বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৫৭ অপরাহ্ন

অমুসলিমদের সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৫২ Time View

ডেস্ক নিউজ : ইসলাম উত্তম চরিত্র ও উদারতার শিক্ষা দেয়। ইসলামী শরিয়া প্রতিবেশীর প্রতি উত্তম আচরণের নির্দেশ দেয়—শুধু মুসলিম প্রতিবেশীর জন্য নয়, বরং অমুসলিম প্রতিবেশীর প্রতিও এই বিধান প্রযোজ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ (সহিহ বুখারি, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-২২৪০, হাদিস : ৬০১৮)

প্রতিবেশীদের অধিকারের ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান ব্যাপক, তাতে মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। যেমন মুসলিম প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া নিষিদ্ধ এবং তাকে সুখে-দুঃখে সহায়তা করা উচিত, তেমনি অমুসলিম প্রতিবেশীর প্রতিও এই আচরণ প্রযোজ্য।

একবার আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) একটি ছাগল জবাই করেছিলেন। তিনি তার দাসকে নির্দেশ দিলেন যেন প্রথমে প্রতিবেশীকে মাংস দিয়ে আসা হয়। তখন একজন বলল, তিনি তো ইহুদি! ইবনে উমর (রা.) জবাবে বলেন, ইহুদি হলেই বা কী? জিবরাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর অধিকারের বিষয়ে এত বেশি অসিয়ত করতে থাকেন।

এমনকি আমার ধারণা হয় যে শিগগিরই তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারিশ (উত্তরাধিকারী) করে দেবেন। (সহিহ বুখারি, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-২২৩৯, হাদিস : ৬০১৫) আল্লামা কুরতুবি (রহ.) তার তাফসিরে লিখেছেন : ‘প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ এমন একটি কাজ, যা মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের জন্য প্রযোজ্য।’ (আল-জামে লি আহকামিল কোরআন, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪৮১)

অমুসলিমদের সঙ্গে উপহার ও হাদিয়া বিনিময়

সামাজিক জীবনে উপহার ও হাদিয়া আদান-প্রদানের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এর মাধ্যমে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়, পারস্পরিক দূরত্ব কমে যায় এবং মনের কষ্ট ও মালিন্য দূর হয়। এই বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : তোমরা উপহার আদান-প্রদান করো, এতে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৫৯৪) এই নির্দেশনা সর্বজনীন, যা থেকে অমুসলিমরাও বাদ যায় না; বরং তাদের সঙ্গেও উপহার বিনিময় করা উচিত। হাদিসে অমুসলিমদের উপহার দেওয়া এবং তাদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করার বহু উদাহরণ পাওয়া যায়।

আলী (রা.) বলেন, কিসরা (পারস্য সম্রাট) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে একটি উপহার পাঠিয়েছিলেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। আর বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহরা তার জন্য উপহার পাঠালে তিনি তা গ্রহণ করেছেন। (জামে আত-তিরমিজি, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-২৪৬, হাদিস : ১৫৭৬)
অমুসলিমদের দাওয়াত গ্রহণ করা

সমাজে শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনযাপনের জন্য অতিথি আপ্যায়ন এবং নিমন্ত্রণ গ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন মুসলিম যখন অন্য মুসলিমকে নিমন্ত্রণ করেন, তা গ্রহণ করা ওয়াজিব এবং কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তা প্রত্যাখ্যান করা ইসলাম নিষেধ করেছে। একইভাবে, অমুসলিমদের ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাদের বাড়িতে যাওয়া বা তাদেরকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো বৈধ। একইভাবে তাদের নিমন্ত্রণে অংশ গ্রহণ করাও বৈধ। তবে শর্ত হলো, সেই নিমন্ত্রণ কোনো ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কিত না হওয়া চাই এবং সেই অনুষ্ঠানে হারাম জিনিস (যেমন—মদ, শূকর বা হারাম পদ্ধতিতে জবাই করা খাবার) থাকা যাবে না। বিশেষত, অমুসলিমদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব (দিলের গভীরে ভালোবাসা বা তাদের প্রতি ঝোঁক) রাখা ইসলামে অনুমোদিত নয়। (ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৪৭)

হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ (সা.) অমুসলিমদের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে একবার এক ইহুদি মহিলা যবের রুটি ও দুর্গন্ধযুক্ত চর্বির ভোজে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন। (মুসনাদে আহমদ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১১২, হাদিস : ১৩২০১)

অমুসলিমদের সেবা-শুশ্রূষা করা

কেউ অসুস্থ হলে সে রোগীর খবর নেওয়া ও স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া ইসলামে নির্দেশ করা হয়েছে। এতে সহানুভূতির প্রকাশ ঘটে এবং সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। এর বিশেষ ফজিলতও বর্ণিত হয়েছে। শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিম রোগীদেরও দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে একই নিয়ম প্রযোজ্য। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, এক ইহুদি ছেলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেবা করত। সে এক দিন অসুস্থ হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার খোঁজ নিতে যান। একইভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বনি নাজ্জারের এক অমুসলিম অসুস্থ ব্যক্তিকেও দেখতে যান। (মুসনাদে আহমদ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৫২)

