সোমবার, ০৪ অগাস্ট ২০২৫, ১০:৩৭ অপরাহ্ন

জীবনের পরতে পরতে ঘটে যাওয়া অনিন্দ্য-সুন্দর নস্টালজিয়া

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫
  • ১৮৮ Time View

সাহিত্য ডেস্ক : বই মানুষকে আলোকিত করে। বইয়ের রয়েছে মানুষকে টানার ক্ষমতা। একটি বই পড়ে মানুষ নানা বিষয় জানতে পারে। নিজের জীবনে ভালো কাজের প্রয়োগ করতে পারে। বই পড়ে উৎসাহ পেতে পারে। বই বদলে দিতে পারে মানুষের জীবনও। আর সেটা যদি হয় আত্মজীবনীমূলক, তো কথাই নেই। একজন ব্যক্তির জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা জ্ঞানগুলো কাজে লাগে। এরকমই একটি বই ‘এক জীবনের গান’ সম্প্রতি পাঠ করেছি। বইটির প্রতিটি পাতা যেন চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আর অবাক বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ছিলাম একজন সফল মানুষের জীবনের কাহিনি। যা পড়ে মনে হচ্ছিল, আরে এ তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন কথা! যে কথা আমরাও বলতে চাই, শুনতে চাই। আমরাও এমন মানুষ হতে চাই।

সালেহ হোসেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফার্মাকোলজি বিজ্ঞানী। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, কানাডার বায়োভেইল, আনা ফার্মা, ফার্মা মেডিকো, সিনফার, আইসো অ্যনালাইটিকায় তিনি একজন ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চার হিসেবে নিরলস কাজ করে খ্যাতি লাভ করেন। গবেষণার নিষ্ঠা তাঁকে ১৯৯২-৯৬ পর্যন্ত কানাডা তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আইসো অ্যানালাইটিকার প্রেসিডেন্ট ও প্রধান কার্যনির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত করে। এই উপমহাদেশের তিনিই প্রথম বাঙালি এই পদে অধিষ্ঠিত হন।

সিলেটের অজপাড়াগাঁ মুইগড়ে বাবার হাত ধরে পÐিত মশাইয়ের কাছে পড়তে যান। প্রথমে ভয়ে তটস্থ থাকলেও পরে বুঝতে পারেন সেই পÐিত মশাইয়ের হৃদয় অনেক বড়! পরম স্নেহের পরশে তিনি পড়াশোনা করান। সেই মুইগড় থেকে শৈশবের পড়া শেষে পর্যায়ক্রমে মৌলভীবাজারের দিরাইয়ে পড়তে যাওয়া। মন্তাই ভাইয়ের সাথে বিলে মাছ ধরা। মায়ের সহযোগিতায় কষ্ট করে সাইকেল কেনা। সিলেটের মীরাবাজারে চলে আসা। কৈশোরের দুষ্টুমি। রাজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা। এমন সব বিষয় উঠে এসেছে বইটিতে।

শৈশবের বর্ণনায় আমরা দেখি কী সহজ সরল জীবন ছিল সালেহ হোসেনের। পথের ধারে মার্বেল খেলা, বিল থেকে শাপলা তোলা কিংবা  মাছ ধরার কাহিনি পড়তে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে যাবেন যে কোনো পাঠক। এছাড়া মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে সম্পর্ক তা সত্যিই পবিত্র, নির্মল ও আনন্দময়। জীবনের প্রতি পদে মায়ের সঙ্গে তার অন্তরাত্মা লেগে ছিল। জীবন চলার পথে মা যে কত বড় ধন তা সালেহ হোসেনের জীবন কাহিনি পড়ে উপলব্ধি করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সালেহ হোসেন টগবগে যুবক। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সালেহ হোসেনকে মারতে উদ্যত হলে মা এসে সামনে দাঁড়িয়ে যান। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের মুখে বেঁচে যান। এই যে জীবন পেলেন তিনি মাতৃভক্ত হয়েছেন। সবসময় মায়ের দোয়া নিয়ে চলেছেন। জীবনের পদে পদে মায়ের দোয়া তাঁকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। বড় ভাইয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ। বড় ভাইও যে পরিবারের জন্য স্যাক্রিফাইস করেছেন তা তুলে ধরেছেন সুন্দর বর্ণনায়। কলেজ জীবনে পদার্পণ করার পর জীবনের মোড় ঘোরানোর জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টায় অবিরত লেগে ছিলেন।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভালো ফল করে সিলেটের ওষুধ কোম্পানি মান্নাকো ফার্মায় জব নেন। মান্নাকো ফার্মার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডা. শফিকুর রহমান যে সহায়তা করেছেন তা আজীবন মনে রেখেছেন।  নাইজেরিয়ায় অনেকটা সিনেমাটিকভাবে বেঁচে যাওয়ার কথা। সেখানকার শিক্ষকদের সহযোগিতা। পরবর্তী সময়ে কানাডা জীবনে যেসব প্রফেসরের সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।

