আন্তর্জাতিক ডেস্ক : শুরুটা হয়েছে গত বছরের জুলাই মাসে। ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে থাকে সেই আন্দোলন। প্রথম দিকের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনই পরবর্তীতে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। তবে আন্দোলন শুরুর মুখে সীমান্ত পেরিয়ে সেই আঁচ অনুভূত হয়নি পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু মোড় ঘুরে যায় জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে। গত বছরের ১৬ জুলাই দুপুরের দিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। যে ছবি রীতিমত নাড়িয়ে দেয় কলকাতার শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বিদ্ধজন ও ছাত্রসমাজকে।
আর তখনই একটু একটু করে গোটা বিশ্বের নজর কাড়তে থাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। পশ্চিমবঙ্গও তার অন্যথা হয়নি। কোটাবিরোধী আন্দোলনরত পড়ুয়াদের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে একের পর এক সংগঠনের মিছিল শুরু হয় কলকাতা শহরে। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন বড় কোন পরিবর্তন ঘটতে চলেছে পদ্মা পাড়ের এই দেশটিতে। পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারতের গণমাধ্যমগুলির হেডলাইনে ধীরে ধীরে জায়গা নেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ।
এরপর আসে সেই ৫ আগস্ট! দুপুরে হঠাৎই অবসান হয় স্বৈরাচারী শাসনের। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। হাসিনার বিমান ঢাকার আকাশ ছাড়তে গুঞ্জন ওঠে তিনি কোথায় যাচ্ছেন ভারত? নাকি ইউরোপের কোন শহরে? অবশেষে সন্ধ্যায় তার বিমান নামে দিল্লি লাগোয়া গাজিয়াবাদের হিন্ডন এয়ার বেসে। কার্যত সেই থেকে দিল্লির অজ্ঞাতস্থানে অবস্থান করছেন হাসিনা। দল নেত্রীর পরপরই সে সময় হাসিনার ঘনিষ্ঠ অনেক নেতা ও দোসর দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
বিভিন্ন সূত্রে খবর তাদের বেশিরভাগই প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান করছেন, কেউ কেউ রয়েছেন দিল্লিতে। যদিও এখনো পর্যন্ত পলায়ন সেইসব নেতাদের কলকাতা বা দিল্লিতে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। মাঝে অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদেরের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। অন্যদিকে কলকাতার নিকো পার্কে সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং নেত্রকোণা-৩ আসনের সাবেক সাংসদ অসীম উকিলকেও ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে দেখা গিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কলকাতায় অবস্থান নিয়ে কলকাতাবাসীর একাংশের মধ্যে কৌতূহলের সীমা নেই, বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে। সম্প্রতি কলকাতা ভিত্তিক দুইটি গণমাধ্যমে ওবায়দুল কাদেরের সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হয়। এরমধ্যে একটি ছিল কাদেরের অডিও বার্তা, অন্যটি ছিল প্রতিবেদন। তবে ওই সাক্ষাৎকার কলকাতায় বসে দেওয়া নাকি অন্য কোথাও তা জানা যায়নি।
কলকাতার গণমাধ্যমের কর্মীদেরই একাংশ বা বিভিন্ন সূত্র বলছেন হাসিনার দলের নেতাদের কেউ আছেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত-মধ্যমগ্রামে, কেউ আছেন রাজারহাট বা নিউটাউন, কেউ বা আছেন বর্ধমানে। অনেকেই আবার বলছেন তারা আদৌ কলকাতাতে নেই।
এদের মধ্যে অন্যতম আওয়ামী লীগের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ ও সাবেক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তার অবস্থান রাজারহাট-নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন, এই অভিজাত আবাসনেই নাকি রয়েছেন ঢাকা-১৩ আসনের সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং ঢাকা-১১ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান খান কামাল। কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকায় অবস্থান করছেন টাঙ্গাইল-২ কেন্দ্রের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান (ছোট মনির) ও ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। কলকাতার উপকণ্ঠে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাতে রয়েছেন নেত্রকোনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট এলাকায় রয়েছেন ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দীন নাছিম। পার্ক সার্কাস এলাকায় অবস্থান করছেন চাদপুর-২ কেন্দ্রের সাংসদ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। দক্ষিণ কলকাতা যাদবপুর এলাকায় আত্মগোপন করে আছেন ঢাকা-১০ সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদ। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নবাবহাটে রাজশাহী-৬ আসনের সাংসদ শাহরিয়ার আলমের মত নেতারা।
কিন্তু ওই সব ঠিকানায় খোঁজ নিয়েও তাদের কোন সন্ধান মেলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই সরকার পরিবর্তনের এক বছরের মাথায় বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতারা কে কোথায় আত্মগোপন করে আছেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। ভারতে তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কলকাতার একাংশ।
অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মুখেও উঠে আসে হাসিনা সহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারতে অবস্থানের প্রসঙ্গটি।
গত ১৭ এপ্রিল কলকাতা নিউ টাউনে একটি অনুষ্ঠান থেকে শেখ হাসিনার নাম না করেই মমতা বলেন, ‘১৯৭১ সালে সবকিছু হারিয়ে বহু উদ্বাস্তু ভারতে এসেছিলেন। কিন্তু এখন আসতে পারে না। তবে এখন আসতে না পারলেও ভারত সরকার আমাদের কয়েকজন অতিথিকে এখানে রেখে দিয়েছে। আমি কি না বলেছি? তার কারণ এর পিছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। ভারত সরকারের অন্য কারণও থাকতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ বিপদে পড়েছে। কই আমরা তো কখনো এটা নিয়ে কথা বলি না।’
মমতা বা রিজভীর মতো কলকাতার অনেক সাধারণ মানুষও হাসিনাসহ বাংলাদেশিদের ভারতে অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের অভিমত, সত্যিই যদি কলকাতায় বা ভারতে আওয়ামী লীগের নেতারা অবস্থান করেন তবে তাদের সেদেশে পুশ ইন করা উচিত।
দমদমের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষিকা প্রতীতি মিত্র জানান, ‘বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে যেখানে বাংলা কথা বলার জন্য বাংলাভাষী দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঠিক সেখানেই বাংলাদেশীদের প্রশ্রয় দিয়ে তাদের এদেশে রাখা হচ্ছে। আমাদের রুপিতে তাদের খাওয়া পড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটা এক প্রকার দ্বিচারিতা। আমরা এটার তীব্র বিরোধিতা করছি।’
ব্যবসায়ী সৌমেন পন্ডা জানান, ‘ভারতীয় বাঙালিদের বাংলাদেশ পুশ ইন করা হচ্ছে। অথচ সেই কেন্দ্রীয় সরকারই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতা মন্ত্রীদের জামাই আদর করে দিল্লিতে নিয়ে এসে পুষছে। আমাদের করের টাকায় তাকে খাওয়ানো পড়ানো হচ্ছে। তাদেরও বাংলাদেশে পুশব্যাক করা উচিত।’
অভিজিৎ দে নামে এক ব্যবসায়ী জানান ‘শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের নেতাদের যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ এবং দিল্লীতে জামাই আদর করে রেখে দেওয়া হয়েছে। তার প্রশ্ন, যেখানে বাংলা ভাষী মানুষদের বাংলাদেশী কিংবা রোহিঙ্গা বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার কেন দিল্লিতে হাসিনার মতো নেতাদের আশ্রয় দিয়েছে? কেন রাজারহাট নিউটাউনের মত হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে থাকা সেসব নেতাদের খোঁজে বের করে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হচ্ছে না?’
কিউএনবি/অনিমা/৪ আগস্ট ২০২৫/রাত ৮:৫৬