আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসরাইল ও ইরানের মধ্যকার সংঘাত ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। এমন সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কূটনৈতিক সমাধানকে সমর্থন করে কিনা, সে বিষয়ে বিভ্রান্তিকর বার্তা দিচ্ছে।
কিন্তু এর ঠিক ১৪ ঘণ্টা পর… কী ঘটলো? যুদ্ধবাজ ইসরাইল ইরানে বোমাবর্ষণ শুরু করল। আর ট্রাম্প তখন ঘোষণা দিলেন যে, তিনি ইরানকে ৬০ দিনের সময়সীমা দিয়েছিলেন, যা ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। ট্রাম্প এর দুদিন পর (১৫ জুন) বললেন, ‘ইসরাইল ও ইরানকে একটি সমঝোতায় আসতে হবে— এবং আমার সহায়তাতেই সেটি সম্ভব’।
কানাডা থেকে ফেরার কারণ
এর একদিন পর (১৬ জুন) কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলন থেকে আগেভাগেই বিদায় নেওয়ার সময় ট্রাম্পের বার্তা আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। তিনি তখন লেখেন, ‘ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র পাওয়া থেকে রুখতে হবে। সবাই অবিলম্বে তেহরান ছাড়ো’!
পরে অবশ্য তিনি দাবি করেন, তার দ্রুত ওয়াশিংটন ফেরাটা ‘যুদ্ধবিরতি’ নিয়ে আলোচনার জন্য নয়, বরং ‘এর চেয়েও বড় কিছু’।
ট্রাম্পের অস্পষ্টতা, দ্বিধান্বিত বিশ্লেষকরা
ট্রাম্প অবশ্য সরাসরি অস্বীকার করে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলায় জড়িত নয়’। ট্রাম্প গত শুক্রবার বলেন, ‘আজ রাতে ইরানে হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই’।
এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের পরমাণু নীতি বিষয়ক পরিচালক কেলসি ড্যাভেনপোর্ট বলেন, ‘ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি সামরিক হস্তক্ষেপে সমর্থন দেন না। এমনকি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর শত চাপেও তিনি রাজি হননি’।
ড্যাভেনপোর্টের মতে, ‘সম্ভবত ইসরাইল ভয় পাচ্ছিল যে, কূটনৈতিক উদ্যোগ সফল হলে তা ইসরাইলের লক্ষ্য ও স্বার্থের সঙ্গে মিলবে না’।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের ইরানবিষয়ক পরিচালক রিচার্ড নেফিউ বলেন, ‘ট্রাম্পের ধারাবাহিকভাবে চুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়াই মূলত ইসরাইলের উদ্বেগের কারণ’।
তবে স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি ইতিহাসবিদ আলি আনসারির মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্র জানত ইসরাইল হামলা চালাবে… হয়তো সময়টা কিছুটা বিস্ময়ের ছিল। তবে ‘চোখের ইশারা’ যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল’।
তার ভাষায়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হলো— হামলায় ইসরাইলকে নেতৃত্ব দিতে হবে এবং এটা তারা নিজেরাই করুক, এমনই চাওয়া ছিল ওয়াশিংটনের’।
যুক্তরাষ্ট্র কি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়াবে?
