শহিদ আহমেদ খান সাবের,সিলেট প্রতিনিধি : শিক্ষার মাধ্যমে মানবসমাজ মনুষ্যত্বের জ্ঞান লাভ করে। কিন্তু ইদানিং আমরা লক্ষ্য করছি, মনুষ্যত্বের জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে শিখানো হচ্ছে বিবর্তনবাদ, বানর থেকে মানুষের বংশবিস্তার, ইতিহাস বিকৃতি, , পৌত্রলিকতা, বিকৃত নানান ভুল ও অসঙ্গতি। এমন পরিস্থিতিতে ৯২% মুসলমানের দেশে শিক্ষা-সিলেবাস প্রশ্নবিদ্ধ! বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে? কী শিখছে আমাদের শিক্ষার্থীরা? নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়া ও দেশ-বিদেশের সচেতন মহলে দারুণ হৈচৈ চলছে।স্কুল ও মাদরাসার নতুন পাঠ্যবই নিয়ে তুমুল বিতর্কের কারন হিসেবে অনুসন্ধ্যান করে জানা যায়- নিম্ন মাধ্যমিকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বই নিয়ে বিতর্ক বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে মাদরাসার বইয়ে নাস্তিকতা ও পৌত্তলিকতা, বিবর্তনবাদ পর্দাবিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেওয়া এবং ইসলামের ইতিহাস বিকৃতি করে হিন্দুত্ববাদি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে দেশপ্রেমী জনতা। বিষয়টি যে এবার নতুন এমন নয়।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষের আগের বইগুলোতেও বার বার ভুল ধরা পড়েছে।এছাড়াও এবারের শিক্ষাক্রমে স্বনামধন্য একজন লেখকের লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে হুবহু চুরি আর গুগলের অনুবাদ নিয়েও সমালোচনার ঝড় বইছে। দেশের বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ভুল, বিকৃত ইতিহাস, যৌনতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আর কল্পকাহিনি দিয়ে ভরা এবারের নতুন বই দ্রুত সংশোধনের জোর দাবি জানিয়েছেন। বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। প্রতিবছর এই সব বইয়ে কম বেশি ভুল থাকে। আর ভুল দিয়েই যদি শুরু হয় শিক্ষাজীবন তাহলে তার খেসারত দিতে হয় সারা জীবন। ২০২২ সালে প্রকাশিত জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বইয়ের ১৭৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি উৎসবের দিন। অথচ ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে দিনটিকে ঐতিহাসিকভাবে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিত বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় শহিদ শিরোনামে রচনায় বলা হয়েছে, ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের অধিবেশনে প্রথম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্টভাষা। অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই ঘোষণা করেন। ধর্ম বিদ্বেষ তো আছেই, এভাবে প্রতিবছর ইতিহাস বিকৃতিও ঘটে চলেছে। কী রয়েছে পাঠ্যপুস্তকে? পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদের কুফুরি আকিদাহ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ কোত্থেকে এলো? এই প্রশ্নটি খুবই পরিচিত একটি প্রশ্ন। কুরআন আমাদেরকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান আকৃতিতে আসে নি। বরং সৃষ্টিই হয়েছে এভাবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বইতে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে। থিউরি অব এভুলেশন তথা বিবর্তনবাদের ভিত্তিতে।
এজন্য উপস্থাপন করা হয়েছে নানা রকম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর। যার সবটুকুই অনুমান ও কল্পনা। সত্যের সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এমন বিশ্বাস পোষণ করা সুস্পষ্ট কুফুরি। ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘সমাজবিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের ২৪ নং পৃষ্টায় উদৃত পাঠে বলা হচ্ছে ; ‘আমাদের প্রথমে মনে রাখতে হবে যে আধুনিক মানুষ ও বানর-গোত্রের নানা প্রাণী (যেমন : শিম্পাঞ্জী, গরিলা) একটি সাধারণ প্রাইমেট জাতীয় প্রজাতি থেকে তাদের যাত্রা শুরু করেছে।’ এসব পড়ানো হবে তখন যখন আপনার শিশুটি ষষ্ঠশ্রেণীর শিক্ষার্থী। তার বয়স ১১ থেকে ১৪ এর ভেতরে। যখন সে ভালো ও মন্দ, সঠিক ও ভুলের সুস্পষ্ট তফাত করতে শিখেনি। এখনও তার মাঝে সঠিক মানদ- ও মূল্যবোধ তৈরী হয়নি। এখনও ছোট আছে ভেবে আপনি তাকে ইসলামি আকিদাহ ও বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত করেন। কিন্তু সুযোগ পেয়ে তথাকথিত সেক্যুলার গোষ্ঠি তার মস্তিষ্কে কুফুরি আকিদাহ পুশ করে দিচ্ছে। মুসলিম পরিবারের শিশুদের যেন ছিনতাই করে নিয়ে নাস্তিক ও সেক্যুলার বানানোর পাঁয়তারা করছে।
সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে হুবহু চুরি আর গুগলের অনুবাদ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। বইটির সমালোচনা করে একজন লেখক লিখেছেন, অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে পাঠ্যপুস্তকটি পড়া শুরু করেছিলাম। দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, লেখকদের সম্পাদনায় প্রকাশিত বইটি হাতে পাওয়ার পর সত্যি একধরনের অস্বস্তিবোধ কাজ করছে। শুরুতে যেভাবে লাইন টু লাইন অনলাইন ওয়েবসাইট থেকে কপি করে বাংলা অনুবাদ করেছে, সেটি দেখার পর মনে হয়েছে, আমরা ঠিক কোন শিক্ষাব্যবস্থা কোমলমতি শিশুদের সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছি? আমার চোখ যতটি পৃষ্ঠা নজর দিয়েছে, তার অংশ এইভাবে গুগল ট্রান্সলেটরে ভাষান্তর করা হয়েছে। আমরা হয়তো ভুলে গেছি, গুগল আমাদের বাংলা ভাষার ভাষান্তর এখনো সঠিকভাবে দিতে পারে না।
ভুলভাল ইংরেজিতে বাংলার ভাষান্তর হয়, সেটি সম্ভবত লেখকেরা ভুলে গেছেন। ভাবতে অবাক লাগছে- যাদের নিজস্ব বই লিখার প্রতিভা নাই বরং বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে চুরি করে বই লিখতে হয় তারা নাকি এদেশের বুদ্ধিজীবী। অন্যান্য দেশের বুদ্ধিজীবীরা যেখানে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন নান্দনিক জিনিস তৈরি করে বিশ্বের কাছে নিজের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে সেখানে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের সামান্য একটা বই লিখতে ও চুরি করতে হয়। এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ অতল গর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে এবছর যে বইগুলো গেছে সেগুলো পরীক্ষামূলকভাবে গেছে। কাজেই এবার ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ১ম শ্রেণিতে যে বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে উঠেছে সেগুলোতে ভুল থাকতে পারে। তিনি আরো বলেন, আমরা মাধ্যমিকের ৩৩ হাজার প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলক সংস্করণের বইগুলো দিয়েছি। আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নিব এবং সে অনুযায়ী বছরব্যাপী আমরা এগুলোকে পরিমার্জন-পরিশীলন করব। আমরা একটা সময়োপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ণ করেছি।
কারণ এখন আমাদের সামনে ২০৩০ সালের যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যেটি আমাদেরও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার। সেখানে ১৭টি যে গোল বা লক্ষ্য রয়েছে তার ৪নং লক্ষ্য শিক্ষা হচ্ছে সবকিছুর কেন্দ্রে। সেই শিক্ষার যদি আমরা মান অর্জন করতে পারি, সেই শিক্ষাকে যদি আমরা জীবনব্যাপী শিক্ষা করতে পারি এবং সেই শিক্ষা যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় তাহলে বাকি যে ১৬ টি গোল বা লক্ষ্য আছে সেগুলো অর্জন করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো সেই ১৬টি গোলের মধ্যে মানুষকে বানর বানানো আর ইতিহাস বিকৃতি ও ধর্ম বিদ্বেষ নেই তো?
পাঠ্যবইয়ে অসঙ্গতি, চুরি ও কপি স্বীকার করে দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবালের বিবৃতি দিয়েছেন।বিবৃতিতে বলা হয়েছে- সারা দেশে ২০২৩ সালে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তক ছাপা হয়েছে। পরবর্তীতে তা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। গত ১৫ জানুয়ারি একটি দৈনিকে মতামত কলামে সপ্তম শ্রেণির ‘বিজ্ঞান- অনুসন্ধানী পাঠ’ বইটির ব্যাপারে একটি অভিযোগ নজরে আসে। একই পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে অনেকে জড়িত থাকেন, যাদের শ্রম ও নিষ্ঠার ফল হিসেবে বইটি প্রকাশিত হয়। বিশেষত জাতীয় পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে সব লেখকের কাছ থেকেই এক ধরনের দায়িত্বশীলতা আশা করা হয়। সেখানে কোনো একজন লেখকের লেখা নিয়ে এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তা আমাদের টিমের জন্য হতাশার ও মন খারাপের কারণ হয়।
ওই অধ্যায়ের আলোচিত অংশটুকু লেখার দায়িত্বে আমরা দুজন না থাকলেও সম্পাদক হিসেবে এর দায় আমাদের ওপরও বর্তায়, সেটি আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি। অবশ্যই পরবর্তী সংস্করণে বইটির প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করা হবে। এ বছর বইটির পরীক্ষামূলক সংস্করণ চালু হয়েছে এবং সামনের শিক্ষাবর্ষ থেকে এতে যথেষ্ট পরিমার্জন ও সম্পাদনার সুযোগ রয়েছে। কাজেই উল্লিখিত অভিযোগের বাইরেও যেকোনো যৌক্তিক মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হবে। সে অনুযায়ী পাঠ্য বইয়ের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হবে।
আমরা মনে করি নতুন শিক্ষাক্রম বা চলতি-২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে ঈমান, ইসলাম ও ইতিহাস বিরোধী অধ্যায়গুলোকে সম্মিলিতভাবে না বলা উচিত। ভুল এবং অসঙ্গতিপূর্ণ পাঠ বা বক্তব্য প্রত্যাহারে সকল জনগণের এগিয়ে আসা নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের কথা হলো আগামীতে পাঠ্য বইয়ের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জনে মানুষকে বানর বানানো আর ইতিহাস বিকৃতি ও ধর্ম বিদ্বেষ নেই তো? ভুল তথ্য দিয়ে হলেও ব্রিটিশ শাসনপূর্ব মুসলিম শাসকদের হেয় করা, অন্য ধর্মের শাসকদের তুলনায় তাদের নীচু করা হবে না তো? মাদ্রাসার পাঠ্য বইয়ে হিন্দুদের মূর্তি!এইসব কি দেখার কেউ নেই? এমনটি যেনো না থাকে। মাদ্রাসায় এবতেদায়ী ও দাখিলের পাঠ্য পুস্তকে ভিন্ন ধর্মের প্রতিমার ছবি, ও লেখকের প্রবন্ধ দিয়ে ইসলামের সাথে তামাশা বন্ধ করা হবে তো? সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতেছি, নিঃসন্দেহে আলিয়া মাদ্রাসা শুধুমাত্র মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
এখানে তো আর হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টানদের বাচ্চারা পড়ে না।তাহলে কোন যুক্তিতে মাদ্রাসার সিলেবাসে এসব ঢুকানো হলো? এসব পাঠ্যবইয়ে শুধুই কি ভুল নাকি সর্ষেতে ভূত? ইতিহাস বিকৃতি, ইসলাম ও ধর্ম বিদ্বেষ বাদ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম হোক প্রকৃত মানুষ গড়ার জন্য। নাস্তিক, পশু বা বানরমুখী নয়, বইগুলো হোক কল্যাণকর, সুশিক্ষা উপযোগী ও মানবমুখী।
কিউএনবি/আয়শা/১৯ জানুয়ারী ২০২৩/সন্ধ্যা ৬:৫৫