বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৩২ অপরাহ্ন

শাহ্জাদীর কালো নেকাব

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০২২
  • ৪০৮ Time View

শাহ্জাদীর কালো নেকাব
——————————-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শতবর্ষ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে টিএসসিতে আগামী ২৫শে নভেম্বর ২০২২ খ্রিস্টাব্দে। শতবর্ষ মিলন মেলার রেজিস্ট্রেশন অনেকেই করেছে। শেষ মুহূর্তে কারা কারা রেজিস্ট্রেশন করেনি, এটা খোঁজ নিতেই জানতে পারলাম সুদূর আমেরিকা প্রবাসিনী এক বান্ধবী রেজিস্ট্রেশন করেনি। তাকে ব্যাখ্যা দিলাম উপস্থিত হতে না পারলেও রেজিস্ট্রেশন কর। শতবর্ষ মিলন মেলা উপলক্ষে দর্শন বিভাগ থেকে যে স্মরণিকা বের করবে তা মূলতঃ একটি ডাইরেক্টরি। সকলের ছবি সহ তথ্য থাকবে। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে প্রবাসিনী বান্ধবী বলল, তাহলে আমার টাও করে দাও। আমি ওর কাছ থেকে মেসেঞ্জারে সব সব তথ্য নিলাম। কিন্তু গ্যাঞ্জাম সৃষ্টি হলো বান্ধবীর ছবি নিয়ে।

প্রবাসিনী বান্ধবীটি খুব পরহেজগার। পর্দানশীন। ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারে তার শিশু সন্তানের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছে কয়েক বছর যাবৎ। সেই শিশু পরিণত হয়ে এখন নিজেই এক শিশুর পিতা হয়েছে। তবুও বান্ধবীর প্রোফাইল পিকচার আর পরিবর্তন হয় না। আমি বারবার মেসেঞ্জারে ছবির জন্যে নক দিচ্ছি। বান্ধবী এই দেই, দিচ্ছি করে কালক্ষেপন করছে। আমি মনে মনে হাসছি। মজা করে করে একটা কালো নেকাব পড়া ছবি পাঠিয়ে বললাম, (সংযুক্ত ছবি) সে ছবি দেখে বান্ধবী রেগে আগুন। ঘন্টা খানেক পর সে ছবি পাঠাল। আমার মনে হয় সে নিজের সাথেই যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে ছবি পাঠিয়েছে।

প্রবাসিনী এই বান্ধবী পরাজিত হলেও দর্শনে পড়ুয়া আরেক বান্ধবী পরাজিত হয়নি। আজ তার কথাই বলব বলে এতক্ষন ভূমিকা টানলাম। ২৩ বছর পূর্বের সেই কাহিনীতে আপনাদেরকে ঘুরিয়ে আনতে সকলকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

সময়টা ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে গাইবান্ধার বোনার পাড়ার তুষার নামে এক ছাত্র কিডন্যাপ হয়ে যায়। তুষারের বাবা বোনারপাড়ার ধর্ণাঢ্য একজন ব্যবসায়ী। একনামে সবাই তাকে চিনে। অপহৃত তুষারের মামা বাড়ী আসামের গৌহাটিতে। তার একমামা আমাদের কুড়িগ্রামে ব্যবসা করেন। তিনি আমার কাছে এসে ভাগ্নে অপহরণের কাহিনী শোনালেন। ৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে। তুষারের মামা আমার কাছে হেল্প চাইল ভাগ্নে উদ্ধারের বিষয়ে। ঢাকার ডিবি অফিসে দুর্দান্ত এক পুলিশ অফিসারের সাথে আমার জানাশোনা। আমি তাকে ফোন করে ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, কুড়িগ্রাম থেকে তদবির করে কাজ হবেনা। তুমি দ্রুত ঢাকায় চলে আসো। আমি তুষারের মামাকে নিয়ে তখনই রওয়ানা দিলাম সৈয়দপুরের উদ্যেশ্যে। সারাদিনে মাত্র একটি ফ্লাইট তখন ছিল, তাও বিকালে।

শীতের পড়ন্ত বিকেল। সন্ধ্যা যেন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। কুড়িগ্রাম থেকে ফোনে বিমানের রিজার্ভেশন করেছিলাম। আমি দ্রুত সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট স্টেশন ম্যানেজারের রুমে ঢুকলাম। টিকেট ইস্যু করতে হবে। ম্যানেজারের সাথে কথা বলতেই পিছন থেকে এক নারীকণ্ঠ বলল, তুমি আমাদের লুৎফর না? আমি পিছনে ফিরে বললাম, আমি লুৎফর রহমান। আপনি ? আমাকে তুমি সম্বোধন করা নারীটি আপাদমস্তক বোরকা পড়া। মুখটা কালো নেকাবে ঢাকা। চোখে চশমা। এমনকি হাতের আঙ্গুলগুলো দেখার কোন সুযোগ নেই। কালো হাতমোজা পরে আছে। পায়ের দিকে তাকালাম, একই অবস্থা।

লুৎফর আমি তোমার বান্ধবী রিনা। আমরা একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, দর্শন বিভাগে। আমি নীলফামারী গভঃ কলেজে গত সপ্তাহে জয়েন করেছি, লেকচারার হিসাবে। আজ ঢাকা ফিরছি। কিন্তু আমি মনে হয় যেতে পারছিনা। একটা সমস্যায় পড়েছি। আমি বললাম, কি সমস্যা ? শাহ্জাদীর কালো নেকাবে ঢাকা, আমার প্রিয় বান্ধবী রিনা জানালো, বিমানের ভাড়া ১০৬০ টাকা আগে ছিল। আমি সেটা জেনে ১১০০ টাকা রেখেছিলাম। এখন এখানে এসে দেখি বিমানের ভাড়া ২/৩দিন আগে বাড়িয়েছে। এখন ১৩০০ টাকা। ২০০ টাকার জন্যে আমি ঢাকা যেতে পারছিনা। আমি বললাম, দূর পাগলী, এটা কোন সমস্যা হলো, দাও তোমার টাকা আমি টিকেট কেটে দিচ্ছি। আমি রিনা ও আমার টিকেট কাটলাম। এরপরে বোর্ডিং পাস নিলাম। আমাদের দুজনের সিট একসাথেই।

বিমানে উঠে আমি রিনাকে বললাম, এখন তোমার নেকাবটা সরাও। দেখি, তুমি আমার কোন বন্ধু ছিলে ? রিনা নেকাবের ভিতর থেকে খিলখিল করে হেসে উঠল। আমাকে দেখলেতো তুমি চিনবেনা। কারণ তুমি আমাকে কোনোদিনই দেখোনি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, রিনার চোখের দিকে। পাওয়ার্ড চশমার গ্লাসে সে চোখও বিদঘুটে দেখাচ্ছে। আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম।

রিনা একাই বলে যাচ্ছে। তোমরা কেউ আমাকে দেখোনি। এই বোরকা, এই নেকাবের ভিতরেই আমার জীবন। আমাদের কিছু বান্ধবী আমাকে দেখেছে ছাত্রীদের কমনরুমে, যখন হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতাম। এছাড়া কেউ দেখেনি। রিনা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি বিয়ে করেছ ? আমি গতমাসে বিয়ে করেছি। ১৬ স্পেশাল বিসিএসে টিকে গেলাম। বাবা মা বিয়ে করতে বলল, তাই রাজি হয়ে বিয়ে করলাম। আমি রিনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিয়ের আগে তোমার হাজবেন্ড তোমাকে দেখেনি? রিনা হেসে বলল, দেখেছে, আমাকে নয়, আমার আইডি কার্ডের ছবিটা।

বিমান ল্যান্ড করল ঢাকায়। দুজনে সরাসরি বের হয়ে আসলাম। আমাদের কোন লাগেজ নেই। শুধু হ্যান্ডব্যাগ। এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে রিনার হাজবেন্ড। রিনা পরিচয় করে দিল ওর হাজবেন্ডের সঙ্গে। স্বামীর কাছ থেকে ২০০ টাকা নিয়ে জোড় করে আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিল রিনা। আমাকে ওদের গাড়িতেই উঠতে হল। রিনা যাবে তেজকুনিপাড়া। আমাকে বলল, ফার্মগেটে তুমি নেমে যেও।

বন্ধু তৌহিদ এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান। ওকে ফোন করে ২৩ বছর আগের রিনার কথা জিজ্ঞাসা করতেই তৌহিদ জানালো, রিনা এখন বদরুন্নেসা কলেজের অধ্যাপক। আমি বললাম, হ্যারে, রিনা দেখতে কেমন ? তৌহিদ হেসে বলল, রিনা দেখতে অবিকল খালেদা জিয়ার মত। বিশ্বাস না হলে, শিউলিকে জিজ্ঞাসা করে দেখ। ওরা খুব কাছের বন্ধু ছিল। আমি শিউলিকে ফোন করে রিনা প্রসঙ্গ তুললাম। রিনা দেখতে কেমন ছিল, জানতে চাইলাম। শিউলি হাসতে হাসতে বলল, রিনা দেখতে অবিকল শেখ হাসিনার মত। আসলে এরা কেউ কোনদিন দেখেনি রিনাকে। শাহজাদীর কালো নেকাবে সে থাকুক তার মত, ভাল থাকুক আমাদের পর্দানশীন বন্ধুরা।

 

 

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ।

 

 

 

 

 

কিউএনবি/বিপুল/২১.১১.২০২২/রাত ৮.২০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit