এম এ রহিম চৌগাছা (যশোর) : যশোরের চৌগাছায় ফসলে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার ও নদী-নালা, খাল, বিল, হাওড়-বাওড় শুকিয়ে মুক্ত জলাশয়ের দেশী প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। গ্রাম-গঞ্জের খালে বিলে কিছু দেশি মাছ মিললেও মানুষের চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। প্রতিনিয়ত কৃত্রিম উপায়ে বিল-বাওড়, ঘের-পুকুরে মাছের চাষ বৃদ্ধি পেলেও প্রকৃত স্বাদ বিনষ্ট হচ্ছে । মাছ চাষসহ ফসলি জমিতে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে মাছের জীবনচক্র ব্যাপক ভাবে বিপদগ্রস্থ।
সরোজমিনে শুক্রবার (২ আগস্ট) উপজেলার চৌগাছা, পুড়াপাড়া, খড়িঞ্চা, মাশিলা, কচুবিলা, চাঁদপাড়া, সলুয়া, সিংহঝুলি, পাশাপোল, ধুলিয়ানী, খলশি, পাতিবিলা, হাকিমপুর, নারায়নপুর, ফতেপুর ও আড়পাড়া মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির চাষের মাছে বাজার ভরে গেছে। উল্লেখযোগ্য বিদেশি রুই, কাতলা, চিতল, কৈ, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস এবং কার্প প্রজাতির মাছের আমদানীই বেশি। দেশি মাছ খোঁজ করলে কয়েক জন মৎস্যজীবী অল্পসংখ্যক মাছ ঝুঁড়িতে নিয়ে বসে আছেন। আর যে দাম চাচ্ছেন তা ন্মিবৃত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। বিক্রেতার দাবি এ সকল ছোট মাছ এখন পাওয়াই যায় না। সারাদিন মাছ ধরে তা বিক্রি করে সংসার চালানো কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে।
চৌগাছা বাজারে মাছ বিক্রেতা রমেন হালদার বলেন, এক সময় আমরা বেড়গবিন্দপুর সরকারি বাওড়, মর্যাদ সরকারি বাওড়, খড়িঞ্চা সরকারি বাওড়, ও বল্লভপুর সরকারি বাওড়, মাধবপুর বাওড় ও কপোতাক্ষ নদ ও ভৈরব নদ থেকে দেশী মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি। বর্তমানে বাওড় গুলো ব্যাক্তি মালিকানায় লিজ দেওয়ায় সে ভাবে আমরা দেশী মাছ ধরতে পারি না। তাছাড়া সরকারি এ বাওড়গুলোতে লিজকারীরা কার্প জাতের মাছ চাষে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে মাছের জীবনচক্র ব্যাপক বাঁধা গ্রস্থ হচ্ছে। ফলে বাজারে দেশী মাছের চাহিদা থাকলেও এই ধরনের ঝিয়া, কাকীলা, বেলে, বাইন, পাকাল, গুতেলগচি, মায়া, চিংড়ি, চ্যাং, দেশী মাগুর, পাবদা, পুটি, ট্যাংরা, খলিষা, শিং, রইনাসহ এ জাতিয় মিঠা পানির মাছ জন্মাচ্ছে না।
বেড়গোবিন্দপুর গ্রামের মৎসজীবি নিমাই হালদার জানান, দেশি মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে আগে প্রাকৃতিক জলাশয়, মাছ সংরক্ষণ এবং মৎস্য পরিবেশবান্ধব নীতি ও অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। আর বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট প্রায় ২৫০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে ১২টি চরম বিপন্ন এবং ১৪টি সংকটাপন্ন। যদিও চিংড়িসহ ২৯০টি মিঠাপানির মাছ এবং ৫১০টি সামুদ্রিক মাছ রয়েছে। এ সব বিষয় বিশ্লেষণ করলে মাছের যে প্রাকৃতিক জলাশয়, মুক্ত জলাশয় রয়েছে তা আমাদের অযাচিত ও অনৈতিক ব্যবহারের কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তারকে হুমকির সম্মুখীন করছে।
তিনি বলেন, মাছের ডিম ও জাটকা সংরক্ষণে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মৎস্য অধিদপ্তর বেশ প্রচার প্রচারণা করছে কিন্তু সে বিষয়টি এখনও সাড়া জাগানো সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। দেশীয় মাছ অবশ্যই সংরক্ষণ মুক্ত জলাশয়ে তার অবাধে বিচরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থান ও আমিশের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন মৎস্যবান্ধব পরিবেশনীতি ও অবকাঠামোর সফল বাস্তবায়ন।
এ ব্যাপারে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তাছলিমা আক্তার বলেন, বর্তমানে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষেত্র, চলাচল অনেক খানি হুমকির মুখে। আমরা না জেনে, না বুঝে জাটকা নিধন করি। তাছাড়া জমিতে অতি মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়া, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা থেকে বিরত না থাকার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না।
তিনি বলেন, দেশি মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। সেগুলো হলো ধান ক্ষেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারাবছর পাওয়ার জন্য ধানক্ষেতে মিনি পুকুর তৈরি, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, দেশী মাছ কমানোর জন্য বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সাথে দেশী প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় এবং পুকুরে দেশি মাছের চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে।
কিউএনবি/আয়শা/০২ অগাস্ট ২০২৪,/রাত ৮:২০