বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৩৩ পূর্বাহ্ন

মানব ত্বকের ডিএনএ থেকে ভ্রূণ তৈরি করলেন বিজ্ঞানীরা

Reporter Name
  • Update Time : বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০২৫
  • ১৪ Time View

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক : মার্কিন বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের ত্বকের কোষ থেকে নেওয়া ডিএনএ ব্যবহার করে এবং পরে তা শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত করে প্রাথমিক স্তরের মানব ভ্রূণ তৈরি করেছেন। এই পদ্ধতিটি বয়সজনিত বা রোগজনিত বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে, কারণ শরীরের প্রায় যেকোনো কোষকেই নতুন জীবনের সূচনা হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।

এমনকি এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সমলিঙ্গ দম্পতিরাও তাদের নিজস্ব জিনগতভাবে সম্পর্কিত সন্তান পেতে পারেন। এই পদ্ধতিতে এখনও ব্যাপক পরিমার্জন প্রয়োজন—যা শেষ হতে অন্তত এক দশক সময় লাগতে পারে—তারপরই কোনো বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা কেন্দ্র এটি ব্যবহারের কথা ভাবতে পারবে।

বিশেষজ্ঞরা একে একটি উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন, তবে তারা বলেছেন, বিজ্ঞানের এই নতুন সম্ভাবনাগুলো নিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা প্রয়োজন। আগে প্রজনন ছিল খুবই সহজ একটি প্রক্রিয়া—পুরুষের শুক্রাণু নারীর ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয়, তারা একত্রে ভ্রূণ তৈরি করে এবং নয় মাস পর একটি শিশুর জন্ম হয়।

কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা সেই নিয়ম পরিবর্তন করছেন। সর্বশেষ এই পরীক্ষায় এটি সম্ভব হয়েছে মানুষের ত্বক থেকে। ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির গবেষক দল যে পদ্ধতি ব্যবহার করছে, তাতে তারা ত্বকের কোষ থেকে নিউক্লিয়াস (যেখানে মানবদেহ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ জিনগত কোড সংরক্ষিত থাকে) বের করে আনেন।

এরপর এই নিউক্লিয়াসটি এমন একটি দাতা ডিম্বাণুর মধ্যে স্থাপন করা হয়, যার নিজস্ব জিনগত নির্দেশনা (ডিএনএ) আগেই অপসারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি অনেকটা সেই পদ্ধতির মতো, যা ব্যবহার করে ১৯৯৬ সালে বিশ্বের প্রথম ক্লোন করা স্তন্যপায়ী প্রাণী ‘ডলি ভেড়ি’ তৈরি করা হয়েছিল।

তবে এই ডিম্বাণুটি এখনই শুক্রাণুর দ্বারা নিষিক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়, কারণ এতে ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ ক্রোমোজোম সেট (ডিএনএ-র পূর্ণ নির্দেশনা) রয়েছে। সাধারণত, একজন ব্যক্তি মায়ের কাছ থেকে ২৩টি এবং বাবার কাছ থেকে আরও ২৩টি ক্রোমোজোম উত্তরাধিকার সূত্রে পায়, মোট ৪৬টি। কিন্তু এখন এই ডিম্বাণুতেই ৪৬টি ক্রোমোজোম বিদ্যমান।

তাই পরবর্তী ধাপে গবেষকদের লক্ষ্য হলো ডিম্বাণুকে তার ক্রোমোজোমের অর্ধেক ফেলে দিতে রাজি করানো, যাতে এটি ২৩টিতে নেমে আসে এবং শুক্রাণুর ২৩টির সঙ্গে মিলে ৪৬টি সম্পূর্ণ সেট গঠন করতে পারে।

এই প্রক্রিয়াটিকে গবেষকরা নাম দিয়েছেন ‘মাইটো-মিওসিস’, যা দুটি কোষ বিভাজন পদ্ধতি—মাইটোসিস ও মিওসিস—এর সংমিশ্রণ। ন্যাচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, এই নতুন পদ্ধতিতে মোট ৮২টি কার্যকরী ডিম্বাণু তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

এই ডিম্বাণুগুলো পরে শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত করা হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে কিছু ভ্রূণ উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে পৌঁছায়। তবে, কোনো ভ্রূণই ছয় দিন পর আর বিকাশ লাভ করতে পারেনি।

ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির এম্ব্রায়োনিক সেল ও জিন থেরাপি কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর শোখরাত মিতালিপভ বলেন, ‘আমরা এমন কিছু অর্জন করেছি যা আগে অসম্ভব মনে করা হতো।’

