স্পোর্টস ডেস্ক : ‘ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম। দুই বনস্পতি মধ্যে রাখে ব্যবধান; লক্ষ লক্ষ তৃণ একত্রে মিলিয়া থাকে বক্ষে বক্ষে লীন’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতায় দুর্যোধনের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন কথাগুলো। সেই মহাভারতের যুগ থেকে আজকের এই ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের যুগে এসেও মনে হচ্ছে, কথাগুলো কতটা বাস্তব সম্মত। সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবালের সম্পর্কের রসায়নে প্রচন্ড রকম ভাবে প্রযোজ্য।
কাছাকাছি বয়সের এই দুই ক্রিকেটার বয়সে, বিত্তে, খ্যাতিতে যতক্ষণ ছোট ছিলেন; ততদিন তাদের সম্পর্ক ছিল গাঢ় বন্ধুত্বের। বয়স বেড়েছে, খ্যাতির সীমানা বড় হয়েছে, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোও বেড়েছে। তারপর এক সময় অভিমান বদলেছে ঈর্ষায়, সূচনা হয়েছে বৈরিতার। ফলাফল, বাংলাদেশের সফলতম দুই ক্রিকেটার এবং এক সময়ের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুর মাঝে বাক্যালাপ এমনকি মাঠের বাইরে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ২০২৩ বিশ্বকাপের দলে তামিমের না থাকার পেছনে নাকি সাকিবেরই ইন্ধন, অন্তত কাল ফেসবুক লাইভে এসে সেরকই তো ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন তামিম ইকবাল।
২০০৬ সালের অনূর্ধ ১৯ বিশ্বকাপের দলে ছিলেন সাকিব ও তামিম। বিকেএসপির সময় থেকেই সাকিব কোচদের কাছে প্রতিভা, অন্যদিকে খান পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের এক মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে তামিমের গল্পও ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিকেট অঙ্গণে। দুজনেই যুব বিশ্বকাপে খেললেন এবং পরের বছরই জাতীয় দলে চলে আসলেন। তামিমের অভিষেক ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আর সাকিবের ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট। দুজনেরই প্রথম প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, মাঠটাও একই হারারে স্পোর্টস ক্লাবের মাঠ। ২০০৭ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে দুজনেই করলেন হাফসেঞ্চুরি। সেই দলে থাকা একজনই বলছিলেন, ‘দুজনের ভেতর এত বন্ধুত্ব ছিল, বলার মত না। একজন আরেকজনকে ছাড়া চলতেই পারত না। সবসময় তাদের দুইজনকে দেখা যেত একসঙ্গে। একই রুমে ছিল কি না মনে নেই তবে তারা দিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই একসঙ্গেই থাকত।’
চট্টগ্রামের ছেলে তামিম আর মাগুরার সাকিবের ঢাকার ঠিকানাও দীর্ঘদিন ছিল এক। ব্যাচেলর জীবনে দুজনেই থাকতেন একই বাসায়। দুজনে একজোট হয়ে প্রিমিয়ার লিগেও খেলেছেন। দীর্ঘদিন মোহামেডানের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম টিটু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০০৭-৮ মৌসুমে ওরা দুজন একসঙ্গে মোহামেডানের হয়ে খেলেছে। এরপর ২০১১-১২ মৌসুমে খেলেছে ভিক্টোরিয়াতে। সেবার দলটা মোহামেডানই করেছিল, কিন্তু ক্লাবে নির্বাচন সংক্রান্ত জটিলতা ও কোন্দলে দলটা ভিক্টোরিয়াকে দিয়ে দেই। লুৎফর রহমান বাদল অর্থায়ন করেছিলেন। সেই বার আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।’ ২০১৬ সালেও প্রিমিয়ার লিগে প্লেয়ার্স বাই চয়েজে আবাহনীতে খেলা হয় সাকিব আর তামিমের। ততদিনে অবশ্য বন্ধুত্ব আর নেই।
ফেব্রুয়ারির কথা। দেশের একটি ক্রীড়া সাংবাদিকদের সংগঠন একটি ক্রীড়াবিদদের পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। ১০ বছরের জমে থাকা সব পুরষ্কার দেয়া হয়েছে এক রাতে। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন সাকিব ও তামিম দুজনেই। তামিমের আবার সেই রাতেই দেশের বাইরে চলে যাবার কথা, খুব সম্ভবত ওমরাহ করতে। তাই তামিমের হাতে ক্রম ভেঙ্গেই আয়োজকরা তুলে দেবেন পুরষ্কার। আমন্ত্রিত ক্রিকেটাররা সবাই বসেছেন এক সারিতে। তাদের মাঝে তামিমও আছেন, সাকিব এসে বসেছেন কয়েক সারি পেছনে অনূর্ধ ১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের বিকেএসপির কয়েকজন ছোটভাইয়ের সঙ্গে। তামিম পুরষ্কার নিয়ে চলে গেলেন, তারপর সাকিব গিয়ে বসলেন এসময়ের সতীর্থদের পাশে। খুবই ছোট্ট ঘটনা, অনেকের হয়তো নজরই এড়িয়ে গেছে। কিন্তু যারা দেখেছেন, স্পষ্টই বুঝেছেন একে অন্যের মুখোমুখি হতে চান না সাকিব-তামিম। দিন কয়েক পর, সেই ফেব্রুয়ারি মাসেরই ২৫ তারিখে একটি বিদেশী ওয়েবসাইটে দেয়া সাক্ষাৎকারে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ‘আমি আপনাকে নিশ্চিত করেই বলতে পারি, ড্রেসিংরুমটা স্বাস্থ্যকর জায়গায় নেই। ওদের (সাকিব ও তামিম) মধ্যে দ্বন্দ আছে, এমন নয় যে আমি সেটা সমাধান করার চেষ্টা করিনি। আমি ওদের দুজনের সঙ্গেই কথা বলেছি এবং আমার মনে হয়েছে বিষয়টা এমন পর্যায়ে গেছে যে সেটা আমাদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। মাঠে ও ড্রেসিংরুমে ওদের কথা বলতে হবে। এর বাইরে কি করবে সেটা আমার দেখার বিষয় নয়।’ দিনদুয়েক পর, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলনে এলেন সেসময়ের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম, চোটের জন্য ভারত সিরিজ মিস করায় সেই সংবাদ সম্মেলনটা ছিল বেশ লম্বা সময়ের পর তার গণমাধ্যমের সামনে আসা। চোট, প্রস্তুতি, রিহ্যাব সবকিছু বাদ দিয়ে সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটাই কথা জানতে চেয়েছেন, সাকিবের সঙ্গে কি কথা হয় তামিমের? জবাবে তামিম যেন মেটালিকার গানটাই বারবার বাজিয়ে বলেছেন, ‘নাথিং এলস ম্যাটারস’, ৩০ মিনিটে এই তিনটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন ১৫ বারের কাছাকাছি।
