ডেস্ক নিউজ : মানুষের জীবনে দিকনির্দেশনার জন্য আল্লাহ তাআলা কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে এমন কিছু মূলনীতি দান করেছেন, যেগুলোর ওপর আমল করলে দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য লাভ করা সম্ভব। এসব মূলনীতির আলোকে বহু আগেই আমাদের সালাফে সালেহিন (নেক পূর্বসূরিরা) একে অপরকে উপদেশ দিতেন এবং সে উপদেশগুলো যুগে যুগে পথ প্রদর্শনের আলো হয়ে মানুষের অন্তরে জাগরণ সৃষ্টি করেছে। এমনই এক মহৎ উপদেশ বর্ণনা করেছেন বিখ্যাত হাদিসবিশারদ হাফেজ ইবনে আবিদ দুনিয়া (রহ.) তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘ইখলাস’-এ।
ইবনে আবিদ দুনিয়া (রহ.) বলেন, তিনি এই উপদেশ মাকিল ইবন উবায়দুল্লাহ আল-জাজারি (রহ.)-এর সূত্রে পেয়েছেন।
তিনি বলেন, যখন আলেমরা একত্র হতেন, তখন এই তিনটি মূলনীতির দ্বারা একে অপরকে উপদেশ দিতেন। আর যদি আলাদা থাকতেন, তাহলে এই কথাগুলো চিঠির মাধ্যমে একে অপরকে পাঠাতেন। এই তিনটি মূলনীতি হলো—
এক. যে ব্যক্তি নিজের গোপন অবস্থাকে (অন্তরের আমল ও একান্ত ইবাদতকে) সংশোধন করে, আল্লাহ তাআলা তার প্রকাশ্য অবস্থা ও কাজকর্মও সংশোধন করে দেন।
দুই. যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ককে দৃঢ় রাখে (ইখলাস ও তাকওয়ার মাধ্যমে), তাকে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয় না; বরং আল্লাহ নিজেই তার জন্য মানুষের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন।
তিন. যে ব্যক্তি আখিরাত নিয়ে চিন্তিত থাকে, আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়ার চিন্তা ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত করে দেন।
এই উপদেশগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেগুলো কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। প্রতিটি মূলনীতি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো—
১. যে তার গোপন অবস্থা সংশোধন করে, আল্লাহ তার প্রকাশ্য অবস্থা সংশোধন করে দেন
মানুষ সাধারণত চায়, যেন তার সুনাম হয়, লোকেরা তার প্রশংসা করে।
এটি একটি গ্রহণযোগ্য অভিলাষ, তবে এ প্রশংসা পাওয়ার প্রকৃত পথ হচ্ছে, নিজের গোপন অবস্থা সংশোধন করা। গোপনে আল্লাহকে ভয় করা, একাকিত্বে পাপকাজ থেকে বিরত থাকা, এটাই প্রকৃত তাকওয়ার পরিচয়। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাদের রবকে গোপনে ভয় করে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৪৯)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি দয়াময়কে গোপনে ভয় করে এবং ফিরে আসে বিনীত হৃদয় নিয়ে।’
(সুরা : কাফ, আয়াত : ৩৩)
নবী (সা.) বলেন, সাত ধরনের মানুষ আছে, যাদের আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়া দেবেন, যেদিন আর কোনো ছায়া থাকবে না।
তাদের মধ্যে একজন হলো যে ব্যক্তি একাকী আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আরেকজন হলো সেই ব্যক্তি, যে এমনভাবে দান করে যে তার বাঁ হাতও জানে না কিভাবে তার ডান হাত দান করছে, অর্থাৎ একান্ত গোপনে। আরেকজন, যে কোনো নারীর দ্বারা প্ররোচিত হয়, সুযোগ থাকলেও কেবল আল্লাহকে ভয় করে পাপ থেকে বিরত থাকে। এরা সবাই গোপনে আল্লাহকে ভয় করে, এবং সেটাই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৬০)
বুজুর্গি শুধু ইবাদতের বাহ্যিক আড়ম্বরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রকৃত বুজুর্গ তিনিই, যিনি গুনাহের অন্ধকার থেকে নিজেকে সর্বদা দূরে রাখেন। কারণ আল্লাহর নৈকট্যের চূড়ান্ত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে পাপ থেকে বিরত থাকার নীরব সংগ্রামে। অনেক মানুষ বাহ্যিকভাবে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হজ করে, দান করে, এটা নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু শুধু এগুলোর মাধ্যমেই কেউ আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে যাবে, এমনটি নয়।
আল্লাহর প্রকৃত প্রিয় বান্দা সে, যে গোপনে-প্রকাশ্যে সব হারাম কাজ (যেমন—গিবত, জিনা, সুদ, অহংকার, মিথ্যা, রিয়া, শিরক, তাকাব্বুর ইত্যাদি) বর্জন করে। আর পাপ থেকে বাঁচে শুধু সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর খুব কাছের, একজন সিদ্দিক (সত্যনিষ্ঠ বান্দা)। কারণ অনেক ফাসেক-ফাজের (পাপী) মানুষকেও দেখা যায় নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, দান করে, হজ করে, কিন্তু তারা গোপনে বড় বড় গুনাহে লিপ্ত।
এ ব্যাপারে সাহল তুসতারি থেকে কত চমৎকার কথা এসেছে, তিনি বলেন, ইমাম আবু বকর আল-জাওজি (রহ.) বলেন, আমি সাহল ইবন আবদুল্লাহ (রহ.)-কে বলতে শুনেছি, সব ব্যক্তি, যারা আল্লাহর আনুগত্যের কাজ করে, তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে যায়, এমন নয়; বরং যে ব্যক্তি আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বেঁচে থাকে, সেই হয় আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আর পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারে শুধু একজন সিদ্দিক (অত্যন্ত সচ্চরিত্র, নিকটবর্তী ব্যক্তি)। আর সৎ কাজ (নেক আমল) তো ভালো ও মন্দ উভয় ব্যক্তিই করে থাকে।
(হিলয়াতুল আওলিয়া : ১০/১৯০)
২. যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখে, তাকে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করতে হয় না
যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে, আল্লাহ মানুষের হৃদয় তার প্রতি নম্র করে দেবেন।
আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, দয়াময় তাদের জন্য মানুষের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন।’ (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৯৬)
হাদিসে এসেছে, মুয়াবিয়া (রা.) একবার আয়েশা (রা.)-এর কাছে এই মর্মে চিঠি লিখেছিলেন যে পত্রের মাধ্যমে আমার কিছু নসিহত করুন, তবে পরিমাণে তা যেন খুব বেশি না হয়। বর্ণনাকারী বলেন, অনন্তর আয়েশা (রা.) মুয়াবিয়া (রা.)-এর বরাবরে লিখলেন, সালামুন আলাইকা, আম্মাবাদ। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে মানুষের অসন্তুষ্টিতেও যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করবে আল্লাহ তাআলা মানুষের অনিষ্ট থেকে তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি তালাশ করবে আল্লাহ তাআলা তাকে মানুষের হাতেই সোপর্দ করে দেবেন। ওয়াস সালামু আলাইকা। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৪)
৩. যে ব্যক্তি আখিরাত নিয়ে চিন্তিত থাকে, আল্লাহ তার দুনিয়ার চিন্তা দূর করে দেন
যে ব্যক্তি দুনিয়াকে নয়, আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়, তার হৃদয়ে আল্লাহ আত্মতৃপ্তি, স্বস্তি ও ধৈর্য দেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আখিরাত যার একমাত্র চিন্তা ও লক্ষ্য, আল্লাহ তাআলা তার হৃদয়কে অভাবমুক্ত করে দেন এবং বিক্ষিপ্ত বিষয়াবলিকে সমাধান করে দেন এবং তার কাছে দুনিয়া তুচ্ছ হয়ে আসে। পক্ষান্তরে যার চিন্তা ও লক্ষ্য হয় দুনিয়া, আল্লাহ তাআলা তার দুই চোখের সামনে অভাব তুলে ধরেন, তার সমস্যাগুলো বিক্ষিপ্ত করে দেন আর যতটুকু তার জন্য নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে এর অতিরিক্ত দুনিয়া সে পায় না। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৪৬৫)
আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিলে আল্লাহ দুনিয়াও সহজ করে দেন। কিন্তু যে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সালাত ফেলে রাখে, গুনাহে লিপ্ত হয়, সে নিজেই নিজের ক্ষতি ডেকে আনে।
তাই এই তিনটি মূলনীতি যেন প্রত্যেক ঈমানদারের জীবনের ভিত্তি হয়, এক. অন্তর ও একান্ত গোপন অবস্থার সংশোধন। দুই. আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখা। তিন. আখিরাতকে মূল চিন্তা বানানো।
যে এগুলোতে অগ্রসর হবে, আল্লাহ তার সম্মান, নিরাপত্তা ও জীবনের সহজতা নিশ্চিত করবেন, ইনশাআল্লাহ।
কিউএনবি/অনিমা/২৭ নভেম্বর ২০২৫,/সকাল ৮:১৪