‘লাইজ্জের দূরে আছলো নদীডা’অবৈধ ইটভাটায় নাসিরনগরে নদী ভাঙ্গন অব্যাহত
বাদল আহাম্মদ খান ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি ।
Update Time :
বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৩
১২৬
Time View
বাদল আহাম্মদ খান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রতিনিধি : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার মেঘনা তীরবর্তী চাতলপাড় এলাকার চকবাজারে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ বাজার সংলগ্ন একটি মসজিদ ভেঙে পড়েছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুম নিয়ে আতঙ্কে আছেন সেখানকার বাসিন্দারা। অভিযোগ রয়েছে, বাজারের ওপারে থাকা ইটভাটা দিন দিন নদী দখল করায় এপারে অতিরিক্ত ভাঙন দেখা দিয়েছে। কোনো ধরণের লাইসেন্স না থাকা ইটভাটাটি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলে এটিতে উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে।
সরজমিনে গেলে নদীপাড়ে জটলা দেখে নৌকার মাঝি মহিবুল্লাহ বলছিলেন, ‘নদীডা কাডা অইবো নি। নদী কাডনের লোক আইছে না কিতা।’ ভুল ভাংগিয়ে আরেক মাঝি হোসেন মিয়া বললেন, ‘আরে না। সাম্বাদিক আইছে। হেরা খুজ নিতাছে।’ল
মো. হোসেন মিয়া ৩০ বছর ধরে ও মো. মহিবুল্লাহ ২০ বছর ধরে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। সোমবার দুপুরে নদীভাঙ্গন নিয়ে কথা বলতে গেলেই এ প্রতিবেদকে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে মাঝি মহিবুল্লাহ বলেন, ‘লাইজ্জেও (অনেক) দূরে আছলো নদীডা। একদিক দিয়া বাংতে বাংতে শেষ। আরেকদিক দিয়া বরাট কইরা লাইছে।’ ইটভাটার কাছের নদীর সীমানা চিহ্ন দেখিয়ে মাঝি হোসেন মিয়া বললেন, ‘ক বছর আগেঅ এমনে দিয়া নৌকা আইতো। অহন গুইরা আওন লাগে।’
চাতলপাড় বাজারে একের পর এক বাড়ি, দোকানঘর ও প্রতিষ্ঠান ভাংগার জন্য ওপারের একটি ইটভাটাকে দায়ী করলেন স্থানীয় লোকজন। জোনাকী ব্রিকস ফিল্ড নামে ওই ইটভাটাটি কিশোরগঞ্জর উপজেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা সদর দপ্তরের এক আদেশে জরিমানা করার পাশাপাশি ইটভাটাটি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই আদেশে ইটভাটাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত স্থানে (শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে) প্রতিষ্ঠিত বলে উল্লেখ করা হয়।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, আদেশের পর কিছুদিন ভাটাটি বন্ধ রাখা হয়। এখন ভাটাতে পুরোদমে উৎপাদন হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করায় মামলা দিয়ে ও নানাভাবে হুমকি দিয়ে এলাকার মানুষকে ভয় দেখানো হচ্ছে। মামলায় সাতজনকে জেলও খাটতে হয়। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নদীর দক্ষিণ দিকে নাসিরনগরের চাতলপাড় ও উত্তরে অষ্টগ্রামের নোয়াগাঁও গ্রাম। চাতলপাড় বাজারের ঠিক উল্টোদিকে জোনাকী ব্রিকস ফিল্ড। ব্রিকস ফিল্ডটি একেবারে নদীঘেঁষা। এর সামনের অংশ নতুন করে ভরাট করা হয়েছে বলে এলাকার লোকজন অভিযোগ করেন। যে কারণে নৌযান গুলোকে চাতলপাড় বাজার ঘেঁষে চলতে হয়। এতে বাজারে একের পর এক ভাঙন দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ একটি মসজিদ ভেঙে যায়। এ পর্যন্ত ২৫-৩০ টি স্থাপনা ভেঙে গেছে।
চাতলপাড়ের শেখ মহিউদ্দিন পিয়ার বলেন, ‘আমার চোখের সামনে অনেক ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে। প্রতি বছরই ইটভাটার জন্য একটি রাস্তা নির্মাণ করা হয় নদী ভরাট করে। পরে রাস্তাটি না কাটায় ধীরে ধীরে নদীর অংশ ভরাট হয়ে বড় আকার ধারণ করে। গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় নদীর তীব্র স্রোতে চাতলপাড় অংশে একের পর এক ভাঙন দেখা দিয়েছে।’ মো. জাহেন মিয়া ও মো. তাজুল ইসলাম নামে দুই ব্যক্তি অভিযোগ করেন, এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়। এ মামলায় প্রায় এক মাসের মতো জেল খাটতে হয়। এছাড়া নানাভাবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) মো. তৈয়ব হোসেন বলেন, ‘ইটভাটার কারণে আমাদের বাজার ভেঙ্গে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ইটভাটার ধোঁয়ায় আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জমির অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’ আরেক সদস্য তারু মিয়া বলেন, ‘আমাদের একটাই দাবি ইটভাটাটি সরিয়ে দেওয়া হোক।’জোনাকী ব্রিকস ফিল্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পুরোদমে ইট উৎপাদন চলছে। পুরোনো পদ্ধতির চিমনিতেই চলছে ইট উৎপাদনের কাজ। ওই চিমনি দিয়ে একটু পর ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ইটভাটার ঠিক উত্তর পূর্ব দিকে নদীর সীমানার একটি পিলার দেখা যায়, যেখানে নৌযান এসে থামতো বলে স্থানীয়রা জানান। তবে ওই সীমানা থেকে অনেক দূর পর্যন্ত ভরাট জায়গা এখন ইটভাটার দখলে।
দেখা হয় ইটভাটার মালিক মো. জাহেরের আত্মীয় মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার স্বজনদের জায়গাতে এ ইটভাটা করা হয়। ইটভাটা করতে গিয়ে নদীর কোনো জায়গা ভরাট করা হয়নি। মূলত নদীর খনন না করলে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে না।’ইটভাটার মালিক মো. জাহের মঙ্গলবার বিকেলে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমার ইটভাটা নদী থেকে অনেক দূরে। চাতলপাড়ের মানুষ তো চায় এপারের নোয়াগাঁও গ্রামটিই চলে যাক। আর আমি অনুমোদন নিয়েই ইটভাটা পরিচালনা করছি।’বুধবার বিকেলে কথা হলেন পরিবেশ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের সহকারি পরিচালক রুবাইয়াত তাহরিম সৌরভ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ইটভাটাটি অবৈধ। নির্দেশ পেয়ে তারা সেটি বন্ধও রাখে। এ মর্মে আমি একটি প্রতিবেদনও পাঠাই। এখন মালিকদের মধ্য থেকে জাহের মিয়া নামে একজন ভাটাটি চালাচ্ছে বলে শুনেছি। এরই মধ্যে একটি আইনী নোটিশ আমাকে পাঠানো হয়েছে ভাটার পক্ষ থেকে। বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনজুর রহমান বলেন, ‘চাতলপাড় এলাকায় ওপারে একটি ইটভাটা আছে। সেখানে নদীভাঙন রোধে কাজ চলছে। ‘ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার সমন্বিত পনি ব্যবস্থাপনা নিমিত্ত সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প’ নামে যে কাজ চলছে সেটি শেষ হবে এ বছরের জুন মাসে। এরপর করণীয় বিষয়ে প্রকল্প নেওয়া হবে।’