ডেস্ক নিউজ : সৃষ্টির সূচনা থেকে নারী ও পুরুষ প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে পরিবার, সমাজ ও সভ্যতায় অবদান রেখে যাচ্ছে। ইসলাম নারীর এই অংশগ্রহণ, অবদান ও প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করে না, বরং পবিত্র কোরআনে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে মানবসভ্যতার বিকাশে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন নারী ও পুরুষ থেকে এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
কর্মক্ষেত্রের বৈচিত্র্য স্বীকৃত বিষয়
মানবজাতির প্রয়োজনেই আল্লাহ নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন করেছেন এবং প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত জ্ঞান, দক্ষতা ও কর্মস্পৃহা দান করেছেন।
মানুষ যখন স্বভাবজাত এসব বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে, তখনই সমাজ-সভ্যতার ভারসাম্য রক্ষা পাবে, আর এর ব্যতিক্রম হলে ভারসাম্য নষ্ট হবে। পশ্চিমা সমাজে সমতার নামে কর্মক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করায় সেখানে নারীরা বিয়ে, সংসার ও সন্তান ধারণের আগ্রহ হারাচ্ছে। ফলে পরিবারব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, বৃদ্ধ নারী-পুরুষের তুলনায় কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং শপথ তাঁর, যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন—অবশ্যই তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকৃতির।’ (সুরা : লায়ল, আয়াত : ৩-৪)
মুসলিম নারীর জীবন ঘরমুখী
মানুষের জীবনকে যদি সমান্তরাল দুটি ভাগ করা হয়, তবে দুই ভাগে ভাগ করা সম্ভব—ঘরের জীবন ও বাইরের জীবন। বস্তুত ঘরের জীবনটাই একান্ত ব্যক্তিগত ও নিজের। কেননা এখানে এসে সে জীবনের ক্লান্তি ও অবসাদ ভুলতে চায়, প্রশান্তি পেতে চায়। তাই ইসলাম ঘরের জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
আর ঘরের শৃঙ্খলা ও প্রশান্তি রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে নারীর ওপর। যুগ যুগ ধরে নারী এই দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে আসছে। বিপরীতে আল্লাহ বাইরের প্রয়োজনগুলো পূরণের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন পুরুষের ওপর। শুধু অতীত নয়, বর্তমান পৃথিবীতের কর্মজীবী নারী ও পুরুষের পরিসংখ্যান এই সাক্ষ্য দেয় যে পুরুষই বাইরের কাজে নারীর চেয়ে বেশি উপযোগী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।
(সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৩)
ঘরের শ্রম মূল্যহীন নয়
বস্তুবাদী সমাজ ও সভ্যতার বড় একটি সংকট হলো তারা সব কিছুকে অর্থ ও সম্পদ দিয়ে পরিমাপ করে। তারা নারীর কাজকেও নিছক অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করে। ফলে তাদের কাছে নারীর ঘরের কাজ মূল্যহীন, নারীকে ঘরের কাজ করতে বলা বন্দিত্ব, তাকে পিছিয়ে রাখা। ইসলাম মানুষের কাজকে মূল্যায়ন করে উদ্দেশ্য ও ফলাফলের ভিত্তিতে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর ঘরের শ্রম মূল্যহীন নয়। কেননা তার ঘরমুখী জীবন জাতিকে সুস্থ, সবল ও নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন সন্তানদের উপহার দেয়, তাদের ঘরের জীবন পুরুষের চরিত্র রক্ষায় ভূমিকা রাখে, তাদের ঘরের জীবন বৃদ্ধ নারী-পুরুষের জীবনকে স্বস্তির করে। নারীর ঘরে জীবন অত্যন্ত মূল্যবান বলেই পুরুষের ওপর তাদের ভরণ-পোষণ আবশ্যক করা হয়েছে। মূলত ভরণ-পোষণসহ নারীর সব আর্থিক দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে পুরুষ এই ঘোষণা দেয় যে নারীর ঘরের শ্রমের মূল্য আমার শ্রমের চেয়ে বেশি এবং তা আমার জন্য অপরিহার্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, আমি তার শ্রমফল নষ্ট করি না—যে উত্তমরূপে কাজ সম্পাদন করে।’
(সুরা : কাহফ, আয়াত : ৩০)
ইসলাম প্রয়োজন অস্বীকার করে না
ইসলাম নারীকে ঘরমুখী জীবন যাপন করতে বলেছে, তবে নারীর জীবনের বাস্তব প্রয়োজনগুলোও অস্বীকার করে না। প্রয়োজনে নারী ঘরের বাইরেও কাজ করতে পারবে। ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম বলেন, ‘জীবিকার জন্য বিভিন্ন কাজ-কারবার, শিল্প-কারখানা স্থাপন, পরিচালনা বা তাতে কাজ করারও অধিকার রয়েছে নারীদের। সেই সঙ্গে সমাজ ও জাতির কল্যাণমূলক বহুবিধ সামষ্টিক কাজে আঞ্জাম দেওয়াও তাদের জন্য বৈধ।…তবে পরিবার বা সমাজে এমন কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যার কারণে নারীদেরও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন যথাসাধ্য শরঈ বিধান পালন সাপেক্ষে নারীদের জন্যও কর্মসংস্থানের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে।’ (মাসিক আত-তাহরীক)
নারীর কর্মসংস্থান যেমন হবে
ফকিহ আলেমরা বলেন, নারীর কর্মসংস্থান দুই ধরনের : ক. যা নারীদের সঙ্গে বিশেষায়িত। যেমন—ধাত্রীর কাজ, নারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান, বালিকা স্কুল বা মাদরাসায় পাঠদান ইত্যাদি। এমন কাজে নারীরা শিথিল শর্তে কাজ করতে পারবে।
খ. যে কাজ নারীর সঙ্গে বিশেষায়িত নয়; যেমন—কৃষি, ব্যবসা, শিল্প-কারখানা পরিচালনা ইত্যাদি। এসব কাজ নারীরা একান্ত প্রয়োজন হলে নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে করতে পারবে। (মাসিক আত-তাহরীক)
বাইরে কাজ করার শর্ত
ওলামায়ে কিরাম বলেন, নারীদের কর্মসংস্থান হতে হবে নিরাপদ, নারীর স্বভাব ও প্রকৃতির অনুকূল এবং যেখানে শরিয়তের বিধান লঙ্ঘিত হয় না। এ ক্ষেত্রে তারা কয়েকটি শর্ত আরোপ করেন—
১. কাজটি তাঁর জরুরত বা প্রয়োজন হতে হবে এবং যার মাধ্যমে তাঁর জীবিকার ব্যবস্থা হবে।
২. কাজটি নারীর স্বভাব, চরিত্র ও প্রকৃতির অনুকূল হবে, নারীর প্রকৃতিবিরোধী কাজ হবে না। যেমন—চিকিৎসা, নার্সিং, পাঠদান, সেলাইয়ের কাজ ইত্যাদি।
৩. কর্মস্থলে নারী পর্দা রক্ষা করে চলতে পারবে। পুরুষের সঙ্গে একান্তে নির্জনে অবস্থানের প্রয়োজন হবে না।
৪. কাজের কারণে বাইরে গায়েরে মাহরামের (যার সঙ্গে বিয়ে বৈধ) সঙ্গে সফর করার প্রয়োজন হবে না।
৫. কাজটি অবৈধ হবে না এবং কাজের কারণে অবৈধ কোনো কিছু জড়াতে বাধ্য হবে না।
৬. কাজের কারণে কোনো জরুরি কাজে বিঘ্ন তৈরি না হওয়া। যেমন—নামাজ আদায় করা, স্বামী-সন্তানের প্রয়োজন পূরণ করা ইত্যাদি।
(ফাতাওয়া মারয়াতুল মুসলিমাহ : ২/৯৮১)
আধুনিক যুগে আছে অনেক বিকল্প
বর্তমান যুগে মুসলিম নারীদের সামনে এমন অনেক বিকল্প কর্মসংস্থান রয়েছে, যা নারীরা পর্দা রক্ষা করেও করতে পারে। এমন কয়েকটি বিকল্প তুলে ধরা হলো—
১. ফ্রিল্যান্সিং : নারীরা তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ হলে ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে পারে। কাজ পর্দা রক্ষা করেও করা সম্ভব।
২. অনলাইনে ব্যবসা : ফেসবুকে পেজ খুলে বা ওয়েবসাইট খুলে নারীরা অনলাইনে ব্যবসা করতে পারে।
৩. অনলাইনে পাঠ দান : অনলাইনে পাঠদান এখন একটি স্বীকৃত পেশা। মুসলিম নারীরা অনলাইনে নারীদের পাঠদান করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পর্দার যেন লঙ্ঘন না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৪. অনলাইনে কর্মশালা : অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স বিক্রি করে এবং নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেও মুসলিম নারীরা অর্থ উপার্জন করতে পারে।
৫. হস্ত ও কুটির শিল্প : বর্তমানে হস্ত ও কুটির শিল্প একটি জনপ্রিয় ব্যাবসায়িক আইডিয়া। বহু নারী হস্তশিল্প ও কুটির শিল্প পণ্য তৈরি ও বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছে। এমনকি লাখ লাখ টাকাও উপার্জন করছে। আর বর্তমানে তা অনলাইনেও বিক্রি করা যায়। অথবা তা তৈরি করে সুনির্দিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা যায়।
৬. আর্ট ও ক্যালিগ্রাফি : মুসলিম নারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যম হতে পারে আর্ট ও ক্যালিগ্রাফি। তারা চাইলে এমন শিল্পকর্ম অনলাইনেও বিক্রি করতে পারে।
৭. লেখালেখি : পত্রপত্রিকায় লিখে অথবা বই লিখে, বই অনুবাদ করেও নারীরা জীবিকা উপার্জন করতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তাদের বেপর্দা হওয়ার ভয় থাকে না।
কিউএনবি/অনিমা/০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫/সকাল ১১:৪১