এই পদ্ধতি এখনও পরিপূর্ণ নয়, কারণ ডিম্বাণু যে ক্রোমোজোমগুলো ফেলে দেবে তা এলোমেলোভাবে বেছে নেয়। স্বাস্থ্যকর ভ্রূণ নিশ্চিত করতে এটি প্রতিটি ২৩ ধরনের ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি করে রাখতে হবে, কিন্তু এর পরিবর্তে কখনও কখনও কিছু ক্রোমোজোমের দুটি একই কপি থেকে যায় কিংবা কিছু ক্ষেত্রে একটিও থাকে না।

এছাড়াও এই পদ্ধতির সাফল্যের হার খুব কম (প্রায় ৯%) এবং ক্রোমোজোমগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ‘ক্রসিং ওভার’ এ অংশ নেয় না, যেখানে তারা স্বাভাবিকভাবে তাদের ডিএনএ পুনর্বিন্যস্ত করে।

এই ক্ষেত্রের বিশ্বখ্যাত পায়োনিয়ার প্রফেসর মিতালিপভ বলেন, ‘আমাদের এটি সঠিকভাবে পরিপূর্ণ করতে হবে। ভবিষ্যতে আমি মনে করি এটি একমাত্র পথ, কারণ দিন দিন আরও বেশি রোগী সন্তান ধারণ করতে পারছে না।’

এই প্রযুক্তি একটি উন্নয়নশীল ক্ষেত্রের অংশ, যার লক্ষ্য হলো শরীরের বাইরে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু তৈরি করা, যা ইন ভিট্রো গ্যামেটোজেনেসিস নামে পরিচিত।

এখনো এটি গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে এবং ক্লিনিকাল ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত নয়।

এই প্রযুক্তির লক্ষ্য হলো সেসব দম্পতিকে সাহায্য করা, যারা আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) ব্যবহার করতে পারছেন না, কারণ তাদের কাছে ব্যবহারযোগ্য শুক্রাণু বা ডিম্বাণু নেই।

এটি সাহায্য করতে পারে প্রবীণ নারীদের, যাদের এখন আর কার্যকর ডিম্বাণু নেই; পুরুষদের, যারা পর্যাপ্ত শুক্রাণু উৎপাদন করতে পারেন না কিংবা রোগীদের, যাদের ক্যান্সারের চিকিৎসার কারণে বন্ধ্যাত্বের শিকার হয়েছেন।

এই ক্ষেত্রে পিতৃত্বের নিয়মকেও পুনরায় লিখতে হবে। এ বর্ণিত পদ্ধতিতে নারীর ত্বকের কোষ ব্যবহার করতে হবে না—এটি পুরুষের ত্বকের কোষ থেকেও শুরু করা যেতে পারে।

এটি সমলিঙ্গ দম্পতিদের জন্য এটি একটি নতুন সুযোগ, যাতে তারা এমন সন্তান পেতে পারে যাদের উভয় পিতামাতার জিনগত সম্পর্ক থাকবে। 

উদাহরণস্বরূপ, একটি পুরুষ সমলিঙ্গ দম্পতিতে, এক জনের ত্বক ব্যবহার করে ডিম্বাণু তৈরি করা যেতে পারে এবং অন্য পুরুষের শুক্রাণু দিয়ে তা নিষিক্ত করা যেতে পারে।

ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পাউলা আমাটো বলেন, ‘ডিম্বাণু বা শুক্রাণুর অভাবজনিত বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত কোটি কোটি মানুষের জন্য আশা দেওয়ার পাশাপাশি, এই পদ্ধতিটি সমলিঙ্গ দম্পতিদের জন্য এমন একটি সন্তান সম্ভাবনা তৈরি করবে যিনি উভয় পিতামাতার জিনগতভাবে সম্পর্কিত।’

হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজনন চিকিৎসা বিভাগের প্রফেসর রজার স্টারমি বলেছেন, এই বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ এবং মুগ্ধকর।

তিনি আরও বলেন, ‘একই সময়ে, এমন গবেষণা জনসাধারণের সঙ্গে নতুন প্রজনন গবেষণার অগ্রগতির বিষয়ে খোলামেলা সংলাপ চালানোর গুরুত্বকেও জোরদার করে।’

তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অগ্রগতি আমাদের কাছে দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা বোঝায়, যাতে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যায় এবং জনসাধারণের বিশ্বাস গড়ে তোলা যায়।’

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআরসি সেন্টার ফর রিপ্রোডাকটিভ হেলথ-এর উপপরিচালক প্রফেসর রিচার্ড অ্যান্ডারসন বলেন, নতুন ডিম্বাণু তৈরি করার ক্ষমতা ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ হবে।

তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ থাকবে, তবে এই গবেষণা অনেক নারীর নিজের জিনগত সন্তানের জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা অর্জনের দিকে একটি ধাপ।’

সূত্র: বিবিস

 

 

কিউএনবি/আয়শা/০১ অক্টোবর ২০২৫,/রাত ১০:৪৩

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit