সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৮ অপরাহ্ন

নবীযুগে নারী চিকিৎসকদের কার্যক্রম

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ৬৩ Time View

ডেস্ক নিউজ : প্রাচীনকাল থেকেই নারীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে এবং এই ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক সেবা ও অবদান অনস্বীকার্য। সে জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিজ্ঞ ইতিহাসবিদরা নারীদের অবিস্মরণীয় বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছেন। তেমনি নববী যুগে চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের অবদান সম্পর্কে নিম্নে তুলে ধরা হলো—
 
যুদ্ধের ময়দানে নারীদের চিকিৎসাসেবা

নারী সাহাবায়ে কিরাম যুদ্ধে অংশ নিতে পারতেন না, তবে জিহাদের চেতনায় উজ্জীবিত এসব নারী সাহাবি পিছিয়ে ছিলেন না, বরং পুরুষ সাহাবায়ে কিরামদের পাশে ছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে নারী সাহাবায়ে কিরামের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত কাজ ছিল আহতদের চিকিৎসা করা এবং মুজাহিদদের আরাম ও বিলাসদ্রব্য সরবরাহ করা।

নারী সাহাবায়ে কিরামদের মধ্যে চিকিৎসক হিসেবে সাইয়েদা উম্মে আতিয়া, সাইয়েদা আয়েশা, সাইয়েদা উম্মে সালিম, সাইয়েদা রুবাইয়ি বিনতে মুআববিজ (রা.)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। সাইয়েদা রুবাইয়ি বিনতে মুআববিজ (রা.) বলেন, আমরা (যুদ্ধের ময়দানে) নবী (সা.)-এর সঙ্গে থেকে লোকদের পানি পান করাতাম, আহতদের পরিচর্যা করতাম এবং নিহতদের মদিনায় পাঠাতাম।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৮২)

নববী যুগে নারী চিকিৎসক

নবীজি (সা.)-এর যুগে আরব দেশে চিকিৎসাবিদ্যা শাস্ত্রীয় কোনো বিদ্যা ছিল না। অন্য জাতির সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ ন্যূনতম ছিল, তাই আরবরা সাধারণত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শাস্ত্রীয় অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত ছিল।

এ যুগে চিকিৎসা ক্ষেত্রে দুটি কেন্দ্রের অনেক খ্যাতি ছিল। একটি ইরানের জুন্দি শাপুরে এবং অন্যটি মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত। উভয় স্থানে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যার তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক উভয় দিকই নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া হতো।
নবীজি (সা.)-এর যুগে হারিস বিন কালাদাহ নামের এক চিকিৎসকের কথা উল্লেখ রয়েছে, যিনি জুন্দি শাপুর (ইরান) মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছেন।

তিনি তায়েফে থাকতেন এবং সাকিফ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আধুনিক পরিভাষায় তিনি ছিলেন একজন ‘গ্র্যাজুয়েট’ চিকিৎসক। এ কারণে তাঁর সুখ্যাতি দূর-দূরান্তে প্রসিদ্ধ ছিল। সুনানে আবি দাউদের একটি বর্ণনা অনুযায়ী সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে দেখতে গেলেন এবং বলেন, ‘তুমি হৃদরোগী, তুমি সাকিফ গোত্রের হারিস ইবনু কালাদাহর কাছে যাও; কারণ সে এসব রোগের চিকিৎসা করে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৮৭৫)
নববী যুগে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানেও নারীদের বিশেষ ভূমিকা ও অবদান রয়েছে।

অতএব, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ বিভিন্ন শাখায় নারীদের অনেকের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে নারী সাহাবি রুফাইদাহ আসলামিয়া (রা.) ছিলেন মেডিসিন ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ। তিনি আহতদের চিকিৎসা ও ব্যান্ডেজ করার জন্য যুদ্ধে অংশ নিতেন। তিনি অনেক নারীকে এই চিকিৎসাবিদ্যা শিখিয়েছিলেন এবং তাঁর চিকিৎসালয় খুবই বিখ্যাত ছিল। খন্দকের যুদ্ধে সাদ বিন মুআজ (রা.) আহত হলে তিনি নবীজি (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর বিশেষ চিকিৎসা করেন এবং তাঁর চিকিৎসার সুবিধার জন্য মসজিদে নববীতে রুফাইদাহ আসলামিয়া (রা.)-এর চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১২৬২)
নববী যুগে আরব ভূখণ্ডের চিকিৎসাকে আমরা গোত্রীয় চিকিৎসা বলতে পারি। অন্যান্য উপজাতির সঙ্গে অভিজ্ঞতা এবং মিথস্ক্রিয়া দ্বারা তারা কিছু রোগের চিকিৎসার পদ্ধতি এবং কিছু ওষুধের গুণাগুণ শিখেছিল। সুতরাং নববী যুগে নারীদের চিকিৎসা প্রদান তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন—
 
যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহতদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা

জাহেলিয়াতের যুগে যুদ্ধ সাধারণত তরবারি ও বর্শা ইত্যাদি দিয়ে সংঘটিত হতো। সে সময় সৈন্যদের যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করতে এবং বীরত্ব ও পুরুষত্বের সারমর্ম দেখানোর জন্য নারীদের ব্যবহার করা হতো। প্রেমের কবিতা গাইতে ও আবৃত্তি করতে করতে তারা সৈন্যদের অনুসরণ করত। তবে মুসলিম সেনাবাহিনীতে নারীদের এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো না, বরং তৃষ্ণার্ত সৈন্যদের পানি করানো, আহতদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং চিকিৎসা, ব্যান্ডেজ ইত্যাদির জন্য তাদের ব্যবহার করা হতো। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার কাজে বিশেষ পারদর্শী অনেক নারীর নাম ও জীবনী সিরাত ও ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। আর নারীরা এসব কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতেন।

রুবাইয়ি বিনতে মুআববিজ (রা.) বলেন, ‘আমরা নবী (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধে শরিক হয়ে লোকদের পানি পান করাতাম, তাদের পরিচর্যা করতাম এবং আহত ও নিহত লোকদের মদিনায় ফেরত পাঠাতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ২৮৮৩)

ইতিহাসবেত্তারা উম্মে আতিয়্যা আল আনসারিয়্যাহ (রা.) সম্পর্কে লিখেছেন যে তিনি জাহিলি যুগে এবং ইসলামী যুগে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের একজন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ছিলেন। (তারিখুত তিব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩১০)

উম্মে আতিয়্যা আল আনসারিয়্যাহ (রা.) নিজে বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। আমি তাঁদের শিবিরের পশ্চাতে অবস্থান করতাম, তাঁদের খাবার তৈরি করতাম, আহতদের চিকিৎসা করতাম, এবং রোগীদের সেবা-শুশ্রূষা করতাম। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৫৮৪)

এ ছাড়া বিভিন্ন যুদ্ধের ব্যাপারে কিছু নারীর নামও উল্লেখ করা হয়েছে যে তাঁরা সেসব যুদ্ধে আহতদের ব্যান্ডেজ ও চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ—

নুসাইবা বিনতে কাব আল মাজনিয়া (রা.), যিনি উম্মে উমারা নামেও পরিচিত, তিনি বদর যুদ্ধে আহত মুসলমানদের চিকিৎসা প্রদান করেছিলেন। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৩০৭২, আত-তীব ইনদাল আরব, পৃষ্ঠা-৬৫)

তিনি ছাড়াও রাসুল (সা.)-এর ধাত্রী উম্মে আয়মান এবং আনাস বিন মালিকের মাতা উম্মে সালিম (রা.)-ও উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলেন এবং তাঁরা তাঁদের বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে বিপুলসংখ্যক আহত মুসলমানের চিকিৎসা করেছিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, পৃষ্ঠা-১৪, সুবুলুল হুদা ওয়া আল রাশাদ, পৃষ্ঠা-২০১)

চিকিৎসা পেশা

গাজওয়াত ছাড়াও কয়েকজন নারী জব হিসেবে রোগীদের চিকিৎসা করতেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রুফাইদাহ (রা.)। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৮৫)

আরেকজন হলেন কায়িবা বিন সাদ আল আসলামিয়া (রা.), তাঁর সম্পর্কেও ইতিহাসবেত্তারা লিখেছেন যে তিনি শুধু গাজওয়াত উপলক্ষেই নয়, সাধারণ পরিস্থিতিতেও চিকিৎসাসেবা দিতেন। (আল মারআতুল আরাবিয়্যা ফি জাহিলিয়্যাতিহা ওয়া ইসলামিহা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৯৩, কিতাবুস সিকাত, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৫৮)

গাজওয়ায়ে আহজাবের পর মসজিদে নববীতে তাঁর জন্যও একটি তাঁবু স্থাপন করা হয় এবং আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সাদ বিন মুয়াজ (রা.)-এর চিকিৎসাও করেছেন। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-২১২; আল ইসাবাহ আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১২৬২)

চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন ও দক্ষতা

সে যুগে নারীদের প্রচুর চিকিৎসা জ্ঞান ছিল এবং এর মাধ্যমে তাঁরা ছোটখাটো রোগের চিকিৎসা করতেন। কিন্তু সেই সময়ে যখন এটি শাস্ত্র হিসেবে উদ্ভাবন হয়, তখন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) যেসব জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন, তন্মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্র অন্যতম। উরওয়া বিন জুবায়ের (রা.) বলেন, ‘আয়েশা (রা.)-এর চেয়ে আইনশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র ও কবিতায় অধিক জ্ঞানসম্পন্ন অন্য কাউকে আমি দেখিনি।’ (আল ইসতিয়াব ফি মারিফাতিল আসহাব : ৪/১৮৮৩)

আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের মধ্যে উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালমা (রা.)-ও ছিলেন। সেখানে তিনি প্রচুর চিকিৎসা জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, যা তিনি পরবর্তী সময়ে ব্যবহার করেছেন এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে লোকদের বলেছিলেন। এমনকি তিনি রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের সময় কিছু ওষুধ দিয়ে তাঁর চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছিলেন। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা-৪)

শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.)-ও মানুষদের বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলতেন। তিনি কোঁচদাদ (Shingles) রোগ ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা করতেন। একবার তিনি উম্মুল মুমিনিন হাফসা (রা.)-এর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে দেখে বলেন : তুমি তাঁকে [হাফসা (রা.)] যেভাবে লেখা শিখিয়েছ, সেভাবে কোঁচদাদের ঝাড়ফুঁক শিক্ষা দাও না কেন! (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৮৮৭)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে ইসলামের ছায়াতলে নারীরা শুরু থেকেই শিক্ষার স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে এবং এ ব্যাপারে তারা কোনো বৈষম্যের শিকার হয়নি। তাদের চিকিৎসায় জ্ঞানার্জন ও চিকিৎসাসেবার স্বাধীনতা ছিল।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক জ্ঞান অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

arfasadibnsahin@gmail.com

কিউএনবি/অনিমা/২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪,/সকাল ১০:৩৬

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit