রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:০৬ পূর্বাহ্ন

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাষ্ট্রনীতি

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ৫০ Time View

ডেস্ক নিউজ : ইতিহাসে এমন অনেক নেতা এসেছেন, যাঁরা রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মতো একাধারে নবী, শাসক, বিচারক, সেনাপতি ও নীতিনির্ধারক—এমন পরিপূর্ণরূপে নেতৃত্বদানকারী দ্বিতীয় কেউ নেই। তাঁর রাষ্ট্রনীতি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ওহির আলোকে পরিচালিত, যা মানবজাতির জন্য আদর্শ ও পথপ্রদর্শক।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি : তাওহিদের ওপর ভিত্তি স্থাপন

মহানবী (সা.)-এর রাষ্ট্রনীতি সর্বপ্রথম বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গঠিত।

মদিনায় হিজরতের পর তিনি যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তার মূল ভিত্তি ছিল তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না…।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)

রাসুল (সা.) রাষ্ট্রে এমন পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে মানুষের প্রথম পরিচয় ছিল ‘মুসলিম’। গৌত্র, বর্ণ, শ্রেণি ইত্যাদি পার্থক্য থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাই ছিল এক উম্মাহ।

সংবিধান : মদিনা সনদ

রাষ্ট্র গঠনের সূচনায়ই রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি লিখিত দলিল প্রণয়ন করেন, যা ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। এটি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান। এতে মুসলমান, ইহুদি ও অন্য গোত্রগুলোর পারস্পরিক অধিকার, দায়িত্ব ও সহাবস্থানের নীতিমালা বর্ণিত হয়।

এই সনদের অন্যতম নীতিমালা ছিল—‘সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, সব নাগরিক রাষ্ট্র রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ, অন্যায় ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করবে।’ এটি ছিল বহুধর্মীয় সমাজে সহাবস্থানের অনন্য দৃষ্টান্ত।

ন্যায়বিচার ও শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাষ্ট্রে বিচারপ্রক্রিয়া ছিল নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন। কেউ ধনী বা প্রভাবশালী হওয়ায় তাকে ছাড় দেওয়া হতো না। একবার কুরাইশ গোত্রের এক প্রভাবশালী নারী চুরি করলে অনেকে সুপারিশ করতে চায়, কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়েছে এ জন্য যে তারা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষমা করত আর দুর্বলদের শাস্তি দিত। আল্লাহর কসম! আমার মেয়েও যদি চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৮)

এ থেকে বোঝা যায়, নবী (সা.)-এর রাষ্টনীতি ছিল কঠোর ন্যায়বিচারভিত্তিক, যেখানে প্রভাব ও আত্মীয়তার প্রভাব পড়ত না।

পারস্পরিক পরামর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনায় শুরা অর্থাৎ পরামর্শমূলক পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো এবং যখন তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)

বদর যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ, খন্দক যুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। এটি ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তিপ্রস্তর।

অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি

ইসলামী রাষ্ট্রে অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সুদের প্রচলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন—‘আল্লাহ সুদকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং ব্যবসাকে হালাল করেছেন…।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৭৫)

তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের মাধ্যমে গরিবদের জন্য জাকাত ও সদকার ব্যবস্থা করেন। চোরদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেন।

নৈতিকতা ও শিক্ষা : রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্র পরিপূর্ণ করার জন্য।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৯৫২)

তাঁর রাষ্ট্রে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বদরের বন্দিদের মধ্যে যারা পড়তে পারত, তাদের বিনিময়ে মুসলমান শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব দিলে মুক্তি দেওয়া হতো।

সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সহাবস্থান

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাষ্ট্রনীতি ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষায় অগ্রণী। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্ম পালনে কোনো বাধা দেওয়া হতো না। তিনি ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম সংখ্যালঘুর ওপর জুলুম করে, তার অধিকার হরণ করে—আমি কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে মামলা করব।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩০৫২)

যুদ্ধনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধের সময় শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও গাছপালার ক্ষতি করতে নিষেধ করতেন। একাধিক হাদিসে তাঁর এই নীতি পাওয়া যায়। যেমন—‘তোমরা কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ বা গাছ কেটে দেবে না…।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬১৪)

এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক ও শাসকদের কাছে চিঠি লিখে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন, যা তাঁর পররাষ্ট্র কার্যক্রমের প্রমাণ।

নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল। কোরআনের মাধ্যমে নারীর উত্তরাধিকার, মতামতের অধিকার ও সম্মান রক্ষা নিশ্চিত করা হয়। ইরশাদ হয়েছে— ‘পুরুষদের যেমন উপার্জন, তেমনি নারীদেরও উপার্জনের অধিকার আছে।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৩২)

সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ

মুসলমানদের মধ্যে একতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা ঈমান আনবে না যতক্ষণ না একে অপরকে ভালোবাসবে…।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৪)

এটি ছিল সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সহমর্মিতার ভিত্তি।

চিরস্থায়ী অনুকরণীয় মডেল

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাষ্ট্রনীতি শুধু একটি যুগের জন্য নয়, বরং চিরস্থায়ী মানবসভ্যতার জন্য অনুকরণীয় মডেল। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মদিনার রাষ্ট্র ছিল ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, শিক্ষা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও পরামর্শের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত এই রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে আজকের জটিল রাজনৈতিক জগতের জন্য অনেক দিকনির্দেশনা রয়েছে।

আসুন, আমরা প্রিয় নবীর রাষ্ট্রনীতিকে আত্মস্থ করি; আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্টীয় জীবনে এর অনুশীলন করি, যেন আমরা প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যেতে পারি। আল্লাহ আমাদের ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর

কিউএনবি/অনিমা/০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫/রাত ৯:৪৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit