শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:২২ অপরাহ্ন

শ্রমিকের টাকায় স্বপন-আমিনের বিলাসী জীবন

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫
  • ৪৯ Time View

ডেস্ক নিউজ : কারো জমি বিক্রির টাকা, কারো বা মা-স্ত্রীর গহনা বিক্রির টাকা। তিল তিল করে সঞ্চয় করা সব সম্বল বিক্রির টাকা তুলে দিয়েছেন দালালের হাতে। উন্নত জীবনের ছোঁয়া পেতে পাড়ি জমাবেন বিদেশে। শ্রমিকের রঙিন স্বপ্ন প্রতারকের খপ্পরে পড়ে বেদনার কালো রং ধারণ করেছে।

কিন্তু প্রতারকচক্র শ্রমিকের রক্ত পানি করা টাকায় দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছে অট্টালিকা। স্বপ্ন দেখা লাখ লাখ শ্রমিকের হাজার কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছে এই চক্র। এই চক্রের অন্যতম রুহুল আমিন স্বপন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক মহাসচিব। তাঁর ঘনিষ্ঠ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর ওরফে দাতো শ্রী আমিনসহ বেশ কয়েকজন সহযোগী মিলে গড়ে তুলেছেন একটি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সিন্ডিকেট।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শ্রমিকদের ঘামঝরা টাকার বিপরীতে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিদেশে গড়ে তুলেছেন অট্টালিকা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি ও ফ্ল্যাট। গড়ে তুলেছেন একাধিক কম্পানি। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নতুন দরজা খুলে যায়।

শুরু থেকেই অভিযোগ ওঠে, একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে—যার মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন রুহুল আমিন স্বপন, অন্যজন দাতো শ্রী আমিন।
 
দালাল থেকে দুর্নীতির সাম্রাজ্যে

আশির দশকে নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান রুহুল আমিন স্বপন। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে একটি রেক্রুটিং এজেন্সিতে দালালের কাজ করতেন। পাশাপাশি স্থায়ী আয়ের জন্য পিয়নের চাকরি নেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তিনি ‘ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি গড়ে তুললেও ভুয়া কম্পানিতে লোক পাঠিয়ে বারবার অফিস বদল করতে বাধ্য হন।

২০০৫ সালে দাতো শ্রী আমিনের সঙ্গে হাত মেলান তিনি। তাঁদের যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয় ভুয়া ভিসা সিন্ডিকেট। ২০০৭-০৮ সালে হাজার হাজার কর্মীকে বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে পাঠানো হয় মালয়েশিয়ায়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয় যে কর্মীদের কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে নামিয়ে রেখে পালিয়ে যায় এই চক্র। ফলে বন্ধ হয়ে যায় ওই শ্রমবাজার। পরে অভিবাসন ব্যবসায় অর্থপাচারের জন্য বেস্টিনেটের ২০ শতাংশ শেয়ার কেনেন স্বপন। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে আমিন নূরের সঙ্গে কারসাজি করে ১০০টি এজেন্সির একটি চক্র বা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভেরিটে ইনকরপরেটেডসহ পাঁচটি সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, চক্রের সদস্যরা মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকার জায়গায় গড়ে পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। অন্যায্য ও অন্যায়ভাবে চার লাখ ৯৪ হাজার ১৮০ টাকা গরিব কর্মীর কাছ থেকে আদায় করে এই চক্র অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। যার অন্তত সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকাই স্বপন-আমিন সিন্ডিকেট ‘চাঁদার’ আড়ালে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর নামে নিজেদের পকেটে পুরেছে।

অভিজাত এলাকায় বাড়ির পর বাড়ি, বিদেশে বিলাসী জীবন

অনুসন্ধানে জানা যায়, রুহুল আমিন স্বপন বারিধারা ডিপ্লোম্যাটিক জোনে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি। ওই ৯ তলা ভবনের আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। ডিপ্লোম্যাটিক জোনের ১০ নম্বর রোডের ১২/এ ভবনটি স্বপনের। এ ছাড়া বনানীতে গড়ে তুলেছেন তিনটি বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য ২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বনানীর ১২ নম্বর রোডের ১৩৩ নম্বরের ১২ তলা ভবন, বনানী কে ব্লকের ২২ নম্বর রোডের ১১ নম্বরের বাড়িও তাঁর। এ ছাড়া বনানীর ই-ব্লকের ১৩/সি রোডের ৮৯ বাড়িটিও স্বপনের। সূত্র বলছে, ওই বাড়িতে বসবাস করেন স্বপনের ছোট ভাই।

অভিজাত আবাসিক এলাকার পাশাপাশি সদ্য গড়ে ওঠা নতুন আবাসিক এলাকা বনশ্রীতেও বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন স্বপন। সূত্র জানায়, বনশ্রীর এইচ-ব্লকের ৫ নম্বর বাড়িটিও স্বপনের। দরিদ্র খেটা খাওয়া শ্রমিকের অর্থ লোপাট করে সাততলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৭ কোটি টাকা। বনশ্রীর পাশাপাশি রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এলাকা উত্তরাতেও ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসিস ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে এই বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি। উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের এই ভবনটির আনুমানিক মূল্য ৩৫ কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ঢাকার ভাটারা থানার অধীন মাদানী এভিনিউয়ে ২৪০ কাঠা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন ক্যাথারসিস গ্রুপ। জমিসহ যার আনুমানিক বাজার মূল্য কয়েক শ কোটি টাকা। এ ছাড়া গাজীপুরের টঙ্গীর শিলমুন এলাকায় ক্যাথারসিস হাসপাতালও গড়ে তুলেছেন স্বপন। সূত্র বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় তাঁর নামে-বেনামে রয়েছে প্রায় শত বিঘা জমি।

