছুই যে তখনো অগোছালো ও অপ্রস্তুত। সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নেমেই দেখি সহকর্মী আলীম ভাই, জোনায়েদ, শামীম প্রস্তুত আমাদের বরন করে নিতে।কার যেন হাতে তখন রজনীগন্ধার কয়েকটা স্টিকও দেখতে পেলাম।২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিলের সেই রাতটায় অতিথি হলাম আলীম ভাইয়ের বাসায়। নাবিল পরিবহনে সন্ধ্যায় পৌঁছে গেল পরিবারের বাকিরা।
আমার ছাত্র বর্তমানে লেকচারার জোনায়েদ,লেকচারার শামীম ও আরো কয়েকজন রাতের বেলা পিকআপ থেকে মাল ছামানা এনে পৌঁছে দেয় নতুন এই বাসায়। দীর্ঘ এক বছরে অব্যবহৃত ও অযত্নে থাকায় ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে এলজি ফ্রিজ,সনি টিভি আরো অনেক কিছুই। তাতে কি! এগুলো তো সম্পদ নয় মোটেও। সবচেয়ে বড় সম্পদ বাচ্চাদের মা সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে নিজের সংসারে আবারো।কাটায় কাটায় ছয় বছর পূর্ণ হলো আজ সৈয়দপুরে ফিরে আসার। প্রতি বছর এই দিনটি এলে তাই মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই ফিরে আসার কথা ও স্মৃতিগুলো।নাওয়াল এখন সাড়ে ছয় বছরের মেয়ে।সব কিছু আছে, আজ শুধু একজন নেই এই বাসায়। বর্তমান শ্বাপদ সংকুল এই জনারণ্যে একটা কন্যা শিশুর জন্য একজন মায়ের দরকারই আজ সবচাইতে বেশি। মেয়েটার এখন সয়ে গেছে।সে বুঝতে পারে অনেক কিছুই।
গত পরশু দিন আমি রংপুর যাওয়ার সময় নিজে থেকেই বললো বাবা, আমিও যাই তোমার সাথে। আম্মুর কবরের পাশে যেতে মন চায় যে! সাথে নিয়ে গেলাম, মায়ের কবরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। এমন দৃশ্য যেন দেখতে বা সইতে না হয় কখনো কাউকে। দু’দিন পরে ঈদ। স্বাভাবিক ভাবেই মনটা খারাপ বাচ্চাদের। ঈদের শপিং করেছি ভালো ভালো। ওরা কি কি খাবে তা-ও জোগাড় করছি আমি। কিন্তু তবু ওদের ভিতরে একটা বিরাট শূন্যতা। জীবিত ও পরপারে পাড়ি জমানো সব মায়েরা ভালো থাকুক। মাতৃহারা বাচ্চাদের জীবনের প্রতিটি দিন হোক ঈদের দিনের মতো হাসি খুশি ও আনন্দময়।
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম
সৈয়দপুর
৩০.০৪.২০২২খ্রিস্টাব্দ।
আমাদের কথাঃ কুইকনিউজবিডি.কমে ফেসবুক কর্নার নামে আমরা একটি নতুন বিভাগ চালু করেছি। প্রতিদিন ফেসবুক টাইমলাইনে অনেকেই জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে থাকেন। আমরা সে খন্ডচিত্র গুলোকে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করছি। এখন থেকে ফেসবুক কর্নার নামের এই বিভাগে নিয়মিতভাবে অনেকের জীবনের খন্ডচিত্র তুলে ধরা হবে।
কিউএনবি/বিপুল/ ৩০ এপ্রিল ২০২২খ্রিস্টাব্দ /রাত ১০.০৪