হামলা চালিয়ে ইসরাইল ইরানের নাতানজে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর উপরের অংশ ধ্বংস করেছে। যেখানে ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হতো। এ মাত্রা বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে বহুগুণ বেশি, তবে পারমাণবিক বোমার জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ মাত্রার নিচে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, এ হামলায় ভূগর্ভস্থ অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে ফোরদো স্থাপনাটি অক্ষত রয়েছে। এই স্থাপনাটি একটি পর্বতের নিচে অবস্থিত এবং সেখানেও ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়।
এ বিষয়ে ড্যাভেনপোর্ট বলেন, ‘ফোরদোর মতো গভীর বাঙ্কার ধ্বংস করতে চাইলে ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা প্রয়োজন হবে। বিশেষ করে ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বোমাটিই পারে ওই বাঙ্কার ধ্বংস করতে’।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত এই বোমা ইসরাইলকে দেয়নি।
স্টিমসন সেন্টারের ফেলো বারবারা স্ল্যাভিনও একই মত পোষণ করেন। তার মতে, ‘ইরানের সম্পূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে চাইলে ইসরাইলকে মার্কিন অস্ত্র ও সহায়তা দরকার’।
অন্যদিকে নেফিউ একধাপ এগিয়ে গিয়ে মনে করেন, ট্রাম্প এখন ‘বিজয়ীর পক্ষে থাকার’ স্বভাবগত প্রবণতা থেকেই ইসরাইলকে সমর্থন করতে পারেন। তার ভাষায়, ‘ট্রাম্প যেহেতু মনে করছেন ইসরাইল জিতে যাচ্ছে, তাই হয়তো ‘চোখের ইশারা’ দিয়ে সমর্থন দিচ্ছেন’।
মার্কিন সেনা পাঠানোর ইঙ্গিত
এদিকে ইসরাইলি হামলার পরেই (শুক্রবার) যুক্তরাষ্ট্র একাধিক মাঝআকাশ রিফুয়েলিং বিমান মধ্যপ্রাচ্যে পাঠায়। একই সঙ্গে মার্কিন যুদ্ধ বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস নিমিৎজ’ও ওই অঞ্চলে পৌঁছায়। মঙ্গলবার আরও যুদ্ধবিমান পাঠানোর ঘোষণা আসে ওয়াশিংটন থেকে।
এ বিষয়ে ইরানি ইতিহাসবিদ আলি আনসারি বলেন, ‘হতে পারে ট্রাম্প চলমান যুদ্ধে কিছু কৃতিত্ব নিতে যুক্তরাষ্ট্রকেও এতে জড়াতে চান। তবে তেমনটা ঘটলে তা ইরানকে পিছু হটতে বাধ্য করতে পারে’।
তার ভাষায়, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে সম্মান দিয়ে ইরান যুদ্ধ থেকে সরে এসে কূটনীতিতে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু ইসরাইলকে সামনে রেখে তা করা তাদের জন্য অসম্ভব। যদিও শেষমেশ ইরান তা মানতে বাধ্য হতে পারে’।
যুদ্ধ ঠেকাতে চায় কংগ্রেস
এদিকে মার্কিন সিনেটর টিম কেইন সোমবার (১৬ জুন) একটি ‘ওয়ার পাওয়ার রেজল্যুশন’ পেশ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে— ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে তা কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়’।
কেইনের ভাষায়, ‘মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের সঙ্গে অনাবশ্যক যুদ্ধ এড়ানো জরুরি’।
কূটনীতি নাকি সামরিক সমাধান?
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিশ্বাস করতেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জন্য সামরিক সমাধান কার্যকর নয়। তাই তিনি ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে (JCPOA) পৌঁছান। যার আওতায় আইএইএ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি তদারক করতো।
তবে রিচার্ড নেফিউ ও ড্যাভেনপোর্টের মতে, ২০১৮ সালে ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন— যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে।
এরপর ইরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৪.৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ এবং পরে ৬০ শতাংশে উন্নীত করে। আইএইএ ২০২৩ সালে জানায়, ফোরদোতে ৮৩.৭ শতাংশ মাত্রার ইউরেনিয়ামের কণা পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে রিচার্ড নেফিউ বলেন, ‘এই চুক্তিকে পুড়িয়ে দেওয়ার পরিণতি আমাদের এখন ভুগতে হচ্ছে। যখন সামরিক পদক্ষেপকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তখন অন্য দেশগুলো ভাবে, ‘আমার একমাত্র নিরাপত্তার পথ হচ্ছে নিজেই পারমাণবিক অস্ত্র বানানো’।
ড্যাভেনপোর্ট বলেন, ‘নেতানিয়াহুর দাবি অনুযায়ী তেহরানে যদি সরকার পরিবর্তন হয়, তবুও তাদের পরমাণু কর্মসূচি থেমে যাবে- এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই’।
‘কারণ ইরানের নতুন সরকার যদি সামরিক, এমনকি গণতান্ত্রিকও হয় — গণতন্ত্রগুলোও পারমাণবিক অস্ত্রের পথ বেছে নিতে পারে’, যোগ করেন মার্কিন এই পরমাণু বিশেষজ্ঞ।
(আল-জাজিরার প্রতিবেদন অবলম্বনে)
কিউএনবি/আয়শা/১৮ জুন ২০২৫, /বিকাল ৫:৪৪