শুরুটা হয়েছিল একসঙ্গে। তারপর জীবনের দৌড়ে কে কতখানি এগিয়েছেন বা পিছিয়েছেন তা সময়ই বলে দেবে। সাকিবের আইপিএল সহ ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে কদর আছে তো তামিমের আছে লর্ডসে সেঞ্চুরি। একের পর এক ব্র্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি সই করেছেন সাকিব, বছর বছর সেসবের নাম বদলেছে। তামিমের সঙ্গে বেশ কয়েকটা ব্র্যান্ড আছে লম্বা সময় ধরে। দেশের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনে তারা দুজন ছিলেন দলের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক। আবার দুজনকেই দায়িত্বচ্যুত করা হয়েছে একই সঙ্গে। তারপরই ধীরে ধীরে বেড়েছে ব্যবধান। অভিমানকে ইন্ধন দিয়ে পরিণত করা হয়েছে ক্ষোভের আগুনে, তাতেই পুড়েছে সম্প্রীতির বন্ধন। চেনা কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে বসে তামিমের খাওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৯ বিশ্বকাপের অফিশিয়াল ফটোসেশনে না থাকায় সাকিবের সমালোচনা হওয়াতে এই নিয়ে সাকিবের স্ত্রী শিশির ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘সাংবাদিকদের নিয়ে আসলেই আমার কিছু বলার নেই। কেন তারা সাকিব আল হাসানকে এত ঘৃণা করে! আমি মনে করি, এটা আসলে আমাদেরই দোষ যে, আমরা তাদেরকে ডিনার বা লাঞ্চে দাওয়াত দিয়ে তাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর কথা বলে তোষামোদ করিনি, কিংবা তাদেরকে ভেতরের খবর বলে দিইনি।’ ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাকিব অধিনায়ক, তামিম নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন এই সংস্করণ থেকে। তবে দেশে একটি টিভি চ্যানেলে ছিলেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তখন সাকিব-পত্নী ফেসবুকে খোঁচা মেরে লিখেছিলেন, ‘আমরা ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে একটু কথা বলতে পারি। আমি অবাক হচ্ছি আমরা ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মতো বড় দলগুলোর বিপক্ষে কেনো জিততে পারিনি যখন আমাদের গতি তারকারা এবং কথিত সেরা উদ্বোধনী জুটি ছিলো! কী ভুল হয়েছিল ওই ম্যাচগুলোতে কৌতূহলী মন জানতে চায়? আমরা যদি সেই ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য তখন কিছু টকশো করতাম তাহলে আজ আমাদের এই ব্যর্থতা দেখতে হতো না।’ সাকিবের স্ত্রী ড্রেসিংরুমেও থাকেন না, বেশিরভাগ সময় দেশেও থাকেন না। তবুও কেন তার তামিম এবং মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার উপর এত বিদ্বেষ, এসবের উৎস কি তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
তামিম ফেসবুক লাইভে এসে নিজের বিশ্বকাপ দলে না থাকার পেছনে অনেক কিছু বলেছেন। তিনি তার মত করে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। দীর্ঘ ১২ মিনিটের সেই বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে নাম উল্লেখ না করেও সাকিবের প্রতিই তার অভিযোগ, ‘অনেক কিছুই ঘটেছে এটা আপনারা দেখেছেন আমি নিশ্চিত। একটা কাহিনী বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে, দুটো কাহিনী ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। কিন্তু একজনের সঙ্গে তিন-চার মাসে যদি সাত-আটটা কাহিনী হয় তাহলে সেটা ইনটেনশনাল হয়।’
মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তাই হচ্ছে গীতা। অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে সব ন্যায়। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও মিথ্যা বলেছিলেন, অর্জুনও ভ্রাতৃঘাতী হয়েছিলেন, ভীমও নিয়মলঙ্ঘন করে দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করেছিলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে পাঁচজন জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারকে মহাভারতের পাঁচ চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ‘পঞ্চপান্ডব’ বলে ডাকা হত, কে জানত তাদের জীবনেও এমন কুরুক্ষেত্র তৈরি হবে। একে অন্যের দিকে কথার তীর ছুঁড়বেন, শকুনির মত কূটকৌশলের আশ্রয় নেবেন।
দ্বন্দ অর্থ বিভেদ আর সমাস মানে সন্ধি। সাকিব আর তামিমের সম্পর্কটা যেন দ্বন্দ সমাস, এক দলে অনেক দিন খেলেও দুজনেই সরে গেছেন আলোকবর্ষ দূরে।
কিউএনবি/অনিমা/২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩,/রাত ৮:৩৫