 
																
								
                                    
									
                                 
							
							 
                    আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পরে সোমবার প্রথমবারের মতো ভারত সফরে এসেছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। চারদিনের এই রাষ্ট্রীয় সফরে সোমবার রাতে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের ঘণ্টা দুয়েক আগেই সব দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেন। এখন থেকে তার নীতি কেমন হতে যাচ্ছে তারও একটি স্পষ্ট ছবি তিনি তুলে ধরেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির বৈঠকের পরে নতুন হারে মার্কিন শুল্কের ব্যাপারে বড় ধরনের ছাড় বা সমস্যাটির কোনো স্থায়ী সমাধান পাওয়া না গেলেও দুই দেশের বাণিজ্যিক ভারসাম্য আনতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির খসড়া নিয়ে ভারতীয় প্রতিনিধি দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হওয়ার আগেই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স সোমবার ভারতে এলেন। এই সফরে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠকে অর্থনীতি, বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স ট্রাম্পের নীতিমালা নিয়ে খুবই আক্রমণাত্মক। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি ট্রাম্পের থেকেও বেশি প্রশ্ন করছিলেন।
শুধু তাই নয়, ওভাল অফিসে বসেই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের সঙ্গে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভান্স। এছাড়া জার্মানির মিউনিখেও তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সামাজিক মাধ্যম নিয়ে ইউরোপীয় আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।
বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে কেন সক্রিয় জেডি ভান্স?
এসব থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তিনি এর আগের ভাইস প্রেসিডেন্টদের মতো বিনীত রাজনৈতিক হিসেবে কাজ করবেন না।
ট্রাম্পের বিদেশ নীতিকে যুক্তি দিয়ে হাজির করেন, এমন একজন নেতা হিসাবেই ভান্সকে দেখা হচ্ছে। তিনি হোয়াইট হাউসে বসেই জেলেনস্কির যেভাবে সমালোচনা করেছিলেন, তা রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল।
এ কারণেই কেউ কেউ তাকে ট্রাম্পের উত্তরসূরি হিসেবে দেখছেন। তিনি ইতিমধ্যেই এমন একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন যা তিন বছর পরে নির্বাচনি প্রচারের ভিত্তি হয়ে উঠবে। সেবার ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির হয়ে আর রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হবেন না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক প্যারিস সম্মেলনে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্সের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকটিকে আন্তরিক করে তুলতে ভান্সের দুই ছেলে ও এক মেয়ের জন্য উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন মোদি।
দুই দেশই চেষ্টা করছে যাতে পারস্পরিক আস্থা বজায় রেখে যত দ্রুত সম্ভব দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিটি চূড়ান্ত করা যায়। ভারতের কাছে যুক্তরাষ্ট্র যেমন একটা বড় বাজার আবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত হল কৌশলগত বন্ধু। এমনই এক পরিস্থিতিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্সের সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক মিশন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-লড়াই শুরু হওয়ার পর আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করতে কাজ করছে ভারত, যাতে দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে বাণিজ্য চালানো যায়।
অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ দিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিদেশ নীতি বিভাগের উপাধ্যক্ষ।
তিনি বলছেন, অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় আমেরিকা ভারতের সঙ্গে অনেক বেশি বৈঠক করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরে যে বড় পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল, এখন সেটিই বাস্তবায়িত করার কাজ চলছে।
তার কথায়, মার্কিন উপরাষ্ট্রপতির এই সফর আমলাতন্ত্রকেও একটি বার্তা দেবে যে সবকিছু সঠিক পথেই রয়েছে।
‘পরিস্থিতি ভারতের অনুকূলে’
অর্থনীতি বিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক অংশুমান তিওয়ারি বলছিলেন, ভারতের তরফে রাজেশ আগরওয়াল কমিটি দুদিন পরেই আমেরিকায় একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করবে। তার আগে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করবেন জেডি ভান্স। তাই এই বৈঠকের গুরুত্ব যথেষ্ট।
তার কথায়, আমেরিকার প্রধান অংশীদার চীন, কানাডা, মেক্সিকো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুল্ক নিয়ে আগ্রাসী অবস্থান নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে এমন চুক্তি করতে চাইবে, যা তারা গোটা বিশ্বকে দেখাতে পারবে।
তার ব্যাখ্যা, দুই দেশের মধ্যে ১৯টি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হবে। এক্ষেত্রে ভারত অনেক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে। এই সময়ে পরিস্থিতি ভারতের অনুকূলে রয়েছে আর ভারতের দর কষাকষির ক্ষমতাও বেড়েছে। এর ফলে আলোচনায় একটা ভারসাম্য বজায় থাকবে কারণ দুই দেশেরই এটা প্রয়োজন আছে। ভারত যদি কিছুটা ক্ষমতা দেখায় তাহলে আরও অনেক কিছুই আদায় করে নিতে পারবে।
অবৈধ অভিবাসী ও ছাত্রদের প্রত্যাবর্তন
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ১৬০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত প্রায় এক হাজার ছাত্রছাত্রীর ভিসা বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরাও আছে। এছাড়াও অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াও চলছে।
অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ বলেন, অবৈধ অভিবাসীদের প্রশ্নে ভারত আমেরিকার পাশেই রয়েছে। দিল্লি ইতিমধ্যেই নথি-বিহীন ভারতীয় অভিবাসীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছিলেন অবৈধ অভিবাসীদের প্রশ্নে ‘আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম।
তিনি আরও বলেছিলেন, যদি কোনো ভারতীয়কে যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে বসবাসের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়, তবে আমরা তাদের ভারতে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
অধ্যাপক পন্থ বলছেন, ভারত শিক্ষার্থীদের ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘সংবেদনশীল ব্যবহার’ দাবি করতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে দুই দেশের কৌশলে কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। শুধু ভারত নয়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কোনো দেশই এই বিষয়টা সরাসরি উত্থাপন করতে পারবে না, কারণ এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
ভারত-বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বরের মুম্বাই হামলার মূল চক্রী তাহাউর রানাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। এছাড়া গত ১৮ এপ্রিল পাঞ্জাবে জঙ্গি হামলায় অভিযুক্ত হরপ্রীত সিংকে গ্রেফতার করে এফবিআই।
অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ বলছেন, ট্রাম্প যখন আইন মেনে চলা অভিবাসীদের নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন, তখন তিনি কেন এ ধরনের কাজে লিপ্ত মানুষকে সেদেশে রাখবেন? এটা তাদের এজেন্ডার সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই।
তিনি বলছেন, এটা ভারতের জন্য লাভজনক এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। অতীতে দেখা গেছে, ভারত ওয়ান্টেড ব্যক্তিদের তালিকা ধরিয়ে দিত কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার দিকে নজরও দিত না। কিন্তু এখন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কের আরও উন্নতি হতে পারে।
চীনের মোকাবিলা
জেডি ভান্সের সফর এমন একটা সময়ে হচ্ছে যখন দুই দেশই ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রুখতে চায়। একই সঙ্গে আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোয়াডে যুক্ত হয়ে ভারত কৌশলগত অংশীদার হিসাবে এই অঞ্চলে ভারসাম্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থের কথায়, ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও এই অঞ্চলে তাদের অবস্থান শক্ত করতে জাপান থেকে ফিলিপাইন্স সফর করেছেন। আবার ভান্সও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ওপরে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় এই সব লড়াই শেষ হোক যাতে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়া যায়।
কিউএনবি/আয়শা/২২ এপ্রিল ২০২৫,/বিকাল ৩:৩৩