একটি কাঁচ ভাঙার গল্প
________________
সেদিন একটা কোর্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। সকাল সকাল বাচ্চাদের স্কুল এ পাঠিয়ে দুজনে রেডি হয়ে নিলাম। যাওয়ার পথে কফি আর বেগল নিয়ে নিবো কোনো কফি শপ থেকে, তাই নাস্তা না করেই বের হলাম।
দুজন কফি খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম চল্লিশ মিনিটেই। কোর্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট আমার ভীষন অসহ্য লাগে। বিজনেস পারপাস কোনো একটা কারণে যেতে হয়েছিল আমাকেও, কোম্পানির MD বলে কথা হা হা হা। যদিও আমি MD কিন্তু বিজনেস টা আমার হাজবেন্ডেরই ছিল।
কোর্ট শুরু হলো, দুই পক্ষের লইয়ার তাদের কথা বলে যাচ্ছে আর আমি ঝিমাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম হাফ টাইম বিরতি, এর পর আবার আধাঘন্টা পর কার্যকারী শুরু হবে। সবাইকে রুম থেকে বাইরে যেতে অনুরোধ করা হলো।
মাত্র আধাঘন্টার ব্যাপার তাই শুধু ফোনটা সাথে নিয়ে হাতের ব্যাগটা রুমে রেখেই বের হয়ে এলাম।
এপ্রিল মাস, তখনো ভালো ঠান্ডা বাইরে। দুজন হাটছিলাম বেরহয়ে, বেশ ভালই লাগছিল। কাজের চাপে এভাবে দুজনের হাটাই হয় না আর আজকাল। দুজনেই ভীষন ব্যাস্ত। হাটছিলাম আর দুজনে সময় ক্যালকুলেট করছিলাম, কোর্ট ডিসমিস কখন হবে। ডিসমিস হতে দুপুর দুইটা বেজে যাবে, আর ছেলেকে(মাহদী) স্কুল থেকে পিকআপ করতে হবে আড়াইটায়। হাতে শুধু তিরিশ মিনিট থাকবে, পৌঁছতে লাগবে চল্লিশ মিনিট। খুবি টাইট সময় হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ও বলে উঠলো –
— এক কাজ করো, তুমি নাহয় এখনি গাড়ি নিয়ে চলে যাও। আমি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বাসায় চলে আসবো।
রাজি হয়ে গেলাম। পরক্ষনেই বললাম –
— আমার ব্যাগ তো কোর্ট রুমে! এখন আনাও সম্ভব না, রুম লক করা। ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যাগে, লাইসেন্স ছাড়া আমি কিছুতেই ড্রাইভ করবো না। কোনো ভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে গাড়ি রেখে হেঁটে চলে যেতে বলবে।
আমাকে সাহস দিলো সে, তবুও যেনো আমি চলে যাই বাসায়। বললো –
— সাবধানে যাবে স্পীড লিমিট রেখে, কোনো উল্টা পাল্টা না দেখলে শুধু শুধু পুলিশ আটকাবে না।
— আমি তো রাস্তা চিনবো না! জিপিএস নেই এই গাড়িতে (তখন ফোন এ জিপিএস চলতো না)। তুমি তো জানো আমি জিপিএস ছাড়া রাস্তা খুবই কম চিনি।
— আমি একদম ডিটেইলস বলে দিচ্ছি কিভাবে যাবে।
আমাকে সে রাস্তায় দাড়িয়ে সুন্দর করে বাসার রাস্তা চিনিয়ে দিল –
— এখান থেকে বায়ে যাবে, তারপর সোজা শেফার্ড (রাস্তার নাম) ধরে যেতে যেতে কিছুক্ষণ পরই কিংস্টন(রাস্তার নাম) পাবে। আর কিংস্টন থেকে তো তুমি বাকি রাস্তা চিনবেই। আমিও সুবোধ এর মত মাথা নাড়ালাম।
জ্যাকেটের পকেট থেকে চাবি বের করে দিল। বিসমিল্লাহ বলে দোয়া দুরুদ পড়ে গায়ে ফু দিয়ে ড্রাইভিং শুরু করলাম, যেনো পুলিশের হাতে না পরি। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো আমাকে যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়। ভালোবাসায় আর মায়ার চোটে আমার চোখ ছল ছল করতে লাগলো।
যাচ্ছি যাচ্ছি যাচ্ছি…। সে বললো কিছুক্ষণ পর কিংস্টন পাবো, আধা ঘণ্টা ড্রাইভ করলাম, কিন্তু কোথায় কিংস্টন! ভাবলাম হয়তো আরেকটু সামনে হবে। এভাবে আরেকটু সামনে করতে করতে একঘন্টা চলে গেলো সামনে আর কিংস্টন পেলাম না। দেখতে পেলাম শেফার্ড(রাস্তার নাম) শেষ হয়ে ডানে আর বায়ে নতুন রাস্তা চলে গেছে। তার মানে এখানেই শেফার্ড শেষ। একটা পার্কিংলটে গাড়ি থামিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম কিংস্টন কোথায় পাবো!
