ডেস্ক নিউজ : নারী শ্রমিকদেরকে বিদেশে পাঠানোর আগে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া অনেককে পাঠানো হচ্ছে। বয়স লুকিয়ে ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করে তাদেরকে মধ্যপ্রাচ্যেরসহ বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছে দালাল চক্র। কখনো প্রশিক্ষণের জাল সনদ দেখিয়ে, আবার কোনো সনদপত্র ছাড়াও দালাল চক্র ও কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি বর্হিগমনের ছাড়পত্র পাচ্ছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কাছ থেকে। প্রশিক্ষণের সনদ ছাড়া বর্হিগমনের ছাড়পত্র না দিতে নীতিমালা থাকলেও বিএমইটির শীর্ষপর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তা তা দিচ্ছেন বলে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
ঢাকার ‘ট্রান্স এশিয়া ইন্টিগ্রেট সার্ভিসেস’ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গত বছরের আগস্টে ২৩ কর্মী সৌদিতে যান। বিদেশে যাওয়ার আগে বিএমইটির কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে প্রশিক্ষণের সনদ জমা দিতে হয় বর্হিগমনের ছাড়পত্র পেতে। যাত্রার আগে ওই ২৩ জনের জন্য একক বর্হিগমনের ছাড়পত্র পেতে ট্রান্স এশিয়ার করা বিএমইটির কাছে আবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাদের মধ্যে ১৬ জনের প্রশিক্ষণের সনদপত্র থাকলেও ৭ জনের তা নেই। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মহামারির কারণে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বন্ধ থাকায় তারা প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি বলে দাবি করা হয়। ওই আবেদনে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (কর্মসংস্থান) নাজরিফা শ্যামা, জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা খুরশিদা আক্তার, বর্হিগমন শাখার পরিচালক হাসান মাহমুদ ও উপরিচালক আসাদুজ্জামান মোল্লা বর্হিগমনের অনুমতি দিয়ে স্বাক্ষর করেন গত বছরের আগস্টে।
ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সি সেন্ট্রাল ওভারসিজ সখিনা আক্তার নামে এক নারীকে দুবাই পাঠায় গত বছর। তার ভিসা নম্বর- ৩০১/২০২১/১৮৯৭৮। সখিনার প্রশিক্ষণ সনদের বিবরণে কোনো কিছু উল্লেখ না থাকলেও বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (কর্মসংস্থান), জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা, বর্হিগমন শাখার পরিচালক, উপরিচালক বর্হিগমনের অনুমতি দিয়ে স্বাক্ষর করেন গত বছরের আগস্টে। ওই বছরের ৬ আগস্টে সখিনার দুবাইয়ে যাওয়ার ফ্লাইট নির্ধারিত হয় বলে রিক্রুটিং এজেন্সির কাগজপত্রে উল্লেখ আছে।
একইভাবে গত বছরের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর আল সুপ্ত ওভারসিজের মাধ্যমে সৌদি আরবে যাওয়া দুজন নারী কর্মীর মধ্যে এক একজনের প্রশিক্ষণ সনদপত্র না থাকলেও বর্হিগমনের ছাড়পত্র পান।
যোগাযোগ করলে বিএমইটির পরিচালক (প্রশাসন ও ইমিগ্রেশন) জাকির হোসেন এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি এখানে যোগদান করেছি ওই সময়ের পরে। তবে যারা প্রবাসে আগেও থেকে এসেছেন, তাদের বেলায় প্রশিক্ষণের দরকার হয় না। ’
জানা যায়, চলতি বছরের আট মাসে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে গেছেন ৭৬ হাজার ৫৭৯ নারী কর্মী।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) প্রতিবেদন বলছে, ‘৬৪% নারী কর্মী দালালদের টাকা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যান। বিনা খরচে মধ্যপ্রাচ্য যাওয়ার কথা থাকলেও তারা তা পারছেন না। বিদেশে নির্যাতিত হয়ে চুক্তির আগেই দেশে ফিরে আসছেন অনেকে। ’ প্রশিক্ষণ ছাড়া বিদেশে গিয়ে অনেকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে যাওয়া এমন অন্তত ৫২ নারী কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে শুধু গত আগস্ট মাসেই ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
