আমাদের বড় ঈদ
———————-
আমরা বলতাম বড় ঈদ। রমজান মাস শেষে সেমাই আর নতুন জামার খবর নিয়ে আসতো ছোট ঈদ। কোরবানি মানে হচ্ছে বড় ঈদ। তখন ঈদুল আজহা বা আদহা বলার প্রচলন ছিল না।
আমার মধ্যবিত্ত বাবা ভাগে কোরবানি দিতেন। হাটে গিয়ে বলতেন ভাই গরু বেশি দামাদামি করবেন না। এটুকু তাদের পাওনা। সারাবছর তারা এই অবলা প্রাণীটিকে যত্ন করে বড়। এতে আছে ভালোবাসা।
আম্মা বলতেন ‘ পালার বড় জ্বালা গো। ‘ আমরা তিন ভাইবোন বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরু দেখতাম।
কি যে এক আনন্দ ছিল আমাদের। কিছু গরুকে দেখতাম কাঁদছে। গরুর চোখ ভারি মায়াবী। তাতে পানি দেখলে আমাদেরও কান্না পেয়ে যেত।
অপেক্ষায় থাকতাম আমাদের কখন গরু আনবে। প্রায় প্রতিবারই পালক সাথে আসতেন। নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে নিজে প্রথম খড় তুলে দিতেন গরুর মুখে। গামছা দিয়ে গরুর গা মুছিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বিদায় হতেন।
ঈদের দিন ! সে তো ভারি আনন্দ। আমরা দুই বোন খুব ভোরে উঠে ভাইকে টেনে হিঁচড়ে গায়ে পানি ঢেলে ঘুম ভাঙ্গাতাম। আব্বা তৈরি থাকতেন ফোড়ল হাতে নিয়ে। ভাইকে কেয়া সাবান দিয়ে ডলে ডলে গোসল করাতেন। আমার ভাই চিৎকার করে কাঁদতো। আমাদের দুই বোনের কানে সেই কান্না মধুর বলে মনে হত।
দুই বোন ঘর গোছাতাম। আম্মা আলমারি থেকে ন্যাপথলিনের গন্ধ ওয়ালা ফুলতোলা সাদা চাদর বের করে দিতেন। ইস্ত্রি করা সাদা পর্দা আর ফুলদানিতে রাখতাম কুড়িয়ে বা চুরি করে আনা ফুল।
গরু কোরবানির সময় তিন ভাইবোন বালিশে কান চেপে কাঁদতাম আর আল্লাহ্র কাছে দোয়া করতাম। – আল্লাহ্ আমাদের গরুটা যেন পালাতে পারে। কারো যেন চোখে না পরে। আব্বা বোঝাতেন কোরবানি মানেই প্রিয় প্রাণীটিকে আল্লাহ্র নামে দিয়ে দেয়া।
আম্মার হাতের দুধ সেমাই আর ভুনাখিচুড়ি খেয়ে দুপুরে ট্রেতে করে আত্মীয় প্রতিবেশিদের বাড়ি যেতাম মাংস নিয়ে। আম্মা এক হাতে দানের মাংস আলাদা করে নিয়ে নিজে বিলাতেন।
প্রতিবেশী বা আত্মীয় বাড়ির মাংস রাখতেন আলাদা পাতিলে। তখন তো এতো ফ্রিজের বালাই ছিল না।
আম্মা এলাকায় অনেকের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘বুজি’ নামে। সন্ধ্যার সময়ে সব কাজ শেষ তখন হয়তো কেউ আসতো। মাথা চুলকিয়ে বলতো ‘বুজি’ আসলাম।
আম্মা কী করে যেন সবার মনের কথা টের পেতেন। প্লেট ভর্তি করে খেতে দিতেন খিঁচুড়ি মাংস। আম্মা এবেলা ওবেলা মাংস ভাজতেন। কী যে মনকাড়া গন্ধ বের হত সেই ভাজা মাংসের ! ছয় সাত দিন পরে মাংস যখন ঝুরি ঝুরি হয়ে যেত আমরা গরম ভাত দিয়ে সেই মাংস ঝুরি খেতাম। একদম পাতিলের শেষ ঝুরিটুকুও আমার ভাই ভাত দিয়ে মুছে খেতো।
এখন মোবাইল আর ফ্রিজের দুনিয়া। আমার ভাই ফোন দিয়ে বলে ‘আপা কি রেঁধেছিস রে …. আম্মার মতো দুধ সেমাই ! বাচ্চারা কোরবানি দেখে ! ভয় পায় না?
বোন ফোন দিয়ে গরুর সংখ্যা জানায়। জিজ্ঞেস করে, খাশির পায়া কী করে রাঁধে? তারপর একটু থমকায় – আপা, এই দিনে আব্বা রোজা রাখতেন তাই না রে !
সময়ের সাথে আমরাও বদলে গেছি। ফ্রিজে মাংসের শেষ প্যাকেটটা তুলে আমরা ভাবি ‘বাহ গরুটা বেশ মোটা ছিল। ওদিকে গরুর পালক হয়তো সকালে ভাত খেতে গিয়ে ভাবছে ‘ইশরে.. গরুটাকে তো খেতে দেইনি! তারপর ভুল ভেঙ্গে চোখের কোণায় জল জমে। তার স্ত্রী হয়তো ভাতের মাড়টুকু ছাই গাদায় ফেলতে ফেলতে ভাবে ‘ গরুটা থাকলে খেতো। ‘
আজ হয়তো তার বাড়িতে একটা পালা মোরগ জবাই হয়েছে, বাড়িতে ছোটখাটো উৎসব। পালক হয়তো তখন মাংস ভাত খেতে গিয়ে শুণ্য গোয়ালের দিকে তাকায়। অশ্রুসজল চোখে চোখাচোখি হয় চোখের জল গড়িয়ে পড়া স্ত্রীর সাথে। তারপর সে নিজেকে লুকাতে ‘ আমি একটু আসছি, বাইরে কাজ আছে। ‘ বলে বাইরে বের হয়ে যায়।
এবারের ঈদে ঋণ শোধ হয়ে ঘরে দুটো নতুন কাপড় এসেছে এটা ঠিক কিন্তু গোয়ালের সাথে তার হৃদয়টাও শুণ্য হয়ে গেছে।
ঈদ হাসতে শেখায়
ভালোবাসতে শেখায়
ত্যাগের মহিমা শেখায়।
লেখিকাঃ নিতু ইসলাম নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর আবেগঘন লেখা হাহাকার সৃষ্টি করে। পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পেশাগত জীবনে জীবনে গৃহিণী। নিতু ইসলাম বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা পাবনা জেলায়। রাঁধতে, বই পড়তে,ও লিখতে ভালোবাসেন। পাবনার আদি নিবাসেই তাঁর জীবন যাপন। লেখাটি তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগৃহিত।
কিউএনবি/বিপুল/ ১৯.০৭.২০২২/ সন্ধ্যা ৭.২৫