কৃতজ্ঞতা ভরে সবসময় মহান স্রষ্টার প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে জীবন সত্যিই অনেক সুন্দর হয় এবং জীবন চলার পথে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় যা তার জীবন থেকে দেখিয়েছেন। এছাড়া জীবনে জয়ী হওয়ার মূল সূত্র তিনি দেখেছেন কঠোর অধ্যবসায়, সততা এবং ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে জীবনযাপন করার মধ্যে।

নিজেকে একজন অতি সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার গল্প এক জীবনের গান। বইটিতে লেখক নিজের জীবনের দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা সাফল্য অর্জন ব্যর্থতা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণভাবে।

বইয়ে তিনি বলছেনÑ ‘আমার বাবা দিরাই থানার সার্কেল অফিসার। তাঁর আয়ে সংসার কোনো রকম চলে। বড় ভাই শরিফুল পড়াশোনা পরিত্যাগ করে সংসার সামলানোর দায়িত্বে, বাড়ির ধান, সুপারি, বাড়ির তিনপাশের খালের জিয়ল মাছ এগুলো মাঝে মাঝে নিয়ে আসেন আমাদের হাশিম ভাই। বাবা কদাচিৎ আসেন। মুখে হাসি দেখি না, চুন থেকে পান খসলে আমাদের জীবনপাত করেন, এই তো দেখে আসছি। 

এখন মনে হলো, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সাথে মানুষের মনের উদারতাও সম্পর্ক যুক্ত। হঠাৎ করে আমিও যেন বড় হয়ে গেলাম, পরীক্ষা শেষের পর লাইক অ্যা ফ্লাইং বার্ড আর রইলাম না। 

মা আমাদের সব ভাইবোনকে একসাথে পাটিতে বসালেন। বড় বড় দুটো পাটি। গরম ভাতে ভাপ উঠছে। সবচেয়ে ভালো দুই টুকরো মাছ আমাকে আর বড় ভাইকে দিলেন। বাকিরাও পেল। সাকি তো সব চাইতে ছোট, ওর টুকরো হলো ইলিশের কাঁটাওয়ালা লেজ। সাকির জন্য মা কাঁটা ছাড়ালেন। আমরা চুপচাপ নিঃশব্দে গ্রাস দিই। আম্মার সামনে উচ্চবাচ্য করার ক্ষমতা আমাদের কারো নেই।’

লেখক ভ‚মিকায় বলেছেন, ‘আমি গ্রামের ছেলে। আমার জীবন গানের পাতায় পাতায় তা বলেছি। আমার মতো অতিসাধারণ মানের একটা ছেলে বাইরে দেখার স্বপ্নে বিভোর থাকত। তার কল্পনার রাজ্যে সংসারের নিত্যকার টানাপোড়েন আর অভাব থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিজ্ঞা মুষ্টিবদ্ধ হতো, তখন হয়তো সৃষ্টিকর্তার করুণার হাতও আমাকে ছায়া দিত।

দিরাই, কখনো সিলেট শহর, কখনো মৌলভীবাজার, কখনো মুইগড় গ্রামের প্রায় অনিশ্চিত আটপৌরে দারিদ্র্যের জীবন দেখে শৈশব থেকেই এই বিরুদ্ধ-ক্লিষ্ট জীবনের সীমাহীন দুর্ভোগ ও দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত রাখতাম। শৈশবের দুরন্ত জীবনের আড়ালে একটাই জেদ মনের ভেতর পুষতাম, আমাকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে হবে। নিজের, মা-বাবা, পরিবারের সচ্ছলতার জন্যে আমাকে যত পরিশ্রমই করতে হোক না কেন, তা করব। এবং সকল উপার্জন নীতিনৈতিকতা ও হালাল উপার্জনের মাধ্যমে হতে হবে।

‘এক জীবনের গান’ এ অকপটে আমার জীবনকথা খুলে বলেছি শুধু একটি আকাক্সক্ষায়, তা হলো, আমার এই জীবন গল্প পড়ে যদি একজন তরুণকেও উদ্বুদ্ধ করতে পারি সেটাই হবে ক্ষুদ্র জীবনের সার্থকতা।

নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় মনোবল, লক্ষ্য অর্জনের স্থিরতা একজন সাধারণকে অসাধারণ করে তুলতে পারে, সম্ভাবনার সকল দুয়ার খুলে আমাদের প্রিয় দেশকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে। আমার এই লেখার পেছনে সেটাই মূল উদ্দেশ্য।’

বইয়ের সূচিপত্র সাজানো হয়েছে কয়েকটি পর্বেÑ শৈশবের দিনগুলি, কিশোরবেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতি, কর্মজীবন, নাইজেরিয়া যাত্রা, সংসার পর্ব, কানাডা স্মৃতি, ছবিতে আমার পথচলা। ৬৪৮ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ১২০০ টাকা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান। প্রকাশক সংযোগ প্রকাশ। বইটি রকমারি কিংবা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকেও সংগ্রহ করা যাবে। 

 

কিউএনবি/আয়শা/২৯ মে ২০২৫, /বিকাল ৩:৪৪

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

August 2025
M T W T F S S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit