শান্তা ইসলাম নেত্রকোনা প্রতিনিধি : নেত্রকোনার মদনে সংস্কারের পরপরই ধসে গেছে ফসলরক্ষা বাঁধ। এ নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে আগাম বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে কাজের মান ও অনিয়ম নিয়েও। নেত্রকোনা পাবলিক হলে শনিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও জেলার সকল পিআইসি কমিটির সভাপতিদের সাথে আলোচনা করেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। সকলকে যথা সময়ে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
নেত্রকোনার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের ‘বালুই ব্রিজ উত্তরপাড় ফসল রক্ষা বাঁধ উপ-প্রকল্প’ বাঁধটি সংস্কারের পরপরই ধসে পড়ে পাশের খালে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারী ওই বাঁধের সংস্কার কাজ শেষ হয়। সংস্কারের চারদিনের মাথায় গত ৪ মার্চ বাঁধ ধসে যাওয়ায় এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আগাম বন্যায় ফসলহাণির আশঙ্কায় ভোগছেন এলাকার কৃষকরা। বাঁধ সংস্কারে অনিয়মের অভিযোগ তুলছেন স্থানীয়রা। এলাকাবাসীর অভিযোগ যেনতেন করে বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বাঁধ তদারকিও তেমন নেই।
বাঁধ এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধের ১০০ গজের বেশী জায়গা পাশের খালে ধসে গেছে। ধসে যাওয়া স্থানের মাটি আটকে রাখার জন্য বাঁশের চাটাই ও খুঁটি দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। বাঁশ ও চাটাই তাও হেলে পড়েছে। যা বাঁধের মাটি ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, পাউবো’র তত্ববাবধানে হাওরে বোরো ফসল রক্ষায় কাবিটা কর্মসূচির আওতায় জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ২০৬ টি বাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে মদন উপজেলায় ২৪টি ফসল রক্ষা বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে। এ কাজের বরাদ্দ ধরা হয়েছে দুই কোটি পাঁচ লাখ টাকা। এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ‘বালুই ব্রিজ উত্তরপাড় ফসল রক্ষা বাঁধ উপ-প্রকল্প’ বাঁধটির বরাদ্দ ১৮ লাখ ১১ হাজার ৯৭৯ টাকা। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর জেলার ওই সমস্ত বাঁধের নির্মাণ ও সংস্কার কাজ শুরু হয়ে শেষ হয়েছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারী।
এলাকার কৃষকরা জানান, গোবিন্দশ্রী ব্রিজের কাছে ফসলরক্ষা বাঁধ সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার চার দিনের মাথায় গত ৪ মার্চ বৃষ্টি- বাদল না হওয়ায়ই বাঁধ ধ্বসে পড়েছে। বৃষ্টি হলে বাঁধের বিভিন্ন স্থান ধ্বসে যাবে। বন্যার পানি এলে এ বাঁধ টিকবে না। ফসলরক্ষা বাঁধ নিয়ে প্রতিবছরই অনিয়মের অভিযোগ উঠে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড তেমন গুরুত্ব দেয় না। এতে করে অনেক সময় বহু কষ্টে উৎপাদিত ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। বাঁধ নিয়েও ব্যবসা হয়। বাঁধে কোন রকম নামমাত্র মাটি ফেলে দায়সারা কাজ করেন সংশ্লিষ্টরা। আর কৃষকরা এসব অনিয়মের ভুক্তভোগী হয়। বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে গেলে উপজেলার হাজার হাজার কৃষকের বেঁচে থাকার অবলম্বন শেষ হয়ে যাবে। দেখা দেবে এলাকায় খাদ্য খাদ্য সংকট। পরিবার পরিজন নিয়ে এলাকার কৃষকদের দিন কাটবে কষ্টে। সেই সাথে গো- খাদ্যের সংকটও দেখা দেবে। গৃহ পালিত পশু না খেয়ে মারা যাবে।
মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম, আবুল হোসেন, ও গোলাম কিবরিয়সহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা হয়। তারা জানান, হাওরে একটি মাত্র বোরো ফসলের ওপর আমাদের পরিবারের সারা বছরের খাওয়া দাওয়া, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া নির্ভর করে। আগাম বন্যায় বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে গেলে পরিবার নিয়ে তাদের পথে বসা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবে না। একই অবস্থা হবে পুরো এলাকার অন্য কৃষকদেরও। কারণ প্রামের মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মদন উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার মদন উপজেলায় ১৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ফসলের আবাধ করা হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৮ হাজার ৭০৬ মেট্রিক টন।
‘বালুই ব্রিজ উত্তরপাড় ফসল রক্ষা বাঁধ উপ-প্রকল্প’ কমিটির সভাপতি আজিজুর হক সোহেল বলেন, বাঁধের পাশে গভীর হওয়ায় মাটি দিলেও থাকে না। মাটি খালে ধসে যায়। বাঁশের বেড়া ও লোহার রড দিয়ে শক্ত টানা দেওয়া হয়েছিল। তবুও পাশের কুড়ের কাছে বাঁধটি ধসে গেছে। বাঁধটি শক্তভাবে দেওয়ার জন্য বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিৎ। নির্ধারিত টাকাই তো সময়মতো পাওয়াা যায় না। অতিরিক্ত বরাদ্দ তো দূরের কথা। এসব কাজে আসলে আমাদের লোকশান হয়। নিজের জমি আর ফসল রক্ষার জন্য এ কাজ নেই। এই বাঁধটি শক্তভাবে মেরামতের জন্য অধিক বরাদ্দ দেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বলেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এখনও বরাদ্দ পাইনি।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-সহকারী প্রকৌশলী ওবায়দুল হক জানান, মদনের গোবিন্দশ্রী কুড়ের পাশে বাঁধটি ধসে গেছে। ধসে যাওয়া অংশটি মেরামতে কাজ করা হচ্ছে। মদন উপজেলা কাবিটা কর্মসূচির সভাপতি ও নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানজিনা শাহরীন জানান, ফসলরক্ষা বাঁধের ধসে যাওয়া জায়গাটি মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কাজ চলছে। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান বলেন, গোবিন্দশ্রীর বালুই ব্রিজ উত্তরপাড় ফসল রক্ষা বাঁধ উপ-প্রকল্পে কিছুটা জায়গা ধসে গেছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ধসে যাওয়া জায়গা রক্ষার জন্য দু’ একদিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে।
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, হাওর এলাকায় ফসলরক্ষা বাঁধের ২০৬টি প্রকল্পের সবগুলোর মাটি কাটার কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ১৭৬টির বাঁধের পাশে গাছ লাগানোও হয়ে গেছে। বাকীগুলোরও কাজ চলছে। মদনে বালুই ব্রিজ উত্তরপাড় ফসল রক্ষা বাঁধ উপ-প্রকল্পের পাশে নদী গভীর হওয়ায় কিছুটা স্থান ধসে গেছে। ওই জায়গা রক্ষার জন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। মাটির বস্তা ফেলে ওই স্থান রক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কিউএনবি/আয়শা/১৯ মার্চ ২০২৩,/দুপুর ২:৪৫