বুধবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:০৬ পূর্বাহ্ন

লুৎফর রহমান এর জীবনের খন্ডচিত্র : এত জল ও কাজল চোখে–১

লুৎফর রহমান। ঢাকা।
  • Update Time : বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ৪১৭ Time View

এত জল ও কাজল চোখে–১
———————————
রাত ১১ টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত আমার কাজ। মাঝে এক ঘন্টা বিরতি, খাওয়া দাওয়া, কফি পান। এই একঘন্টা ওয়ার্কিং টাইম হিসাবে ধরা হয়না বলেই ৭ ঘন্টা সময় দিতে হয়। মুল কাজ ৬ ঘন্টার।

আমরা সকলই টুথ ব্রাশ ইউজ করি। কিন্তু টুথব্রাশের হ্যান্ডেল থেকে চুলগুলো খসে পড়েনা কেন তা কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা। আসলে ব্রাশের ফুটো গুলোতে তামার তারের টুকরো চুলগুলোকে আটকিয়ে রাখে। এই জন্যে ব্রাশের চুল খসে পড়েনা।

আমার কাজ হলো তামার তার ঠিক মত যাচ্ছে কিনা তা দাঁড়িয়ে থেকে পর্যবেক্ষন করা। সামান্য এদিক ওদিক হলেই তামার তারের রোল থেকে তামা মেশিনের বাইরে চলে যায়। বিনা তামার তারের টুকরোয় ব্রাশ কোন কাজে লাগেনা। চুল গুলোতে টান দিলেই খুলে আসে।

১৯৯২ সালের জানুয়ারী মাস। বাইরে -৭ ডিগ্রী তাপমাত্রা। মাটির নীচে, বহুতল এক ভবনের বেজমেন্টে টুথব্রাশের ফ্যাক্টরি। দক্ষিন কোরিয়ার রাজধানী সিউলের প্রানকেন্দ্র পঞ্চনডং এই ফ্যাক্টরি। অনতিদুর সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পাশেই আমার আবাসস্থল।

সাররাত কাজ করি। সকালে বাসায় ফিরে টগবগে গরম পানির বাথটাবে শুয়ে রাতের নির্ঘুম ক্লান্তি দূর করি। শাওয়ার সেরে ব্রেকফার্স্ট সেরে ” সউল দে ইক্কু” অর্থাৎ সিউল ন্যাশনাল ইউনিভারসিটিতে চলে যাই।

১১ টায় ইউনিভারসিটি থেকে ফিরে আরো ২/১ ঘন্টা বাড়তি কিছু কাজ করি। যেমন কোরিয়ায় আসা বাংলাদেশীদের চাকুরী দেয়া। একদিকে মানবিক কাজ এটি অপরদিকে প্রতি চাকুরী দেয়াতে পাওয়া যায় ৩০০ ইউএস ডলার।

দুপুর দেড়টা দুইটার মধ্যে বাসায় লাঞ্চ সেরে ঘুমিয়ে পড়ি। রাত ৯ টায় ঘুম থেকে উঠে ডিনার সেরে আবার রাতের কাজে যোগদান। এই ছিল আমার দক্ষিন কোরিয়ার গত বাধাজীবন।
রাতের শিফটে কাজ করার কারনে আসলে আমি সপ্তাহে দুদিন ছুটি পেতাম। পুরো রোববার ছুটি কাটিয়ে সোমবার রাতে কাজে যাওয়ার অর্থ দুদিন পুরো ছুটি কাটানো। ছুটির এই দুই দিনে আমি চষে বেড়াই কোরিয়ার এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত সীমায়।

১৯৮৮ সালের ১০ই অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রদলের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। এরপর আন্দোলন, সংগ্রাম লড়াই অত:পর স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটে ৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বরে।

এরশাদের পতন হলো, নিজ দল বিএনপি এক অভুতপুর্ব নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসল। অথচ এর ৬ মাস পরেই আমাদেরকে দেশান্তরি হতে হল। আমরা ঘাটি গাড়লাম থাইল্যান্ডের ব্যাংককে।এই রহস্যময় অন্তর্ধানের পিছনে আছে দুর্ধর্ষ কিছু গ্রুপিং রাজনীতির ডামাডোল।

সিউলে দুদিন ছুটির দিনে আমি পথে পথে ঘুরি। মাইনাস ৭ ডিগ্রী তাপমাত্রায় কালো স্যুট প্যান্ট সু এর সাথে গায়ে চড়াতাম ব্ল্যাক ওভারকোর্ট। পাহাড়ের উপরে উচু নীচু অসমতল সিউলে নি:শ্বাসের সংগে ধোয়া উড়িয়ে আমি আশ্রয় নেই সাবওয়েতে। ইনচন, আনসান, সাদাং চষে বেড়াই আমি পাতাল রেলে।

একা একা শেত শুভ্র তুষারে মোড়া পাহাড় দেখি। স্নো ফলের এই মৌশুমে পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো পত্র পল্লবহীন শীর্নকায়া রুপ ধারন করে। পাতাহীন শুকনো ডালগুলোতে তুষার জমে শ্বেত পাথরের গাছ যেন সৃস্টি করে রেখেছে প্রকৃতি।

দক্ষিন কোরিয়ায় আমি একা। আমার এই একাকী জীবনে ধুসর অতিত জীবন আমাকে গ্রাস করে। বেদনার নীলকস্ট আমার মধ্যে তীব্র দহনের সৃস্টি করে। একা একা পথচলার আমার এই জীবনে শুধুই দু:খ। মনের অজান্তেই দু চোখ বেয়ে নোনা জল ঝরে। এত জল ও কাজল চোখ ভিজিয়ে দেয়। (চলবে)

 

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান। সিলেট থেকে ঢাকা ফেরার পথে পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনে বসে লেখাটি তিনি লিখেছেন ২৫.১২.২০২২ খ্রিস্টাব্দ,সন্ধ্যায়। লেখাটি তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগৃহিত।

 

 

 

কিউএনবি/বিপুল/২৮.১২.২০২২/ রাত ১১.০৭

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

September 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit