ডেস্ক নিউজ : সকালে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। রাতে চাকরিহীন। মতের অমিলে সাময়িক বরখাস্ত। প্রভাবশালী বলয়ে না থাকলে প্রতিহিংসা। দূরবর্তী ও অগুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বদলি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দিয়ে হেনস্তা। আন্দোলনের জেরে কোণঠাসা করার পদক্ষেপ। বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে চাপ ও ভয়ের সংস্কৃতি।
এমন আতঙ্ক চলছে রাজস্ব খাতের বেশির ভাগ কর্মীর মধ্যে। এতে কাজে মনোযোগও নেই। এই সংকট দ্রুত দূর করার আহবান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এনবিআর ভবনের প্রতিটি তলায় কর্মকর্তারা আছেন ভয় ও আতঙ্কে।
কাজ করলেও নেই স্বতঃস্ফূর্ত মনোভাব। প্রতিটি মুহূর্তেই চাকরি হারানোর ভয়। আন্দোলনের নেতৃত্ব ও সমর্থন দেওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ না থাকলেও চলছে অনুসন্ধান। বেছে বেছে কয়েক শ কর্মকর্তার তালিকা করা হয়েছে, যাদের অনেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তই ছিলেন না। চেয়ারম্যান ঘনিষ্ঠ অনেক কর্মকর্তা হুমকির সুরে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এর আগে আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে এনবিআরের চারজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন সদস্য এবং একজন কমিশনার। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার জাকির হোসেনকে করা হয়েছে সাময়িক বরখাস্ত। শীর্ষ পদ ও দায়িত্বশীল স্থানে বদলির জন্য এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে তদবির-লবিং। চেয়ারম্যানের পক্ষের লোক প্রমাণ করাই এখানে যোগ্যতার মূল চাবি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, সাময়িক বরখাস্ত করা, দুদক দিয়ে ধরা, শাস্তিমূলক বদলি করা, পদোন্নতি আটকে রাখা, ভালো জায়গায় বদলি নিশ্চিত করার মতো বেশ কিছু বিষয়ে তালিকা করা হয়েছে। এই তালিকায় অন্তত ৩৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত ৫০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তারা বলছেন, ‘ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় এবং সরকারের আশ্বাসে শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তখন কোনো ধরনের প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা হবে না, এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। এই অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এভাবে চলতে থাকলে দ্রুতই দেশের রাজস্ব খাতে অচলাবস্থা তৈরি হবে। যাদের বিভিন্নভাবে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে এই খাতে তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। তারা শুধুই আক্রোশের কারণে হেনস্তার শিকার হবেন। আমরা এমন পরিবেশ চাই না।’
বর্তমান এই পরিস্থিতিকে প্রাতিষ্ঠানিক সংকট হিসেবে দেখছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে বা অযাচিতভাবে এনবিআর কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এমন অঙ্গীকার দরকার। প্রতিহিংসাপরায়ণতা, গ্রুপিং, পারফরম্যান্সের সমস্যা, যোগ্যতার ঘাটতি বা কিসের ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট করা উচিত। যেকোনো পদক্ষেপের স্বচ্ছতা দরকার। তাহলে যারা নিয়মের মধ্যে আছেন, ভালো কাজ করছেন তাদেরও শঙ্কা দূর হবে। এখন এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক সংকট দেখা দিয়েছে। আগে এই সংকট দূর করে পরে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে মনোযোগী হতে হবে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘ব্যক্তিগত আক্রোশের জায়গা থেকে কারো বিরুদ্ধে কোনো প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নেওয়া যৌক্তিক হবে না। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আলোচনার দরজা সব সময় খোলা রাখা প্রয়োজন। পরিস্থিতি এমন করা উচিত হবে না যেন আলোচনার দরজা বন্ধ হয়ে যায়।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকার ও এনবিআর কর্মকর্তা উভয় পক্ষই বাড়াবাড়ি করেছে। সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কর্তৃত্ববাদের মতোই। প্রশাসনের হাতে দুটি বিভাগ যাওয়ার সিদ্ধান্তে এনবিআর কর্মীরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করেছেন। ফলে প্রতিবাদ হয়েছে এবং শেষে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আন্দোলনে প্রতিবাদের মাধ্যমে সীমা লঙ্ঘন হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় যে প্রতিশ্রুতি এসেছিল তা না মেনে সরকারও প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ করেছে। দুদককে সম্পৃক্ত করে যেভাবে টার্গেট করে হয়রানি করা হচ্ছে, সেটাও অযৌক্তিক।’
গতকাল সোমবার ঢাকা কাস্টম হাউসে বিডিসিএস ও ডিএম সফটওয়্যার উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভয় দেওয়ার জন্য ঢাকা কাস্টমে এসেছি। প্রত্যেকে যদি দায়িত্বশীল আচরণ করে তাদের কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে তাহলে ভয়ের (শাস্তিমূলক বদলি, সাময়িক বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর) কোনো কারণ নেই। আর কেউ কেউ হয়তো বড় আকারেরই সীমা লঙ্ঘন করেছে, সেটা হয়তো ভিন্নভাবে দেখা হবে। তবে সাধারণভাবে ভয়ের কোনো কারণ নেই।’
এর আগে গত মে মাসে এনবিআর দুই ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব নীতি নামের দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সেটি বাতিলের দাবিতে কলমবিরতিসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামেন এনবিআরের কর্মীরা।
পরে মধ্যস্থতায় কাজে যোগ দিলেও আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে অটল থাকেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। পরে সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় অফিসে ফেরেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি দায়িত্বে এসে আন্দোলনে থাকা কয়েক কর্মকর্তাকে বদলি করেন। আন্দোলনকারীরা সেমিনার করতে চাইলে সে জন্য কক্ষ বরাদ্দও আটকে দেন। সব মিলিয়ে তার সঙ্গে কর্মকর্তাদের দূরত্ব আরো বেড়ে যায়। সর্বশেষ জুনের ২১ ও ২২ তারিখে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে যান কর্মকর্তারা।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ
কিউএনবি/অনিমা/০৮ জুলাই ২০২৫,/সকাল ৯:০৩