বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৫ পূর্বাহ্ন

লুৎফর রহমান এর নিয়মিত কলামঃ রুমকীর চোখে নোনা জল

লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
  • Update Time : বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৩
  • ৪১০ Time View

লুৎফর রহমান এর নিয়মিত কলামঃ রুমকীর চোখে নোনা জলে
——————————————————————–
পড়ন্ত বিকেল। রুমকী তার এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আসল। নিউইয়র্ক সিটির বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকা কুইন্সের কিউ গার্ডেনে তার এপার্টমেন্ট। বিগত ২৭ বছর যাবৎ এখানেই বাস করছে রুমকী। সুখ দুঃখ,হাসি কান্না ঘিরেই তার এই যাপিত জীবন নিউইয়র্ক শহরে।

আজ রুমকীর মন খারাপ। খুব অস্থির লাগছে, ছটফট করছে মনটা। নিজের এই এলোমেলো বিক্ষুব্ধতায় রুমকী সিদ্ধান্ত নিল, এই পড়ন্ত বিকেলে সে তার কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরবে। একা একা কুইন্স কলেজ মাঠের কার্পেট সদৃশ্য সবুজ ঘাসের উপর বসে সে চলে যাবে তার অতিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন চত্বরে অথবা বাংলাদেশের অন্য কোথাও।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি রুমকী তার স্বামীর সাথে নিউইয়র্ক চলে আসে। ৬ মাস পর তার স্বামীর চরিত্রের কদর্য রূপ প্রকাশ পেলে রুমকী সিদ্ধান্ত নেয় সে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করার পর তার স্বপ্ন ছিল বিদেশী ডিগ্রী অর্জনের। বৈবাহিক সূত্রে নিউইয়র্কে প্রবাসী হওয়ায় সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সে বিলম্ব করেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউইয়র্কের কুইন্স কলেজ। কুইন্স কলেজটি মূলতঃ নিউ ইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ। ১৯৩৭ সালে কুইন্স কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১০০ টিরও বেশি ডিগ্রি প্রোগ্রাম এবং সার্টিফিকেটে স্নাতক পড়াশোনা, ৪০ টিরও বেশি মাস্টার্স এর বিকল্প ও ২০ টি ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা আছে এই কলেজে। কলেজটি সাতটি স্কুলে বিভক্ত: অ্যারন কোপল্যান্ড স্কুল অফ মিউজিক, গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন স্টাডিজ, আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিস স্কুল, আর্থ স্কুল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস, স্কুল অফ এডুকেশন, ম্যাথ অ্যান্ড ন্যাচারাল সায়েন্সেস স্কুল, এবং সোশ্যাল স্কুল বিজ্ঞান।

কুইন্স কলেজের মাঠ সংলগ্ন পাইন গাছের ছাঁয়ায় বসে পড়ল রুমকী। এখানে আসলে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের আমেজ খুঁজে পায়। ঐতিহাসিকভাবে এই দুই প্রতিষ্ঠানের খুব মিলও আছে। ৬০ এর দশকে কুইন্স কলেজের শিক্ষার্থীরা সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিল নাগরিক অধিকার আন্দোলন সংগ্রামে। এছাড়াও আমেরিকার অনেক আন্দোলন সংগ্রামে কুইন্স কলেজের সংশ্লিষ্টতা জড়িয়ে আছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য সকল আন্দোলন সংগ্রামে।

রুমকীর খুব ইচ্ছে করছে নাহিদকে একটা কল দিতে। কিন্তু দুই দেশের সময়ের ব্যবধান দেয়াল তুলে দিয়েছে দুজনের মাঝে এখন। বাংলাদেশে নাহিদ হয়ত রাতের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মনটা খারাপ হয়ে গেল রুমকীর। নাহিদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাকুলতা তীব্রতর হচ্ছে তার অন্তরে।

কুইন্স কলেজের মূল ক্যাম্পাস ভবনের সামনে সুউচ্চ টাওয়ারে বড় চারটি ঘড়ি সমান তালে তার কাটা ঘুরাচ্ছে। টাওয়ারের উপরে স্কয়ার আকৃতির চার দিক থেকেই চারটি ঘড়ি লাগানো আছে। যে কেউ যে কোন দিক থেকে ঘড়ি দেখতে পাবে। সময় দেখতে পাবে। পড়ন্ত সূর্যের তির্যক আলো প্রতিফলিত হচ্ছে ঘড়ির কাটায়। ঝিলিক দেয়া এই আলোতে সময়ের ঘড়ি রুমকীকে নিয়ে গেল ৩৪ বছর আগে, বাংলাদেশের পটভূমিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদ ভ্যাকেশন চলছে। একটানা ৫৭ দিন ধরে ক্লাস বন্ধ, হল বন্ধ। কলাভবন চত্বরে উদাস করা কোন এক দুপুরে কেউ হেঁটে গেলে পায়ের নীচে শুকনো ঝরা পাতা মচমচ আওয়াজ তুলে ভেঙ্গে যায়। একই এলাকার মানুষ নাহিদ ও রুমকী। গ্রামের বাড়ীতে দুজনেই হাঁপিয়ে উঠেছে। প্রতিদিন দুপুর বেলা নাহিদ ছুটে যায় রুমকীর বাড়ীতে।

রুমকীর মা রাশভারী একজন মহিলা। একটি সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষিকা। রুমকীর মায়ের স্কুলে থাকাকালীন সময়টা তারা আড্ডা দেয়। কথার ফুলঝুড়ি ছুটায় দুজনে। ক্যাম্পাসে ফেরার ব্যাকুলতা দুজনেই অনুভব করে। মফস্বল শহরে গ্রামের বাড়ীতে প্রহর গুনতে গুনতে দুজনেই হাঁপিয়ে উঠেছে।

গল্পের এক পর্যায়ে রুমকী নাহিদকে বলে, মুরগিটা জবাই করে দাও। আম্মা স্কুল থেকে এসে রান্না করবে। নলকূপের পাশে দুজনে চলে যায়। রুমকী দুই হাতে মুরগির পা চেপে ধরে। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে নাহিদ মুরগির গলায় ছুরি চালায়। ফিনকি দিয়ে কাটা গলার রক্ত রুমকীর সালোয়ার কামিজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে যায়। মুরগিটা ছুড়ে ফেলে দেয় রুমকী। নাহিদ দৌড়ে যেয়ে গামছা ভিজিয়ে রুমকীর সালোয়ার কামিজে মুরগির তাজা রক্ত মুছে দেয়।

হটাৎ সম্বিৎ ফিরে পায় রুমকী। বাস্তবে সে এখন নিউইয়র্কের কুইন্স কলেজের মাঠে। কিন্তু তার গাল ভিজে গেছে চোখের নোনা জলে। কিন্তু সে কাঁদছে কেন ? এই কান্নার কি সুনির্দিষ্ট কোন কারণ আছে ? রুমকী খুঁজতে থাকে সে কান্নার কার্যকারণ। অবশেষে একটা কারণ খুঁজে পায় রুমকী। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিন নাহিদ মুরগি জবাই করে দিয়েছে। কিন্তু একদিনও রুমকী মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়াতে পারেনি নাহিদকে। এই কথা মনে হতেই আবারও রুমকীর চোখ ফেটে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে কুইন্স কলেজ মাঠের সবুজ ঘাসে।

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।

 

 

কিউএনবি/বিপুল/০৮.১১.২০২৩/ রাত ৯.৪২

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit