ডেস্ক নিউজ : দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি জেলা মাগুরা। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৮৪ সালে মাগুরাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। চারটি উপজেলা নিয়ে গঠিত ১,০৩৯.১০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ জেলায় ৪ টি উপজেলা, ১টি পৌরসভা ও ৩৬টি ইউনিয়ন নিয়ে মোট ২ টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলার পৌরসভা, ৮টি ইউনিয়ন ও শ্রীপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয়েছে মাগুরা-১ আসন। আসনটি জাতীয় সংসদের ৯১নং আসন। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৭১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৬ জন, মহিলা ভোটার ১ লাখ ৯৮হাজার ৫৮৩ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ২ জন।
এ আসনটিতে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জিতলেও পরের চারবার আসনটিতে নৌকার জয়ের ধারা অব্যাহত রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর। আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে খ্যাত মাগুরা-১ আসন শেষ পর্যন্ত দলটি ধরে রাখতে পারবে, নাকি দুর্গে আঘাত হানবে বিএনপি, তা জানা যাবে আগামী নির্বাচনে ভোটের ফলাফলে। তবে এখন থেকেই জয়-পরাজয়ের হিসেব কষতে মাঠে নেমেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। বর্তমানে মাগুরায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী হলেও বিএনপি আন্দোলনমুখী অবস্থায় রয়েছে। অন্য দলগুলোকে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে মাঠে দেখা যাচ্ছে।
মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইতে পারের বলে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সহকারী সচিব অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর, সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের বর্তমান চেয়ারম্যান এটিএম আব্দুল ওয়া্হাব, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, কুতুবউল্লাহ হোসেন মিয়া কুটি (গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী), মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পঙ্কজ কুমার কুন্ডু ও অ্যাড. সৈয়দ শরিফুল ইসলাম।
মাগুরা-১ আসনে বিগত বছরগুলোতে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও বর্তমান সময়ে তাদের বিভিন্ন আন্দোলন, সভা সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেলেও নির্বাচনমুখী কোনো তথ্য তারা এ মুহূর্তে বলতে চাইছে না। তারা সরকার পতন ও বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যস্ত রয়েছেন। বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা আসে সেভাবেই বিএনপি নির্বাচন করবে।
এ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএপির মনোনীত প্রার্থী মনোয়ার হোসেন খানকে এবারও বিএনপির জনপ্রিয় প্রার্থী বলে গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন সাবেক পৌর মেয়র ইকবাল আক্তার খান কাফুর, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আহমেদ, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আকতার হোসেন, আহসান হাবিব কিশোর ও হাসান ইমাম সুজা। তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা বর্তমানে আন্দোলনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তৃণমূল গঠনের চেষ্টা করছে।
জাসদ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন এটিএম মহব্বত আলী, সদস্য জাসদ স্থায়ী কমিটি ও সভাপতি মাগুরা জেলা জাসদ এবং জাহিদুল আলম, জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। ইসলামী আন্দোলন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী মো. নজরুল ইসলাম, সহসভাপতি ইসলামী আন্দোলন মাগুরা জেলা শাখা। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী মো. সিরাজুল সায়েফিন সাঈফ ১নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় পার্টি, মাগুরা জেলা শাখা। বাংলাদেশ কংগ্রেস থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী অ্যাড. কাজী রেজাউল হোসেন, চেয়ারম্যান বাংলাদেশ কংগ্রেস।
মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ কুমার কুন্ডু সময় সংবাদকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বৃহত্তর একটি দল। এ দলে অনেক নেতাকর্মী আছে এবং যোগ্যতম ব্যক্তি অনেকে আছেন। একজন মনোনয়ন চাইতেই পারে, তার মানে এই নয় দলে সংঘাত আছে। মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে, যাতে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে।’
মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর বলেন, ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাগুরা-১ আসনে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। মাগুরায় একটি মেডিকেল কলেজ, অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম ও তার সৌন্দর্যবর্ধন, আধুনিক জিমনেসিয়াম, নবগঙ্গা ব্রিজ, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, নির্মাণাধীন আইটি পার্ক, গ্রামীন রাস্তাঘাট পাকাকরণ এবং পৌর এলাকার ফোর লেন সড়কসহ জেলার কমপক্ষে অর্ধশত উন্নয়ন কাজ করেছি গত ৪ বছরে। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।’
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আকতার হোসেন সময় সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে যতগুলো সংসদ নির্বাচন, উপনির্বাচন হয়েছে সমস্ত জায়গায় তারা ভোট ডাকাতি করেছে। অতএব এই সরকারের ওপর আর আমাদের আস্থা নাই। একদফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আর ভোটের মাঠে যাব না। যদি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় এবং জনগণ তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। তবে বিএনপি নিশ্চিত জয় লাভ করবে।