সবাই একই উত্তর দিলো, আমি নাকি উল্টা দিকে চলে এসেছি। আমাকে আবার ফেরত যেতে হবে যেখান থেকে এসেছি সেখানে। শিউর হলাম আমাকে ভুল রাস্তায় পাঠিয়ে দিয়েছে! ভীষন রাগ হলো! ফোন করলাম কয়েক বার, ফোন ধরছে না। বুঝতে পারলাম কোর্ট রুমে আছে।
অগত্যা আবার একঘন্টা উল্টা ড্রাইভ করে কোর্টের সামনে এলাম। আবার ফোন দিলাম। একই অবস্থা, এবারও ফোন ধরছে না। ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমার।
কাছেই একটা আবাসিক এলাকার মত দেখে পার্ক করলাম। ভাবলাম কোর্ট এ ফেরত গিয়ে ডেকে নিয়ে এসে ঝাড়ি মারি কিছুক্ষণ। রাগের চোটে মাথা কাজ করছিলো না। হুরাহুরি করে গাড়ি থেকে বের হলাম। বের হয়ে দু কদম যেতেই দেখি সাইনবোর্ড (No Parking). সর্বনাশ, পুলিশ দেখলে গাড়ি টো করে নিয়ে যাবে আর টিকেট ধরায় দিবে। ডাউনটাউন এরিয়া, এখানে সব সময় পুলিশ ঘুরা ঘুরি করতে থাকে। সেই ভয়ে আবার ফেরত গাড়িতে ঢুকবো, জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে দেখি চাবি নেই! হায় আল্লাহ্, চাবি কোথায়! তাড়াহুড়ার মধ্যে চাবি গাড়িতে রেখেই বের হয়ে এসেছি। গাড়ির হ্যান্ডেল ধরে টান দিলাম দরজা খুলতে, ওমা… এ কি অবস্থা গাড়ি লক কেনো! (নামার সময় কোনোভাবে হাতের চাপ লেগে লক হয়ে গেছে গাড়ি)।
রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না কি করবো। ফোন খোঁজতে অন্য পকেটে হাত দিয়ে দেখি ফোনও নেই! গাড়ির ভেতরে তাকিয়ে দেখি পাশের সিটে পড়ে আছে ফোন টা। রাগে দুঃখে কান্না আসছে। মনে হচ্ছে পায়ের সব রক্ত মাথায় উঠে গেছে মুহূর্তের মধ্যে, লাগছে মাথা ফেটে যাবে প্রেশারে। রাস্তায় দাড়িয়ে কান্তেও পারছি না। কিভাবে গাড়ি আনলক করবো সেই কথা ভেবে ভেবে আমার হার্ট বিট এত দ্রুত চলতে লাগলো যে মনে হচ্ছিল এখনি হার্ট বাইরে বেরিয়ে আসবে।
ঠান্ডার মধ্যে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঘামতে লাগলাম। রাস্তায় দাড়িয়ে প্রত্যেকটা গাড়ি থামিয়ে হেল্প চাইতে লাগলাম, যদি কোনো ভাবে তাদের চাবি দিয়ে আমার গাড়িটা খুলতে পারি। কিন্তু কেউ হেল্প করলো না! সবাই আমাকে এমন ভাবে দেখছিল যেনো আমি রাস্তায় দাড়িয়ে ভিক্ষা করছি। অনেকের কাছে ফোন চাইলাম কল করতে, কেউ দিতে রাজি হলো না। এক দিকে পুলিশের ভয় আর আরেক দিকে এভাবে হেল্পলেস হয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে আছি, চোখ দিয়ে অটোমেটিক পানি পড়ছে। ট্যাক্সী নিয়ে বাসায় যাবো সেই সুযোগ ও নেই। কারণ টাকা নেই, সাথে তো আমার ব্যাগই নেই। ইচ্ছে হচ্ছিল ব্যাটাকে পেলে আজ খুন করবো।
ঠিক সেই সময় একটা গাড়ি এসে সামনে থামলো।শ্রীলংকান দুইটা ছেলে গাড়ি থেকে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলো “sister do you need any help”? আমার কাছে মনে হলো তারা দুইজন এঞ্জেল হয়ে এসেছে সাহায্য করতে। প্রথমেই আমি ফোন চাইলাম। কয়েকবার কল করলাম, হাসব্যান্ড ফোন ধরলো না।
আমার ঘটনা শুনে তারা অনেক ভাবে চেষ্টা চালালো গাড়ির লক খুলতে, কিন্তু ব্যর্থ হলো। আর কোনো উপায় না পেয়ে ওদের রিকোয়েস্ট করলাম গাড়ির উইন্ডো ভেঙে ফেলতে। ওরা রাজি হলো না। আমার অনেক আকুতী মিনতির পর কোনো ভাবে রাজি হলো। সবাই মিলে রাস্তায় ইট পাথর খুঁজতে লাগলাম। কপাল আমার, সেটাও পেলাম না।
কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে এক বাসায় নক করলাম। বাড়ির মালিক বেরিয়ে আসতেই তার কাছে হাতুড়ি জাতীয় কিছু আছে কিনা জানতে চাইলাম, তাতে বাড়ির মালিক মনে করলো ডাকাতি করতে এসেছি, মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল! আবার নক করলাম, এবার বাড়ির মালিক দরজা বন্ধ অবস্থাতেই কথা বললো। আমার সাথে সাথে আমার এঞ্জেল দুজনও পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বলার পর বড় একটা প্লায়ার এনে দিলো লোকটি। মনে হলো এটা আমার আরেকটা এঞ্জেল! অনেক ধন্যবাদ দিলাম।
সেই প্লায়ার দিয়ে ৬/৭ বার বারি দিয়েও আমি কাচের উইন্ডো ভাঙতে পারলাম না। সে দিন চেষ্টা না করলে কখনোই জানতাম না গাড়ির কাঁচ এতটা শক্ত হয়!
আমার এঞ্জেলদের বললাম আমার হয়ে ভেঙে দিতে, রাজি হলো না। বললো এটা অন্যের প্রপার্টি, তাই ভাঙতে পারবে না। এটা যার প্রপার্টি তাকেই ভাঙতে হবে।
শুধু পায়ে ধরা বাকি ছিলো, আবার অনেক আকুতি মিনতির পর রাজি করালাম। আমার ভয়েস রেকর্ড করলো “They are breaking the window with my permission”। অবশেষে উইন্ডো ভেঙে গাড়ি আনলক করলাম। চোখ দিয়ে রাগের পানি ঝরছিল শুধু। আমার এঞ্জেল রা মনে হলো নিমিষেই উড়ে চলে গেলো তাদের গন্তব্যে।
তখন বাজে বিকেল ৩:৫০। ছেলেকে পিকআপ করার কথা ছিল দুপুর আড়াইটায়। বাসায় ফোন দিলাম, বড় মেয়ে ধরলো। বললো সবাই স্কুল থেকে বাসায় চলে এসেছে। মাহদীকে(আমার ছেলে) কেউ একজন বাসায় পৌছে দিয়েছিলো সময় মত (হয়তো আরেকটা এঞ্জেল এসেছিল)! বাচ্চারা সেফলী বাসায় পৌঁছেছে কৃতজ্ঞ জানালাম উপরওয়ালার কাছে!
পুরোটা রাস্তা কান্না করতে করতে ড্রাইভ করলাম।
এখনো বলছি, আমি আসলেই সে দিন সেই মুহূর্তে খুন করতে পারতাম! আল্লাহ্ যা করেন ভালর জন্যই করেন।
লেখিকাঃ রুপা মোজাম্মেল লেখাপড়া শেষ করে কানাডা প্রবাসিনী হয়েছেন। পুরো পরিবার নিয়ে কানাডায় থাকেন, সেখানেই তাঁর কর্ম জীবন। লেখালেখি করেন নিয়মিত। জীবনের খন্ডচিত্র আঁকতে পারদর্শিনী রুপা মোজাম্মেল। আজকের গল্পটি তাঁর কাছ থেকে সরাসরি সংগৃহিত।
কিউএনবি/বিপুল/২৪.০৯.২০২২/রাত ১১.০৫