আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিশ্ব ক্রমশ প্রাকৃতিকভাবে অস্থিতিশীল ও দুর্যোগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশে ভূমিধস, সাইক্লোন, সুনামি এবং ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে দাবানল, অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ ও সাম্প্রতিক শৈত্যপ্রবাহের রেকর্ড প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণের বার্তা দিচ্ছে।
প্রায়ই দেখা যায়, উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ সহায়তার মতো অতি জরুরি সেবাগুলো যাদের সবচেয়ে বেশি দরকার তাদের হাতে পৌঁছায় না। তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি।
ভূমিকম্পে তুরস্কের ক্ষয়ক্ষতি
গত ৬ ফেব্রুয়ারি অতি শক্তিশালী একাধিক ভূমিকম্প তুরস্ক ও সিরিয়ায় আঘাত হানে। এই ভূমিকম্পকে গত একশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ বলা হচ্ছে। ভূমিকম্পে প্রতিবেশী দেশ দুটির সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে সিরিয়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তুরস্কে।
দেশ দুটির কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘গত এক শতকে এত বড় দুর্যোগ পৃথিবী দেখেনি। এই দুর্যোগের উৎসে এখনও পৌঁছাতে পারিনি আমরা। সব মিলিয়ে ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও অস্পষ্ট। এ এক ভয়াবহ অবস্থা।’
সবশেষ খবর পাওয়া তথ্য মতে, দুই দেশ মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। তুরস্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ৪৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহত হয়েছে অন্তত ১ লাখ ৮ হাজার। প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
এ ভূমিকম্পকে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি বলেছেন, পরমাণু বিস্ফোরণ হলেই কেবল এমন ভয়াবহতা দেখা যায়। তুর্কি গণমাধ্যমকর্মীরা জানিয়েছেন, তুরস্কের সীমান্তবর্তী ১০টি প্রদেশের একটি উচু ভবনও আর সোজা দাঁড়িয়ে নেই। ভূমিকম্পে সব ধসে পড়েছে। কার্যত এক মৃত্যু-উপত্যকায় পরিণত হয়েছে দক্ষিণ তুরস্ক।
ভূমিকম্পের পর আক্রান্ত ১০টি প্রদেশের অন্তত ৭ লাখ ৬৩ হাজার ভবন পর্যবেক্ষণ করেছে তুরস্কের পরিবেশ, নগরায়ন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। জানিয়েছে, ৪১ হাজার ৭৯১টি ভবন হয় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অথবা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে।
তুরস্ক সরকারের এক হিসেবে অন্তত ৬১ হাজার ৭২২টি ভবন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এগুলো এখন ভেঙে ফেলতে হবে। এছাড়া ভূমিকম্পে ওই ১০ প্রদেশের রাস্তা-ঘাট চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।
তুরস্কে অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ
তুরস্কে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান জেপি মরগান বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) জানিয়েছে, ভূমিকম্পে তুরস্কের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলার। যা দেশটির জিডিপির প্রায় ২.৫ শতাংশ।
তবে তুর্কি এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড বিজনেস কনফেডারেশন (তুর্কনফেড) ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি বলছে। তুরস্কের ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, বিধ্বংসী ভূমিকম্পে তুরস্কের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে, যা দেশটির জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ।
তুর্কি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির অনুমান, ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে তুরস্কের আবাসিক ভবনগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিক হিসাবে যা প্রায় ৭০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে আরও ১০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ শতাংশ কমে গেছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ২৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। ছয়দিন পর ২.৬৫ বিলিয়ন ডলার কমে তা ২৪.৪৪ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মানও আরও পতন হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ ও ২০২১ সালের তুলনায় ৪৪ শতাংশ হারিয়েছে।
সিরিয়ার ক্ষয়ক্ষতি
সিরিয়ায় এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৯০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া আহত হয়েছে আরও ১৪ হাজার ৫০০। সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, তুরস্ক সীমান্তবর্তী যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো ও লাতাকিয়া প্রদেশে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৯৫০ জনের। আর বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৯ জনের।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১ কোটি ৯০ হাজার মানুষ। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। হতাহতের সংখ্যার মতো সিরিয়ায় অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়েছে। দেশটির সবমিলিয়ে ৪৯০টি ভবন আংশিক বা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে কয়েক হাজার ভবন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তুরস্কের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির হিসেব পাওয়া গেলেও সিরিয়ার অবকাঠামো ক্ষতির পরিমাণ এখনও জানা যায়নি। তবে এই ক্ষতি কয়েক বিলিয়ন ডলার হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কারা
শুরুতেই বলা হয়েছে, যখনই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে, তখন সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহায় ওই এলাকার আর্থিকভাবে দুর্বল তথা গরিব-অসহায় মানুষেরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিযায় গত প্রায় এক যুগ ধরে যুদ্ধ চলছে।
দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম বড় শরণার্থী সংকট তৈরি করেছে। অন্তত ১ কোটি ৩০ লাখ সিরীয় অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছে। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে আরও ৬৭ লাখ।
এসব মানুষের বড় অংশই সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, এই সংখ্যা ৪০ লাখ। স্মরণকালের ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের একটি কেন্দ্রস্থল তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ গাজিয়ানতেপ শহরে।
শহরটি কয়েক লাখ সিরীয় শরণার্থীর আবাস্থল। বেশিরভাগই তাঁবু ও অস্থায়ী ঘরে বসবাস করত। ভূমিকম্পে পুরো অঞ্চলে বিপর্যয় নেমে আসে। সিরীয় যুদ্ধে উদ্বাস্তু হওয়া লাখ লাখ শরণার্থী ভূমিকম্পের পর আরও একবার উদ্বাস্তু হয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দেয়া তথ্য মতে, তুরস্কের ৮ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরিয়ায় এ সংখ্যা অন্তত ১ লাখ। দুই দেশ মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হতাহতদের মধ্যে বহু শিশু রয়েছে। মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ দাবি করেছে, ভূমিকম্পে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭০ লাখেরও বেশি শিশু। এরমধ্যে, শুধু তুরস্কেই এ সংখ্যা অন্তত ৪৬ লাখ।
এছাড়া প্রয়োজনীয় খাবার, পানি ও বিদ্যুতের অভাবে মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত একেকটি নগরী। একই পরিস্থিতি সিরিয়াতেও। বিশ্বের অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ত্রাণ সহায়তা পাঠালেও সেসব ত্রাণ এখনও ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছায়নি।
কিউএনবি/আয়শা/২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩/রাত ১১:১৯