মাগুরা-২ আসন:
মহম্মদপুর ও শালিখা উপজেলাসহ মাগুরা জেলা সদরের চার ইউনিয়ন নিয়ে মাগুরা-২ আসন গঠিত। যার সংসদীয় আসন নং ৯২। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ৮৫ হাজার ২০১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৬ হাজার ২০৫ জন, মহিলা ভোটার ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৩ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ৩ জন।
২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী কাজী সালিমুল হক কামাল বিজয়ী হয়েছিলেন। তারপর থেকে আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে খ্যাত মাগুরা-২ আসনটি শ্রী বীরেন শিকদার ধারাবাহিকভাবে ধরে রেখেছেন। ১৯৯৬,২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-২ আসনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী অ্যাডভোকেট শ্রী বীরেন শিকদার।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী কেন্দ্রের সিনিয়র নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন কিনা এ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে রয়েছে বিএনপি। তবে এ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনের কথা না ভেবে সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী একাধিক প্রার্থী মাঝে মাঝে নির্বাচনী এলাকায় এসে গণসংযোগ করছেন ও তৃণমূল পর্যায়ে চষে বেড়াচ্ছেন এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে নিরিবিলি বসে নেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। তারাও নিজের মতো করে প্রচারপ্রচারণা করছেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে।
দীর্ঘদিন ধরে মাগুরা-২ আসনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুই বলয়ে বিভক্ত রয়েছে। এ বিভক্ত ও দলীয় কোন্দলে আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করছেন তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। তবে বিএনপিও নেই সুবিধাজনক অবস্থানে। তাদের রাজনীতিতেও দুই বলয়ে বিভক্ত। নেতৃত্ব নিয়ে দলের ভিতরে গ্রুপিং কোন্দল যেন থামছে না, ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে ১০ জন, বিএনপির ১ জন, জাতীয় পার্টির ২ জনসহ এক ডজন প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। তার মধ্যে সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমান এমপি ড. শ্রী বীরেন শিকদার, অ্যাডভোকেট শফিকুজ্জামান বাচ্চু, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কর্নেল (অব.) অধ্যাপক কাজী শরীফ উদ্দিন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্মল কুমার চ্যাটার্জি, অ্যাডভোকেট ওহিদুর রহমান টিপু, প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ড. আবু আব্দুল্লাহেল কাফি, অ্যাডভোকেট আবু আয়ুব আলী বিশ্বাস, তানভীর রহমান রাজু ও আব্বাস আল কোরায়েশী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।
অপরদিকে এ আসনে বিএনপি থেকে একাধিকবার মনোনয়ন পাওয়া সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাড. নিতাই রায় চৌধুরী ধানের শীষের মনোনয়ন চাইবেন, অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি আপাতত না থাকায় নিতাই রায় চৌধুরী পাবেন বলে আশা করছেন তার সমর্থকরা। এ আসনে বসে নেই উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এম খসরুল আলম খসরু ও সাধারণ সম্পাদক মো. মুরাদ আলী। জামায়াত ইসলাম থেকে মো. বিএম বাকের ও ইসলামী আন্দোলন থেকে মুফতি মো. মোস্তফা কামাল নির্বাচনী মাঠে সরব রয়েছেন। সবাই সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন ।
মাগুরা-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ড. শ্রী বীরেন শিকদার সময় সংবাদকে বলেন, ‘এ আসনের জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে বারবার নির্বাচিত করেছেন। এজন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনগণের উন্নয়নে এই আসনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রাস্তা ঘাট, সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বিশেষ করে মহম্মদপুরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন মধুমতী নদীর ওপর শেখ হাসিনা সেতু নির্মাণ ও মহম্মদপুর উপজেলায় ৮৫ ভাগ বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আসবে। এছাড়াও এ সরকারের আমলে মহম্মদপুর ও শালিখায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারিকরণ করা হয়েছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাকে প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিলে নৌকার বিজয় ধরে রেখে নির্বাচিত হয়ে এলাকার উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে চাই।’
অন্যদিকে এ আসনে বিএনপি থেকে নির্বাচন করতে চান সাবেক মন্ত্রী এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নিতাই রায় চৌধুরী। অন্যান্য সময় তিনি ঢাকায় অবস্থান করলেও বিভিন্ন সময় কেন্দ্র ঘোষিত কর্মকাণ্ডে তাকে মাগুরায় জেলা বিএনপি আয়োজিত প্রোগ্রামে দেখা যাচ্ছে। ২০০৮ সালে তিনি অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন। যদিও নির্দলীয় সরকার আসলেই কেবল তারা নির্বাচনের কথা ভাববেন বলে জানিয়েছেন।
আলোচনায় পিছিয়ে নেই সাধারণ ভোটাররা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ ও ২ আসনে কে হবেন জনগণের অভিভাবক তা নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থীর মধ্যে কে পাবেন নৌকা প্রতীক? আবার বিএনপি নির্বাচনে না এসে আন্দোলনে ব্যস্ত থাকলে কী হবে দেশের পরিস্থিতি। এ নিয়েও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জেলা উপজেলার প্রতিটি হাট-বাজার ও পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলছে সাধারণ ভোটাররা।
কিউএনবি/আয়শা/২৮ অক্টোবর ২০২৩,/বিকাল ৫:৩০