ওপরোক্ত ঘটনার আলোকে আল্লামা আল মারগিনানি (রহ.) লিখেছেন : ইহুদি ও খ্রিস্টান রোগীদের দেখতে যাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই, কেননা এটি একটি ভালো কাজ ও উত্তম আচরণ, যা নিষিদ্ধ নয়। (আল-হিদায়া শারহে বিদায়াতুল মুবতাদি, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৭৪)

অমুসলিমদের আর্থিক সহায়তা

অভাবী ও দরিদ্রদের সাহায্য করা এবং তাদের প্রয়োজন মেটানো ইসলামে মহৎ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে আকিদা বা ধর্মের পার্থক্য করা হয়নি। সাহায্যের জন্য কেউ মুসলিম বা অমুসলিম, মুশরিক বা আহলে কিতাব, আত্মীয় বা অনাত্মীয়—সবাই সমান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : সব ধর্মের অনুসারীদের দান-খয়রাত করো। (মুসান্নাফে আবি শাইবা, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৯৫, হাদিস : ১০৪৯৯)

অমুসলিমদের জন্য মঙ্গল কামনা

অন্যের জন্য মঙ্গল কামনা করা উদারতা ও মানসিক উৎকর্ষের প্রতীক। এতে সহমর্মিতা ও কল্যাণকামিতার প্রকাশ ঘটে। ইসলাম এ শিক্ষাই দেয় যে একজন মুসলমান কেবল নিজের নয়, বরং অন্যের মঙ্গল ও সাফল্য কামনা করবে, আর তা কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, অমুসলিমদের জন্যও প্রযোজ্য। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) একজন ইহুদির কাছে পান করার জন্য কিছু চাইলেন। ইহুদি তা এনে দিলে তিনি তার জন্য দোয়া করলেন : আল্লাহ তোমাকে সুদর্শন ও আকর্ষণীয় রাখুন। ফলে তার চুল আজীবন কালো ও ঝরঝরে থাকল। (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৯২)

অমুসলিমদের প্রতি ন্যায়বিচার

ন্যায়বিচার ইসলামের অন্যতম মৌলিক নীতি। ইসলামের সৌন্দর্য এই যে শত্রুতা ও মতপার্থক্যের মধ্যেও একজন মুসলমান ন্যায়পরায়ণতা পরিহার করতে পারে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন : ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনো ন্যায়বিচার পরিত্যাগ কোরো না। সুবিচার করো—এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।’ (সুরা : আল মায়িদা, আয়াত : ৮)

ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করা মানেই জুলুম করা, আর জুলুম আল্লাহর কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি তা যদি একটি নিরীহ পশুর প্রতিও হয়। নবী করিম (সা.) এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন যে মজলুমের অভিশাপ থেকে বাঁচো, কেননা তার মধ্যে মুসলমান ও অমুসলিম উভয়েই অন্তর্ভুক্ত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৪৮)

অমুসলিমদের জানাজার প্রতি সম্মান

অমুসলিমদের আনন্দ ও দুঃখের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা ইসলামে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বৈধ। জানাজা এমন একটি বিষয়, যা মানুষের চিন্তা-চেতনাকে আখিরাতের দিকে নিয়ে যায় এবং অন্তরকে জাগ্রত করে। তাই যখনই কোনো জানাজা সামনে দিয়ে যায়, মানুষকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো উচিত। এটি যদি অমুসলিমের জানাজাও হয়, তাহলেও একই নির্দেশ প্রযোজ্য। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে দিয়ে একজন ইহুদির জানাজা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। এ বিষয়ে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন : হে আল্লাহর রাসুল! এটি তো এক ইহুদির জানাজা। তিনি উত্তরে বলেন : সে কি মানুষ নয়? (সহিহ বুখারি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৪১; হাদিস : ১৩১২)

এর হাদিস দ্বারা বোঝা যায় যে ইসলাম মানবিকতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। মানুষের জীবনের মূল্য ধর্ম, বর্ণ বা জাতিতে বিভক্ত নয়। সব মানুষ মানবতার দিক থেকে একই মর্যাদার অধিকারী।

তাই একজন মুসলমানের উচিত ইসলামের এই শিক্ষাগুলো তার জীবনযাপনের অংশ করা এবং অমুসলিমদের প্রতি সদয় আচরণ করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার ও মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

কিউএনবি/অনিমা/২৪ ডিসেম্বর ২০২৪,/বিকাল ৪:২৭

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit