জালাল আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি : দেশকে এগিয়ে নিতে হলে,সমাজ কে এগিয়ে নিতে হলে সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নাই।সাংবাদিকতাকে বিকশিত করার জন্য একাডেমিক এবং ইন্ডাষ্ট্রি সম্পর্ক কে উন্নত করতে হবে।
মালিক পক্ষের সাথে সাংবাদিকদের সম্পর্কের বোঝাপড়া ভালো হতে হবে। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর(২০২২) বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী অডিটোরিয়ামে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত ” Interaction and Interdependence between Academia and industry” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে দেশবরেণ্য সাংবাদিক,শিক্ষক এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য রাখেন আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ডঃ গোলাম রহমান,
ডিবিসি নিউজ প্রধান নির্বাহী জায়েদুল আহসান পিন্টু , অধ্যাপক শামীম রেজা, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন , এপি নিউজের ব্যুরো চিফ জুলহাস আলম , সাংবাদিক মুন্নী সাহা, নাইমুল ইসলাম খান, মনজুরুল আহসান বুলবুল, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা প্রমুখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেছেন, আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষ থেকেই বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করে। নবীন হওয়ার কারণে তারা কম বেতনে চাকরি করে। তবে তারা মিডিয়া হাউজ থেকে অনেক কিছুই শিখে। আমি বিভাগের চেয়ারম্যান থাকার সময় একটা মাল্টিমিডিয়া ল্যাব স্থাপন করতে চেয়েছিলাম।২০১৯ সালে ইউজিসি হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সেটার অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের বাজেট সংকটের কারণে সেটি আলোর মুখ দেখেনি। আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জন করতে একটা মাল্টিমিডিয়া ল্যাব থাকা দরকার। একই সাথে একটা নিউজ পেপার এবং একটি নিউজ পোর্টাল প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
সিনিয়র সাংবাদিক এবং এটিএন নিউজ এর প্রধান নির্বাহী মুন্নি সাহা বলেন, ” প্রতিটি পেশার কিছু কনজিউমার থাকে। কৃষকের কনজিউমার এর লিমিট আছে। কিন্তু সাংবাদিকতার কনজিউমার এর কোন লিমিট নাই। এদেশের এখন ১৭ কোটি মানুষ মোবাইল ব্যবহার করে। ১২ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ইউজার ।তাই মানুষের চাহিদা অনুযায়ী নিউজের হেডলাইন করতে হবে”। সিনিয়র সাংবাদিক স্বদেশ রায় বলেছেন,”গণতন্ত্র এবং মিডিয়া সমার্থক।কিন্তু আমাদের দেশে আমরা গণতান্ত্রিক চরিত্র পায় নি।যার কারণে আমাদের সাংবাদিকতার এখন দুরবস্থা।
চলচ্চিত্র পরিচালক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন , ” আমি ১৯৭১ সালে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার সময় যুদ্ধে চলে যায়। শ্রেণীর পাঠ এবং জীবন ও জগতের পাঠ একটু ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ রাজধানীর স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলো খোলা হয়েছিল। আমাদের উপর নির্দেশ আসল এগুলো বন্ধ করতে হবে। এজন্যই একটা বোমা ফেলতে হবে। কলাভবনের সামনে একটা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পর্যন্ত পালিয়ে গিয়েছিল। তিনি আফসোস করে বলেন,”আমাদের পত্রিকা গুলো ভারতের চলচ্চিত্রের খবর ছাপায়। কিন্তু আমাদের বিনোদনের সংবাদ ছাপায় না”।
কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন,আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ফকিরের মতো তাকিয়ে থাকতাম।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেও বড় মানুষ তৈরি হয়। সাহিত্যিক তৈরি হয়।বুয়েট থিওরি শিক্ষানো হয়। কিন্তু প্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষা হয় মাঠে। চারদিকে মিথ্যা তথ্যে সমাজ ভরে গেছে।সাংবাদিকতার জাগরণের এখনই সময়। সাংবাদিকতা রক্ষায় লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব পীযুস বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, ” আমি সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করেছি বলেই সমাজের অনেক কিছুই বলতে পেরেছি। আমি সাংবাদিকতা বিভাগে পড়েছি আর্থিক প্রয়োজনে। না হলে বিজ্ঞান থেকে পড়ে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন পড়তে পারতাম। সাংবাদিকতায় অনেক কুমির আছে। আমরা কুমিরদের কে ভয় করি না।আমরা কুমিরদের কে ধরার চেষ্টা করি।
ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন,আমি ৩২ বছর যাবত একটি পত্রিকায় আছি। রিপোর্টার থেকে ধারাবাহিকভাবে পদোন্নতি পেয়ে এখন সম্পাদক। তিনি সাংবাদিকদের দুরবস্থা বর্ণনা করে বলেন,গ্রামীণ ফোন,রবি, এয়ারটেলের মতো কোম্পানি গুলো এখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় না। ফলে পত্রিকা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অধিকাংশ সাংবাদিক এখন কপি পেস্ট করে নিউজ তৈরি করে।এই শহরে কমপক্ষে দুই কোটি লোক বসবাস করে।কিন্তু কয়জন নিউজ পেপার পড়ে? অধিকাংশ লোকজন এখন অনলাইনে নিউজ পড়ে।
সত্যিকার অর্থে মিডিয়া টিকে রাখা কঠিন । গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষের ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঘটনা ঘটেছে একটা, টকশো তে আমরা শুনেছি আরেকটা। নিউজের কন্টেন্ট তৈরির বিষয়ে এখন গবেষণার সময় এসেছে। সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, মুসা ভাই ছিলেন আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক। তিনি বলতেন, সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের কে পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে নিবি না। নিলেও এক বছর ঘুরাবি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মিডিয়া পন্ডিত নাই। একুশে টিভির মামলায় আমরা আদালতে গিয়েছিলাম।”টেরেস্ট্রিয়াল” শব্দের অর্থ বিচার পতি, উকিল এবং এর্টনী জেনারেল কেউ জানে না। আজ পর্যন্ত কেউ মিডিয়া আইন নিয়ে কোন উকিল পড়াশোনা করে নি। ১৯৫৪ সালের বই দিয়ে ২০২২ সালে দক্ষ সাংবাদিক তৈরি করা যাবে না। সাংবাদিকতার সিলেবাস ৬ মাস পর পর পরিবর্তন হওয়া দরকার।
সিনিয়র সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান বলেন,” জিয়াউর রহমানের মাজার সরানো এবং সাংবাদিকতা বিভাগের সিলেবাস পরিবর্তন দুইটাই কঠিন। আমি ইন্ডাষ্ট্রি এবং একাডেমিক সম্পর্ককে যত টানাটানি করেছি, বাংলাদেশে দ্বিতীয় কেউ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের মেধাবী শিক্ষক গণ এ দেশের সাংবাদিকতা বিকাশে ভালো ভূমিকা পালন করছেন। গ্লোবাল টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেছেন, টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য আমরা এমনই ছেলে -মেয়ে চাই ,যাদের সৃজনশীলতা আছে,যাদের সমস্যা সমাধানের মানসিকতা আছে। কারিকুলাম প্রণয়ন করার সময় এই বিষয় গুলো খেয়াল রাখতে হবে। মিডিয়ার চাওয়া হচ্ছে মানুষের চাহিদা মেটাতে হবে। একটা বড় ধরনের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা যাচ্ছে। সাংবাদিকতার সাথে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
কিউএনবি/আয়শা/২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২,খ্রিস্টাব্দ/সন্ধ্যা ৭:৫৫