জালাল আহমদ, ঢাকা : আওয়ামী লীগের সরকারের ফ্যাসিবাদী জমানায় দীর্ঘ দিন ধরে মামলা-হামলায় জর্জরিত রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি,তার একসময়ের জোট সঙ্গী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বামপন্থী রাজনৈতিক দল সহ ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা কেউ ঈদ করেছেন জেলখানায়,কেউ আত্মগোপনে, কেউবা নির্বাসনে! আওয়ামী লীগের পতনের পর ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা দীর্ঘ দেড় যুগ পর ভয়-ভীতিহীন পরিবেশে এবার স্বস্তির ঈদ উদযাপন করবেন।বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৬ সালের ২৪ অক্টোবর সর্বশেষ তাদের পরিবার আনন্দের সাথেই ঈদ উদযাপন করেছিল ।তার ঠিক চার দিন পর ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি -বৈঠার আন্দোলনে বিএনপি -জামায়াতের নেতাকর্মীদের কে কঠিন মূল্য দিতে হয় রাজপথে। ফলে আনন্দের সেই ঈদ কিছুটা বিষাদে পরিণত হয়।২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ঈদুল আযহা কেড়েছে আনন্দ এবং বিষাদে। এরপর ১১ জানুয়ারি দেশ-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমেদ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেল-জুলুম, মামলা -হামলা , নির্যাতন -নিপীড়ন যেন বিএনপি পরিবারের সদস্যদের ‘নিত্য সঙ্গী’।
বিগত দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে এমনিতেই কোন ঈদ আনন্দ নেই। সর্বশেষ ২০২৩ সালে বিএনপির-জামায়াতের সরকার বিরোধী এক দফা আন্দোলন কে ঠেকাতেই সরকার আদালত কে ব্যবহার করে শত শত মামলায় বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে সাজা প্রদান করে।সেই বছরের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কে কেন্দ্র করে মিথ্যা এবং বানোয়াট মামলায় ২৫ হাজার নেতাকর্মী কে আটক করা হয়।ফলে গতবারের(২০২৪) ঈদ ছিল ‘করুণ এবং নিরানন্দ’।বিগত সময়ে কারাগারে ঈদ করেছেন যারা:বিএনপি আমলের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও নির্বাহী কমিটির সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবর ২০০৭ থেকে সব ঈদ উদযাপন করেছেন জেলখানায়। এই বছর তিনি মুক্তি পেয়েছেন।এবার তিনি ঈদ উদযাপন করবেন মুক্ত বাতাসে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পিন্টু ২০০৭ থেকে গত বছর পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন।তিনি প্রায় ৩০ টি ঈদ জেলখানায় উদযাপন করেছেন।এবার তিনি মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদযাপন করবেন।গত বছর কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ঈদ উদযাপন করেছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন- নবী খান সোহেল এবং লায়ন আসলাম চৌধুরী, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব,যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী এবং তারেক রহমানের সাবেক পিএস মিয়া নুরুদ্দিন অপু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দিনাজপুর—৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান মিয়া,যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আজিজুর রহমান মুসাব্বির, ছাত্রদলের সাবেক সহ—সভাপতি ইখতিয়ার রহমান কবির, স্বেচ্ছাসেবক দলের দপ্তর সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন, যশোর জেলা বিএনপির সদস্য মুনির আহমেদ সিদ্দিকী , দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরে আলম সিদ্দিকী নয়ন, সাভার উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাভার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন সহ হাজারো নেতাকর্মী।
দলের যেসব সাজাপ্রাপ্ত নেতাকর্মীরা আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেন নি, তাদের কে আত্মগোপন অবস্থায় ঈদ করতে হয়েছে।এই তালিকায় আছেন যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল সহ কয়েকজন নেতা।লন্ডনে ঈদ উদযাপন করছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান:বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৭ সালে ২ টি ঈদ ই কারাগারে উদযাপন করেছেন ।২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও লন্ডনে চিকিৎসা করতে গমন করায় সেবার তাঁকে লন্ডনে ঈদ উদযাপন করতে হয়। সেই ২০০৮ সাল থেকেই লন্ডনে টানা ঈদ করছেন তিনি। এবারও তিনি লন্ডনে ঈদ করছেন।গত ৮ জানুয়ারি লন্ডনে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।তাই এবার লন্ডনে ঈদ উদযাপন করছেন তিনি।
নির্যাতিত নেতাকর্মীদের ঈদ উপহার পাঠাচ্ছেন তারেক রহমান: বিগত আন্দোলনে রাজপথে শহীদ ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের ঈদ উপহার পাঠাচ্ছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সারাদেশে বিএনপির নির্যাতিত নেতাকর্মীদের তালিকা করে তাদের কে ঈদ উপহার পাঠাচ্ছেন তিনি।
দীর্ঘ ১০ বছর পর নিজ এলাকায় ঈদ উদযাপন করবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ:বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ সর্বশেষ ২০১৪ সালে নিজ এলাকায় ঈদ উদযাপন করেছিলেন।তাঁকে ২০১৫ সালের ১০ মার্চ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা আন্দোলনে মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনকালে রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে গুম করা হয়েছিল । দীর্ঘ ২ মাস পর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে তাঁর খোঁজ মিলে। সেই ২০১৫ সালের ১০ মে থেকে গত বছর পর্যন্ত ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছিলেন কক্সবাজার -১ (চকরিয়া -পেকুয়া) সংসদীয় আসন থেকে তিন বার নির্বাচিত সাবেক এই সংসদ সদস্য। দেশের বাইরে থাকলেও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন সাবেক এই ছাত্রদল নেতা। তবে গত বছরের ৫আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি ১১ আগস্ট দেশে ফেরেন।এ বছর তিনি ঈদ উদযাপন করবেন কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের সিকদার পাড়ার নিজ বাড়িতে।
গতকাল রবিবার রাতে দেখা যায় যে,সালাহউদ্দিন আহমদ এর আগমনে সিকদার পাড়ার নিজ বাড়িতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ভিড় করছেন ।তার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করছেন ।
জামায়াতের ইতিহাসে সবচেয়ে আনন্দময় ঈদ:
সেই ২০০৭ থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে ঈদ করতে পারে নি।তাদের অসংখ্য নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন।অনেকেই শারীরিকভাবে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।তাদের ই একজন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘জীবন্ত শহীদ’ খ্যাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মোঃ দেলোয়ার হোসেন।বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ঠাকুরগাঁওয়ের সন্তান মো: দেলোয়ার হোসেন ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত টানা পাঁচ বছরের বেশি সময়ে জেলে আটক ছিলেন।জীবনের ১০ টি ঈদ তিনি জেলখানার চার দেওয়ালের মধ্যেই উদযাপন করেছেন।
২ শতাধিক মামলায় একটানা ৫৭ দিন রিমান্ডে থাকায় দেশব্যাপী আলোচিত সাবেক এই ছাত্রনেতা এবার মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদযাপন করবেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে।বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আসনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তিনি।তাঁর ভাই আলমগীর হোসেন ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান পদে।রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন মজলুম এই ছাত্রনেতা।ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে শঙ্কাহীন পরিবেশে স্বস্তির নিঃশ্বাসে এবার পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ঈদ উদযাপন প্রত্যাশা করে তিনি জানান, “দীর্ঘ ১৮ বছর পর ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে শঙ্কাহীন পরিবেশে স্বস্তির নিঃশ্বাসে ঈদ উদযাপনের সুযোগ এসেছে।বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম তাদের জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে আমাদের কে এই পরিবেশ ফিরিয়ে দিয়েছেন।পবিত্র রমজান মাসের রোজা শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দময় মুহূর্তে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য আমরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি।”
কিউএনবি/অনিমা/৩১ মার্চ ২০২৫,/সকাল ১১:২০