২০২১ সালের ৩১ জুলাই নারী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যান মানিকগঞ্জের সিংগাইরের শিমু বেগম (ছদ্মনাম)। বিদেশে যাওয়ার আগে নারী কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক ২১ দিনের প্রশিক্ষণ তিনি নেননি। দালালরা টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণের জাল সনদপত্র বানিয়ে ও তিন সন্তানের মা শিমুর বয়স কম দেখিয়ে তাকে বিদেশে পাঠান।
তার স্বামীর অভিযোগ, সৌদিতে পৌঁছানোর পর শিমুকে দেশটির এক পুরুষ নাগরিকের কাছে পাঁচ হাজার রিয়ালে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ওই লোক শিমুর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। তিনি স্ত্রীকে উদ্ধার করে সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের সেফ হোমে রেখে তারপর দশে ফেরানোর আবেদন জানিয়েছেন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, গত পাঁচ মাস ধরে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
সৌদিতে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারীকর্মী আয়েশা আক্তার (ছদ্মনাম) যৌন নির্যাতনের শিকার মর্মে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তার ভাগ্নে মোশারফ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খালা (মায়ের বোন) প্রশিক্ষণ ছাড়া দালালদের মাধ্যমে বিদেশে যান। ’
ওয়েজ আর্নার্র্স কল্যাণ বোর্ডের সহকারী পরিচালক মাসরীনা আলম আজমী গত ২৭ সেপ্টেম্বর সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে চিঠি লেখেন আয়েশা আক্তারকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নিতে। এ ছাড়া গত ২৫ সেপ্টেম্বর আর্নার্স বোর্ড কুমিল্লার নারীকর্মী হেনা আক্তারকে (ছদ্মনাম) দেশে ফিরিয়ে আনতে দূতাবাসকে জানায়। ওই প্রবাসী শ্রমিকের বাবা আবুল কালামের আবেদনের প্রেক্ষিতে হেনাকে দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে বলে বোর্ড।
আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পক্ষে দূতাবাসের কাছে অনুরোধ জানানোর পরও নারী কর্মীদের দেশে ফিরতে বাধা হয়ে থাকে নানা জটিলতা। পাবনার বেড়ার আমেনা খাতুনকে (ছদ্মনাম) উদ্ধার করে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে কল্যাণ বোর্ড সম্প্রতি লিখিতভাবে সৌদিস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসকে জানায়।
এ বিষয়ে দূতাবাসের শ্রম বিভাগের সচিব (প্রথম) মো. আরিফুজ্জামান গত ১ সেপ্টেম্বর আর্নার্স বোর্ডের মহাপরিচালককে চিঠি লেখেন। এতে তিনি জানান- ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সি ‘ওয়াল্ড ওয়াইড হিউম্যান রিসোর্স এন্ড প্লেসমেন্ট সেন্টারের’ মাধ্যমে গৃহকর্মী ভিসায় আমেনা সৌদিতে যান। বর্তমানে তিনি মদিনায় আছেন। তিনি দেশটিতে থাকতে রাজি নন।
ওই নারীকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সৌদির রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক নাওয়াজ আল আনাফিকে অনুরোধ করে দূতাবাস। গৃহকর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত আর্থিক ব্যয়ের বিষয় থাকায় ‘ওয়াল্ড ওয়াইডের’ মালিক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে সৌদি থেকে যোগাযোগ করেন দূতাবাস প্রতিনিধি। আজাদ সৌদি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবেন বলে দূতাবাসকে জানান। তবে গত প্রায় এক মাসের মধ্যেও আমেনা খাতুন দেশে ফিরতে পারেননি। এ বিষয়ে আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমেনা খাতুন কখন দেশে ফিরতে পারবেন, তা এখন বলা যাচ্ছে না। ’
কিউএনবি/আয়শা/০৫ অক্টোবর ২০২২,খ্রিস্টাব্দ/রাত ৮:০৪