ডেস্ক নিউজ : অভ্যন্তরীণ দ্বন্দে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে সব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তবে দলীয় চেয়ারম্যানের এই সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অব্যাহতি পাওয়া নেতারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত তারা মানেন না। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চলা দলীয় অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন প্রকাশ্যে এল।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু শৃঙ্খলাভঙ্গের ইস্যু নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে জাতীয় পার্টিকে বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার একটি কৌশল মাত্র।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের রাজনীতিতে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে জাতীয় পার্টি। দলটির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী তকমাও লাগে। অভিযোগ করা হয়, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে জাতীয় পার্টি তাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। একতরফা তিনটি নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করে অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে। এই কারণে তাদের নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনও করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এছাড়া জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা ও ভাঙ্গচুরের ঘটনাও ঘটে।
এছাড়া দেশের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের বাইরে রাখা হয়। সংস্কার বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক আলাপে তাদের আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনাতেও আমন্ত্রণ পায়নি জাতীয় পার্টি। ফলে কাগজে কলমে দলটির অবস্থান থাকলেও দেশের রাজনীতিতে মূলত নিস্ক্রিয় হয়ে আছে দলটি। এমতাবস্থায়, জাতীয় পার্টির আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ নেতাদের অব্যাহতির বিষয়ে অনেকেই বলছেন, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল ও রাজনীতিতে পুনর্বাসন হতেই মূলত এমন সিদ্ধান্ত।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির মধ্যে দুটি ধারা সক্রিয়। একটি স্বাধীন রাজনৈতিক অবস্থানে দলকে এগিয়ে নিতে চায়, অন্যটি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে সুবিধাভোগী দল হিসেবে টিকে থাকতে চায়।
জিএম কাদেরের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত কি সেই দ্বিতীয় পথের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে? দেশের রাজনীতিতে এমনটাই মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাদের মতে, রাজনীতিতে অনেকটাই কোণঠাসা ও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়া-অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাদের দাবি, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাব্য প্রক্রিয়া সহজ করতে দলীয় অবস্থান ও নেতৃত্বে এই রদবদল আনা হয়েছে।
মহাসচিব পদে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নিয়োগ দেওয়ায় সেই ‘ঘনিষ্ঠতা নীতি’র ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন তাদের অনেকে। কারণ, বরাবরই শামীম হায়দার পাটোয়ারী দলীয় নেতৃত্বের প্রতি অনুগত এবং সরকার-ঘনিষ্ঠ নীতির সমর্থক হিসেবে বেশ পরিচিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একাধিক কেন্দ্রিয় নেতা জানান, বর্তমানে পার্টি মূলত কোনঠাসা অবস্থানে রয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকার কারণে নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতে আবারও কবে জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক মাঠে তাদের কর্মসূচি নিয়ে আসবে ও দলীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এমতাবস্থায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নেতাদের দল থেকে অব্যাহতি দিয়ে জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে আবারও পুনর্বাসন হতে চাচ্ছে।
এদিকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতারা বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে এককভাবে নেওয়া হয়েছে, যা জাতীয় পার্টির ঐতিহ্য ও গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রেসিডিয়ামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছাড়া কাউকে অব্যাহতি দেওয়া সম্ভব নয়। তারা এটিকে অগণতান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দেন।
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) গুলশানে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া জাতীয় পার্টির সাবেক সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, দলের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত বেআইনি। আমরা এখনো স্বপদে বহাল আছি। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। চেয়ারম্যানের প্রতিটি সিদ্ধান্ত স্বৈরাচারী।
তিনি বলেন, জিএম কাদের রাতের অন্ধকারে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে জোর করে সিগনেচার নিয়েছিলেন। তখন এরশাদ সাহেব খুব অসুস্থ ছিলেন। গণতান্ত্রিক কোনো দলের কেউ রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। তিনি অসুস্থ ছিলেন, জোর করে ক্ষমতা নিয়েছিলেন।
তিনি দাবি করেন, সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত নিন, কাউন্সিলে আমরা যেতে চাই। আপনি কেন সম্মেলন করতে চান না? কাউন্সিলের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক।
এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা প্রমুখ।
অন্যদিকে দলের নতুন মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী অবশ্য ভিন্ন সুরে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তৃণমূলের কর্মীদের নিয়ে জাতীয় পার্টিকে নতুনভাবে সাজানো হবে, এবং হারানো আসন পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দল এগিয়ে যাবে। তবে এসব ইতিবাচক বার্তার মাঝেও বাস্তবতা হলো, জাতীয় পার্টি আবারও নিজের অস্তিত্ব ও কৌশলগত অবস্থান নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে।
এই মুহূর্তে জাতীয় পার্টির ভেতরে যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে, তা যদি নিরসন না হয়, তাহলে দলটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়বে বলেই ধারণা দেশের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কিউএনবি/অনিমা/০৮ জুলাই ২০২৫,/সন্ধ্যা ৬:৫৭