দেশে হাজার কোটি টাকার সম্পদ থাকার পাশাপাশি দুবাই, মালয়েশিয়া, লন্ডন, সৌদি আরব ও কানাডায় বিনিয়োগ রয়েছে স্বপনের। এর মধ্যে দুবাই, মালয়েশিয়া, লন্ডনে তাঁর রয়েছে ফ্ল্যাট। সৌদি আরবে তাঁর খেঁজুর বাগান রয়েছে। সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কানাডায় সপরিবারে অবস্থান করছেন তিনি। টরন্টোর ডাউনটাউনের পশ্চিমে পার্কডেল এলাকায় বাড়ি কিনেছেন তিনি। যার আনুমানিক মূল্য ২৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া কানাডার মিসিসওগা শহরেও তাঁর বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর একাধিক গাড়ি রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হন তিনি।

রুহুল আমিন স্বপন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী-এমপিদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় গত সরকারের আমলে তাঁর অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি দুদক ও এনবিআরের তদন্তে নতুন গতি এসেছে। একাধিক এজেন্সি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিদেশে অর্থ স্থানান্তরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের মধ্যেই অন্তত ১২৩ কোটি টাকা মালয়েশিয়া, দুবাই ও যুক্তরাজ্যে পাচার করেন তিনি।

মালয়েশিয়ায় দাতো আমিনের সাম্রাজ্যে

সূত্র জানায়, দারিদ্র্যের কশাঘাতে নব্বয়ের দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান দাতো শ্রী আমিন। উচ্চশিক্ষায় অগ্রসর হতে না পারলেও চতুরতায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিছুদিনের মধ্যে তিনি জড়িয়ে পড়েন পাসপোর্ট জালিয়াতিসহ নানা অপরাধে। গলাকাটা পাসপোর্টে বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়ায় অবৈধ প্রবেশে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। অপরাধে জড়িয়ে একাধিকবার কারাভোগ করেন মালয়েশিয়ায়। একটি কম্পানির ৫০০ পাসপোর্ট জালিয়াতির ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ীর রূপ নেন তিনি।

২০০৭-০৮ সালে হাজার হাজার বাংলাদেশিকে ভুয়া ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেন তিনি ও তাঁর দালালচক্র। ওই সব কর্মীর বড় অংশ কারাভোগ শেষে শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়। এর জের ধরেই মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয়। তবে এই নিষেধাজ্ঞার আগেই দাতো আমিন হাতিয়ে নেন শ শ কোটি টাকা। বিপুল অর্থের জোরে তিনি পেয়ে যান মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব ও ‘দাতো শ্রী’ উপাধি। এরপর ২০১৬ ও ২০২২ সালে আবারও সিন্ডিকেট করে হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে স্বপনের মধ্যমে অর্থ পাচার করে মালয়েশিয়ায় নিতেন আমিন। এ জন্য ব্যবহার করা হতো তাঁর ১৯টি কম্পানিকে। তাঁর চতুরতায় এখন পর্যন্ত মালেশিয়ান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। মালেশিয়ায় থাকা তাঁর কম্পানিগুলো হলো—বেস্টিনেট আইটি সলিউশনস, বেস্টিনেট পেমেন্ট সার্ভিসেস, সোলেস এশিয়া, টিএফজি দ্য ফার্ম গ্রুপ, ব্রডফিল্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস, (আগে বেস্টিনেট এফডব্লিউকিউএস,) ক্রিস্টাল ক্লিয়ার টেকনোলজি, এটিলাইস এআই, কানেক্টেড মোবিলিটি টেকনোলজিস, অ্যাটিলজে ডিজিটাল, জিথ্রি টেকনোলজিস, এজিথ্রি, এটিলাইজস সলিউশন, জিথ্রি হেলথ, জয়েন্ট রিসোর্সেস এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি, বেস্টিনেট টেকনোলজি, কেরিকম, কুনচি সেমাঙ্গাত, মাসডটস, র‌্যাফলসকেয়ার (এম) এসডিএন বিএইচডি (মালেশিয়ায় প্রাইভেট লিমিটেড কম্পানির ক্ষেত্রে এটি লেখা হয়)। এ ছাড়া কানাডা, দুবাই, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে রুহুল আমিন স্বপনকে ফোন করা হলে তাঁর নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক আজম শাহের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘স্যার কানাডায় রয়েছেন, দুই মাস আগেও দেশে এসেছেন। আপনারা যোগাযোগ করেন, উনাকে পাবেন।’ এরপর তাঁর হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে ফোন করলে তা-ও বন্ধ পাওয়া যায়।

কিউএনবি/অনিমা/০১ মে ২০২৫,/সকাল ১০:১১

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit